তীরন্দাজ নববর্ষ সংখ্যা
অদৃশ্য ইশারা
পূর্ণিমা রাত। আকাশজুড়ে অগনিত তারার মেলা। চোখ উঁচিয়ে পুরো আকাশ খুঁজে কোথাও একটুকরো মেঘের দেখা পেলো না ময়না। বড্ড গরম পড়েছে। পূর্ণিমা চাদঁটা তারার মধ্যমনি হয়ে বিলিয়ে দিচ্ছে মায়াবী আলো। চাঁদে কলঙ্ক থাকলেও জোছনার সে আলোয় কলঙ্ক নেই মোটেও। এমনই স্নিগ্ধ মায়াময়ী এক জোছনা রাতে স্বামী ছিরু সিকদার রহস্যজনক ভাবে খুন হয়েছিল। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ পাঁচ বছর। কিন্তু মৃত্যুরহস্য উন্মোচিত হয়নি আজও। স্বামী হারানোর পর তার জীবনের গতিপথ পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছিল। অনবরত শূন্যতা তাকে পোড়ায় খুব। পেট বাঁচাতে বেছে নেয় চাতালের কাজ। তাও তো বছরখানেক হতে চলল। হ্যাঁ,আজকের এই দিনেই তো সে জনশূন্য এই চাতালকে সঙ্গী করেছিল। অচিরেই একটা দীর্ঘশ্বাস দলা পাকিয়ে গলার কাছটা আড়ষ্ট করে দেয় ময়নার। জোছনার আলো ঠিকরে পড়েছে ময়নার মুখে। ময়নাকে মতির সব সময়ই ভালো লাগে। পবিত্র দৃষ্টিতে তাকায় ময়নার দিকে। ময়না আসার পর থেকে অসহায় মতিরও গতি হয়েছে। অন্তত কথা বলার একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ পেয়েছে সে। কিন্তু মুখচোরা মতি বলতে পারে না ময়নাকে ওর ভালো লাগার কথা।
কী করে বলবে? সে যে গরীবের চেয়েও গরীব, কাঙালের চেয়েও অধিক কাঙাল। কোথায় ময়না আর কোথায় মতি । লাউফুলের মতো ধবধবে সাদা গায়ের রঙ ময়নার। শুধু আগুন আর রোদ তার সাদা চামড়ার রঙটা তামাটে করেছে খানিকটা। তেমনি হরিণি চলনবলন তার। চোখ দুটোতে চাতকির চাহনি নিয়ে দু পায়ে ধান ছড়ায় উঠোনে। মতি চোরাচোখে তাকিয়ে দেখে।
জোছনা রাতে ময়নার মনোবেদনা অধিক বেড়ে যায়। স্বামী ছিরু সিকদারের কথা খুব মনে পড়ে। জোছনার চাদর মুড়ে হারাতে চায় অজানায়। এমন কত ধবল জোছনার রাতে স্বামীর হাত ধরে গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটতো দুজন। তাতে রচিত হতো সংসার তরঙ্গের তালে টিকে থাকার অনুপুঙ্খ সাংসারিক চিত্রমালা। বাড়ির দক্ষিণ পাশটা খোলা থাকায় হুহু করে ঢুকে পড়ত দখিনা বাতাস। বসন্তের আউলা বাতাস বয়ে নিয়ে আসতো উলুর ফুলের ঘ্রাণ।
ধান সেদ্ধ করা, শুকানো ময়নার পেশা। সারা রাত ধরে ধান সেদ্ধ করে সে। চুলার গনগনে আগুনের ঠিকরেপড়া আলোয় ময়নাকে আরো সুন্দর দেখায়। ফজরের আজান দিলে ঘুমাতে যায় সে। ময়না যখন ঘুমায়, হাবাগোবা মতিই তখন কাজে-কর্মে দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে।
মতিকে বিষ্ণুপুর গ্রামে এনেছিল চাতালের মালিক রইজউদ্দিন মোল্লা। মতির পৈতৃক ভিটা ছিল সিরাজগঞ্জে। যমুনা নদীর কোলঘেঁষা এক নিভৃত চরের বাসিন্দা ছিল সে। আটানব্বইয়ের বন্যায় সে বাড়িঘরের সাথে পরিবারকেও হারিয়েছিল। মতি সেই রাতে বাড়িতে না থাকায় বেঁচে গিয়েছিল।
রইজউদ্দিন ধনী মানুষ। ধানের কারবার তার। সারা বছর ধানের ব্যবসা চলে। ঘরে তার দুই-দুইটা বৌ। দুই বৌয়ের গর্ভজাত গোটা পাঁচেক ছেলে-মেয়ের বাবা সে। ব্যবসার সুবাদে বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত তার। বড় ট্রলার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘটনাক্রমে সিরাজগঞ্জে ধান কিনতে গিয়ে মতিকে পেয়ে যায়। তখন আট-দশ বছর বয়সের ছেলেটা পরিবার এবং ভিটে হারিয়ে নিঃস্ব। চোখেমুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবনের ছায়া। মতির মামা তিন হাজার টাকার বিনিময়ে মতিকে বিক্রি করে দেয় রইজের কাছে । সে টাকা উসুল করতে আজ বাইশটা বছর ধরে মতিকে খাটিয়ে চলেছে। পেটে-ভাতে খাটে সে। মামির সংসারের উৎপাত মতি রইজের চাতালের এসে হয়ে পড়েছে উৎপাদনশীল পশু।
