বিশেষ সংখ্যা গদ্য চলচ্চিত্র

কান চলচ্চিত্র উৎসবের ইতিবৃত্ত | আদনান আসিফ ও জাকের আদিত্য | কান উৎসব

১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে ভেনিসের মোস্ত্রায় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের চলচ্চিত্র নিয়ে জড়ো হন। ফ্রান্স বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। জুরি প্যানেলেও ছিলেন ফ্রান্সের কূটনীতিক ফিলিপ এরল্যাঙ্গার।
এই উৎসবে আমেরিকার একটা চলচ্চিত্র সবার হৃদয় কেড়ে নেয়। কিন্তু হিটলারের চাপে নাৎসি প্রোপ্যাগান্ডা নিয়েরেনি রেইফেলস্থালের নির্মিত চলচ্চিত্র ‘অলিম্পিয়া’ এবং গফ্রেডো আলেসান্দ্রিনির ‘লুচিয়ানো সেরা, পাইলট’ সর্বোচ্চ পুরষ্কার ‘মুসোলিনি কাপ’ জয় করে। এই সিদ্ধান্ত তখন গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নির্মাতারা মেনে নিতে পারেননি।তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ড মোস্ত্রা প্রতিযোগিতাটি প্রত্যাখ্যান করে। পরে আর কখনও এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে না বলে জানিয়ে নেয়।
মোস্তা থেকে ট্রেনে ফিরতে ফিরতে ফিলিপ এরল্যাঙ্গারের মাথায় বিকল্প চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের ভাবনা আসে। তিনি মনে করেছিলেন উৎসবটি হতে হবে নিয়ন্ত্রণহীন ও পক্ষপাতমুক্ত। ফ্রান্সে ফিরে উৎসব আয়োজন নিয়ে তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এভাবেই বিশ্বচলচ্চিত্র জগতে কান চলচ্চিত্র উৎসবের বীজ রোপিত হয়ে যায়।

সেপ্টেম্বর ১৯৩৮ সাল থেকে মে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বিষয়টি ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অংশ হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ বনেট ভয় পাচ্ছিলেন, এতে আবার ফ্রান্স-ইতালির সম্পর্ক খারাপ হয়ে না যায়। যদিও শিক্ষামন্ত্রী জ্যঁ জে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলবেয়ার সারাত ইউরোপে এই ধরনের একটা চলচ্চিত্র উৎসবের পক্ষে ছিলেন। তাদের মনে হয়েছিল শিল্পে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত। ১৯৩৯ সালের জুনে ফ্রান্সের গণমাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হতে চলেছে, এমন খবর প্রকাশ করে। খবরটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন সমমনা দেশ কর্তৃক প্রশংসা পায়। সিদ্ধান্ত হয়, মোস্ত্রা চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা যেদিন শুরু হবে সেদিনই, অর্থাৎ প্রতিবছর ১ সেপ্টেম্বর উৎসবটি শুরু হবে।

উদ্যোক্তারা প্রথমেই ভেবেছেন, ফ্রান্সকে এমন একটি সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসবের জন্ম দিতে হবে যা ভেনিসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। ১৯৩৯ সালের ৯ মে দশটি ফরাসি শহরের মধ্যে বিয়ারিৎসকে প্রথমে এই উৎসবের জন্য নির্বাচন করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্যারিসের মিউনিসিপাল কাউন্সিলর জর্জ প্রাদে, কান শহরের সমর্থকেরা এবং কানের হোটেল মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কান শহরকে উৎসবের জন্য বেছে নেওয়া হয়। ফরাসি সরকার উদ্বোধনের মাত্র তিন মাস আগে ১৯৩৯ সালের ৩১ মে আনুষ্ঠানিকভাবে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ঘোষণা আসে।

সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৩৯ সালের প্রথম উৎসবটি ১ থেকে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মিউনিসিপাল ক্যাসিনতে অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন সিনেমাটোগ্রাফির জনক লুইস লুমিয়েরে। প্রথমে এই উৎসবে গুরুত্ব দেয়া হয় বৈশ্বিক সর্বজনীনতার উপর। প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব চলচ্চিত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করে উৎসবে অংশগ্রহণ করবে। জুরি বোর্ডেও থাকবে সব দেশের প্রতিনিধিত্ব। যে চলচ্চিত্রগুলো অংশগ্রহণ করবে, সেসব চলচ্চিত্রও হবে দেশগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী চলচ্চিত্র। এতে শিল্পকলার সর্বজনীন নান্দনিকতাকেই প্রাধান্য দেয়া হবে এবং বিচারক কমিটি কোন পক্ষপাত করবেন না। সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার জন্য উৎসবে জার্মানি ও ইতালিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু সময়টি ছিল অন্য রকম। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল; ফ্যাসিবাদী জার্মানি ও ইতালি এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। ফলে, মাত্র নয়টি দেশ প্রথম উৎসবে যোগ দেয়। এই দেশগুলোর চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী।
আগস্টে ইউরোপে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছিল। তবু এরই মাঝে উৎসবের প্রস্তুতি চলছিল। শিল্পী জ্যঁ-গ্যাব্রিয়েল দোমেরগিউ আমন্ত্রণপত্রের ঢঙে উৎসবের প্রথম পোস্টারটি তৈরি করেন। আমন্ত্রিত দুই হাজার অতিথির কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়। ভাড়া করা হয় আটলান্টিক মহাসাগরে চলাচল করা একটি জাহাজ। কানের সমুদ্রতীরে জাহাজটি নোঙর করানো হয়। এতে টাইরন পাওয়ার, গ্যারি কুপার, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, জর্জ র্যা ফ্ট, পল মুনি, নর্মা শিয়ারার, মায়ে ওয়েস্টের মতো তারকাদের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো পরিবেশে সূচনা ঘটতে পারত এই প্রথম উৎসবের।

কিন্তু সেটা হয়নি। উৎসবটি বাতিল হয়ে যায়। ২৩ আগস্ট স্তম্ভিত পৃথিবী জানতে পারে জার্মান-সোভিয়েত ইউনিয়নের মৈত্রীর কথা এবং অধিকাংশ আমন্ত্রিত অতিথি প্যারিস ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। কিন্তু এই গভীর সংকটের সময়েও আয়োজক কমিটি ঠিক করে, শুধু একটি চলচ্চিত্র গোপনে দেখানো হবে। কান উৎসবে গোপনে প্রদর্শিত সেই প্রথম চলচ্চিত্রটি ছিল উইলিয়াম দিয়েতেরলের ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