ধান সেদ্ধ করতে করতে গভীর ক্লান্তিতে ঝিমুনি লেগেছিল ময়নার। আঁচলে আগুন ধরলেও টের পায়নি। ধপধপ করে আগুন আঁচল বেয়ে উপরে উঠলে পুরো চাতাল আলোকিত হয়ে যায়। মতি ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার দেয় – আগুন…! ময়না আগুন দেখেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। মতি কলসি ভর্তি পানি ময়নার শরীরে ঢেলে আগুন নেভায়। অজ্ঞান ময়নাকে মতি শুইয়ে দেয় ঘরে। ময়নার ঘুম ভাঙলে দেখে ভোরের ভনিতাহীন ঝলমলে সূর্য আলোকিত করছে পুরো পৃথিবী। কিন্তু তার ভাবনার সুতোয় কোথায় একটা টান লাগে। স্বস্তি মেলে না কিছুতেই।
কয়দিন ধরেই জ্বরজ্বর লাগছিল তার। রইজউদ্দিনের কাছে ছুটি চেয়েছিল। রইজ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে খুব বিচ্ছিরি ভাবে বলেছিল, ময়না তর গতরে কিয়ের জ্বর আহে আমি জানি! তর বয়স আর কত? এই বয়সে ওরম জ্বর আহে। জ্বর হারনের ওষুধ আমি তরে আইনা দিমু। তুই চিন্তা করিছ না। রইজের বাজে ইঙ্গিত ময়নার ভালো লাগেনি।
রইজের চোখের চাহনি আর হাসি দেখে গা গুলিয়ে বমি এসেছিল ময়নার। জ্বর নিয়েই সমানে ধান সেদ্ধ করে চলেছে। উপায় নেই কলের মেশিনের মতো কাজ করা চাই। নবান্নের আধাপাকা ধান মহাজন কিনে কিনে চাতাল ভরে রাখে। ময়না ধানের শরীরে খুঁজে পায় মৃত স্বামীর ঘ্রাণ। পাথার থেকে ধান কেটে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরতো ছিরু সিকদার। ঘামে জবুথবু অবস্থায় পেছন থেকে আচমকা ময়নাকে জড়িয়ে ধরতো ছিরু। ময়না ভয়ার্ত চোখে পাশ ফিরে দেখতো ছিরুকে। আদুরে বিড়ালের মতো গুটিসুটি মেরে চোখ বুঁজে পড়ে থাকতো স্বামীর বুকে। আজও পূর্ণিমার জোছনা। আকাশে থালার মতো বড় চাঁদ তার শরীর থেকে নিংড়ে দিচ্ছে জোছনার ফোয়ারা। যথারীতি ধান সেদ্ধ করছে ময়না। ফর্সা দুটি গাল চুলার গনগনে আগুনের আঁচে চিকচিক করছে। রূপালি জোছনাও ম্লান হয়ে আসে সে সৌন্দর্যের কাছে। দূরে দাঁড়িয়ে রইজউদ্দিন কাপুরুষের মতো চোখের নেশায় শুষে নেয় সেই পবিত্র আভাটুকু। রাতের আঁধারকে আশ্রয় করে ময়নার রূপের ঐশ্বর্যে ডুবে যাচ্ছে তারই অগোচরে কেউ।
লোকটা কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি ময়না। টের পায় কয়েকটা নেড়ি কুকুরের সম্মিলিত ঝগড়া যখন চরমে পৌঁছায়। একটা অবাঞ্ছিত হাড় নিয়ে ওদের প্রাণান্ত যুদ্ধ। কেউ ছাড় দিবেনা। ঘেউ ঘেউ শব্দে টিকতে না পেরে চেলা কাঠ নিয়ে তেড়ে আসে ময়না।
ময়নার রুদ্ররূপ দেখে কুকুর তিনটি তিন দিকে ছিটকে পড়ে। জোছনার আলোয় ঘরের কোণায় লুকানো মনুষ্যমূর্তির ছায়াটি লম্বা হয়ে বিপরীত দিকে পড়েছে। হঠাৎ ছায়াটিতে চোখ আটকে যায় ময়নার।
ময়না চেচিয়ে ওঠে, কেডা খাড়াই আছেন ওই হানে? কথা কন না ক্যান্? ভয়ার্ত ও উৎসুক ময়না সে দিকে এগিয়ে যায়। বুকটা ধক করে ওঠে।
মিয়া ভাই আপনে এইহানে?
কিছু কী কইব্যার চান?
ধান সেদ্ধ কতদূর দেখতি আইলামরে ময়না! তোর শয়ীলডা ক্যাবা আছে? ভালানি আছিস? কাইল আগুন লাগলো ক্যাবা?
ময়নার থেকে কোন জবাবের তোয়াক্কা করল না রইজ। সোজা ঢুকে পড়ল দক্ষিণ দিকের ময়নার একচালা বসত ঘরটার ভেতর। শয়ীলডা জানি কিরম লাগতাছে ময়না। এট্টু পানি নি দিবার পারিস?
এত রাতে অন্নদাতার এমন আহ্বানে সে বিব্রত হয়। পানি খাইতে চাইলে না করবে কী করে। লোকটার কী কোনো কুমতলব আছে?
সন্দিগ্ধ মনে একা একা বিড়বিড় করে সে। ওর চোখে হায়েনার ক্ষুধা দেখেছে ময়না। লাল চোখের পুরুষ সে। সে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিতে পারে সবকিছু। কিছুটা বিলম্ব দেখে রইজউদ্দিন আবার চেঁচিয়ে ওঠে। মতিডা নাক ডাইকা ঘুমাচ্ছে। ময়নার একবার মনে হলো মতিকে চেঁচিয়ে ডাকে।
ময়না হুনোস না? ভিত্রে আয়। এক গেলাস পানি দে। শয়ীলডা য্যান্ কেমন করতাছে। ময়না এক-দুই-তিন করে পা বাড়ায়। ঘরের দাওয়ায় ডান পাটা ফেলতেই হ্যাচকা টান দিয়ে ময়নাকে চিটচিটে বিছানায় ফেলে দেয়। জবাই করার পূর্বে যেমন গরুকে হ্যাঁচকা টানে শুইয়ে গলায় ধারালো ছুরি চালায় দক্ষ কসাই। ময়না মৎস শিকারীর বড়শীর খোটায় আটকে যাওয়া মাছের মতো নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। তড়পাতে থাকে কাটা কৈ মাছের মতো। শরীরের শক্তি কমে এলে অবস্থা বেগতিক হয়ে ওঠে। নিরুপায় হয়ে মৃত বোয়াল মাছের মতো পড়ে থাকে। খর চৈতালি রাতেও অব্যক্ত বেদনায় দু চোখে নেমে আসে অশ্রুর ফোয়ারা। রইজ যাওয়ার সময় বলে, তোরে আমার তিন নাম্বার বৌ বানামুরে ময়না। চিন্তা করিছ না।
ময়নার ছেলের মুখে তিনবেলা অন্ন তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল রইজউদ্দিন। পড়ালেখার খরচ দেয়। তার প্রতিদান এভাবে দিতে হবে ভাবতে পারেনি ময়না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়েও দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো মিলিয়ে যায় তার সমস্ত ভাবনা। সন্তানের কথা ভেবে কিছুই করতে পারে না। কোথায় যাবে সে? কে আছে তার! একলা পৃথিবীতে চলা সত্যিই কঠিন।
একটা সময় ময়নার সুখ ছিল। ছোট্ট সংসার। যুগল প্রেমের তাল লয় ছন্দে বেশ চলছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল জুড়ে সন্তান আসে। ময়নার স্বামীর ছিল প্রবল মাছের নেশা। বর্ষার আষাঢ় -শ্রাবণের ঢলে থৈথৈ জলে ভরে উঠতো খালবিল। রাতবিরেতে মাছ ধরতে কোথায় কোথায় চলে যেত সে।
সময়টা শ্রাবণের মাঝামাঝি। এক জোছনারাতে মাছের নেশা পেয়ে বসল ছিরুকে। ছিরু বেরিয়ে পড়লো মাছ শিকারে। যাওয়ার সময় মন সায় দিচ্ছিল না ময়নার।
ছিরুকে বলল, হুনছি আজরা ভাটার রাইতে ভূতপ্রেত বাইর অয়। নানা রকম সুরত ধইরে মানুষের সামনে আহে। তারপর যারে সামনে পায় ঘাড় মটকাইয়্যা দেয়। আজ তোমার মাছ মারতে যাইতে অইবো না।
ময়নার দু চোখে ভয়। ছিরু পাত্তা দেয় না। আরে দূর অ! তুমি যে কী কও? আওলাঝাওলা চিন্তা কইরো না গিন্নি। ভূত বইল্যা দুইন্ন্যায় কিছু আছেনি! এই কথা বলে খলবল করে হেসেছিল ছিরু।
তারপর ঝুঁপি কোচ সমেত ডোঙা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে তাকে ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে গেল মাছেদের আস্তানায়। ময়নার সে রাতে কিছুতেই দু চোখে ঘুম এল না। সারা রাত এপাশওপাশ করল। ফজরের আজান হলো, ছিরু বাড়ি ফিরল না।
ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস সইতনের মায়ের। সে-ই প্রথম দেখেছিল। ছিরুর নিথর দেহ পড়ে আছে ঘরের দরজার সামনে। তার চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে এল ময়না। স্বামী নিস্পন্দ দেহ পড়ে আছে। ছিরুর ঘাড়ের কাছে অসংখ্য জখমের চিহ্ন। স্পষ্ট ফুটে ওঠা আঙুলের ছাপগুলোকে ভূতের আঙুলের ছাপ বলে চালিয়ে দিল ছিরুর সৎ ভাই ছাবু। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে রটে গেল সেসব কথা রূপকথার মতো। এই গ্রাম থেকে সেই গ্রাম চাউর হলো ভূতের কাহিনী। সেই থেকে ময়নার জীবনের রোজনামচা রইজউদ্দিন নামক লোকটা নিজের হাতে লিখে চলেছে। আজ রাতে চাতাল দেখার নাম করে ময়নার জীবনে সর্বনাশের শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়ে গেল।
পাশেই একটা হাজামজা ডোবা পুকুর। পুকুরটা সারা বছর শুকনোই থাকে। চৈতালির খররোদে অবস্থা হয়ে পড়ে বেগতিক। তলদেশ পর্যন্ত ফেটে চৌচির হয়ে ছিল। তবে গত সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে তৃষ্ণা মিটিয়ে পুকুরটা এখন জলমগ্ন। সেই জলের প্রশ্রয়ে কয়েকটা ডোবাপানা নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। ময়না পুকুরের কিনারায় পা ফেলতেই কয়েকটা ব্যাঙ ঝপাৎ করে লাফিয়ে পড়ল ডোবার জলে। স্বল্প জল হালকা কাঁপল। কয়েকটা ঢোরা সাপ শরীর দুলিয়ে চলাফেরা করে রাত-দিন। ডোবার জলে অপবিত্র শরীর ডুবিয়ে ডরায় ময়না। সে ভয় সাপের ভয়, নাকি অদৃশ্য মহাপরাক্রমশালী খোদার ভয়, তা সে বুঝতে পারে না। মন থেকে কিছুতেই শান্তি পায় না। অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল মতি। ঠিক দাঁড়িয়ে নয়, হেলান দিয়ে বসেছিল পরিত্যক্ত ঘরের খুঁটির সাথে। ময়না ভেজা কাপড়ে ডোবা থেকে উঠে আসে। আলো-আঁধারিতে মতির অস্পষ্ট দাঁড়িয়ে থাকা ময়নাকে অনিবার্য লজ্জা থেকে বাঁচাতে পারে না। একেবারে কুঁকড়ে যায় নিজের ভেতর নিজে।
দূর থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান। কাপড় বদলে ওজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে কেবলামুখী হয় ময়না। একজনকে মন খুলে সব কথা বলা যায়। সমস্ত পঙ্কিলতা ধুয়ে দেয়ার জন্য আর্জি জানায় খোদার দরবারে। মোনাজাত শেষ করে। অদৃশ্য কেউ যেন শ্বাসপ্রশ্বাসের নালি চেপে ধরে।কেউ যেন নাসারন্ধ্রে লাগিয়ে দিয়েছে লোহার ছিপি। এদিকে পূবের আকাশ রাঙা করে ভোরের সূর্য কোনরকম ভণিতা ছাড়াই আলোকিত করছে গোটা ধরণী। স্নিগ্ধ নরম আদর মেখে হাওয়ায় দুলে ওঠে সাদা জুঁই ফুল। সিঁদুর লাল রঙের ফোয়ারা ছড়িয়ে পড়ছে সবুজ মাঠ ঘাট বৃক্ষ গুল্মের উপর।আজকের আকাশ তাতিয়ে তুলবে রাতের বিকিরিত ভূপৃষ্ঠের সেই রৌদ্রময় ফোয়ারাকে। ভোরের প্রথম আলোয় তারই যেন পূর্বাভাস।
মতি দরজার কাছে এসে ময়নাকে ডাকে, অহনো ঘুমাইতাছোছ ময়না? ময়না চোখ খোলে। শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।
মতি ভাই ডাকছো যে খুব? কিছু কইবা?
ধান চাতালে ছড়াইতে অইবো না? দেখছোছনি রোইদের বাহার! কথা বলে ময়নাকে চাঙ্গা করতে চায় মতি।
মতিকে জোকারের সুরে কথা বলতে দেখে ময়নার ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে।
চাতালে এসে দাঁড়ায় ময়না।
ময়না তর কী ইচ্ছে করে না দুই চোখ যেইহানে যায় চইল্যা যাইতি?
চাতালে ধান ছড়াচ্ছিল ময়না। মতির কথা কানে আসতেই সে থমকে দাঁড়ায়।
খুব মন চায় মতি ভাই।
মনে লয় দুইন্যার অন্য সব জঞ্জালের মতন নিজেরে জলচ্ছাসে ভাসাইয়া দিই।
যদি নিরুদ্দেশ হইতে পারতাম পাখির মতন, যেমন পাখি উইড়্যা উইড়্যা সীমানা ছাড়াইয়া পাড়ি জমায় অনেক অনেক দূরে।
মনতো পাখির মতো তাই না মতি ভাই?
হঠাৎ যেন কবিত্ব ভর করে ময়নার অনুভবে।
লেখাপড়ায় ভালো ছিল ময়না। অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হতে না হতেই বাবা মারা যায়।
মতি মনোযোগ দিয়ে শোনে ময়নার দুঃখগাথা। সরল স্বভাবের মানুষটা ময়নার মনের অন্দরের খবর জানতে একাগ্র মনে কান খাড়া করে থাকে। ময়না যে আজ দহনজ্বালায় দগ্ধ। পৌষালি রাতের শীতলতা প্রয়োজন ময়নার। বোকা মানুষটাও যে একা। তিনকূলে কেউ না থাকার যন্ত্রণা সে ভালো ভাবেই বোঝে। রইজের জন্য ঘৃণার পারদ উথলে উঠলে ময়নাকে সে বলে,
আমি তরে মুক্তি দিবো। আমার লগে যাবি?
ময়না যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। কী কইলা মতি ভাই? ফের কও শুনি!
আমার লগে যাবি? মতি আবার বলে।
পারবা তুমি আমারে মুক্তি দিবার? পারবা আমারে এই নরক থাইক্কা উদ্ধার কইরবার? পারবা আমার পোলার দায়িত্ব লইতে? পারবা আমার মতো পাপিষ্ঠারে মাইন্যা লইতে? পারবা? কও পারবা? আবেগের আতিশয্যে এক সাথে প্রশ্নর পর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ময়না।
হ পারুম।খা লি তুই একবার হ কয়া দ্যাখ!
যেন এই মাত্র দুজন মিলে আবিষ্কার করল মুক্তির এক অভিনব পথ।
আমার মতো পাপিষ্ঠ নারী তোমারে কীই বা দিতে পারবো, কও?
মতি বোকার মতো দাঁত দিয়ে জিব কাটে! ও কথা কইছ ন্যা ময়না। তোর কুনো দোষ নাই। গরীবের দোষ গরিব হইয়্যা জন্মানো। উপ্রে যে বইয়্যা আছে মাজে মাজে সেও আমগো লগে তামশা করে রে ময়না! হ্যার ইশারা আমরা কী বুজমু কছে!
শরতের বিকেল। বিকেলের বিষণ্ণ আলো এসে ঠিকরে পড়েছে ময়নার মুখে। সে রাতের ঘটনার পর কেটে গেছে কয়েক মাস। সেই থেকে ময়নাকে দেখায় বাসিফুলের মতো প্রাণহীন। সে ফুলে ঘ্রাণ নেই। সতেজতা নেই। আগের মতো হাসে না। বরং আছে শুষ্ক নিকষ কালো ছায়ার রেখা। তার ইচ্ছের হাতে নানা অজুহাতে কেউ পরিয়ে দিয়েছে লোহার শিকল। সে শিকল ভাঙার গান মতি তাকে শুনিয়ে এসেছে এতদিন।
ময়না মতিকে ডাকলো। ধীরস্থিরভাবে বলল, যা করবা চিন্তা ভাবনা কইরা করবা। ধরা পইড়লে দুই জনরে জানে মাইরে ফালাবো।জানোই তো ওই শয়তানডা রক্তখেকো পিশাচ।
চরাচর জুড়ে ধূসর সন্ধ্যার আবছায়া । আলোর রঙ ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। দক্ষিণ দিকের বাঁশবাগানের ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে পূর্ণ চাঁদ। আজ যেন কোন সুদূরে কেউ তার জন্য সাজিয়ে রেখেছে অনন্ত বাসর। সেখানে যাওয়ার তীব্র বাসনায় শরীর মনে এক অপার্থিব তাড়না। মিশ্র এক অনুভূতি। মতি গেছে এতিমখানায়। ময়নার ছেলেকে নিয়ে আসবে। এরপর নিরুদ্দেশ যাত্রা।
একদিকে মুক্তির আনন্দ অন্যদিকে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। তাছাড়া কোথায় যাচ্ছে তাইতো জানে না তারা। এভাবে অতিথি পাখির মতো নিরুদ্দেশে বেরিয়ে টিকে থাকতে পারবে তো? রান্না করতে করতে ময়নার মাথাটা চক্কর দেয় বার কয়েক। মনে পড়ে দুপুরে খাওয়া হয়নি তার। মতি ময়নার ছেলেকে নিয়ে ফিরেছে। রাত পোহাবার আগেই রওনা হতে হবে।
আজ রাতে ময়নার ধান সেদ্ধর তাড়া নেই। প্রকৃতিতে শরতের দাপুটে আবির্ভাব। এ সময় চাতালের কাজ কমে আসে। তাই আগেই শুয়ে পড়ল। পাশে ঘুমাচ্ছে ময়নার একমাত্র ছেলে। কিন্তু ভবিষ্যৎ ভাবনায় ঘুম নামে না চোখে। মতির সাথে কথা হয়েছে। ফজরের সময় রওনা হবে তারা। রাত প্রায় তিনটা। হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাটখড়ির ঝাঁপি খুলে রইজউদ্দিন ঘরে ঢুকল। ঘুম আসছিল না মতিরও। দরজা খোলার শব্দে ময়না ভয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। পেছন থেকে বেরিয়ে এলো মতি। ধান সেদ্ধর জ্বালানি কাঠ নিয়ে পেছনে ঢুকল মতি। জমে থাকা ক্ষোভ ঘৃণা একত্র করে সজোরে আঘাত করল মাথায়। রইজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। টের পাচ্ছে রইজ। মতি চেলা কাঠ দিয়ে উপর্যপুরি আঘাত করল।
শক্ত রশি দিয়ে রইজকে ঘরের খুঁটির সাথে বেঁধে তিন নীড়-সন্ধানী পাখি পা বাড়াল অজানার পথে…
Leave feedback about this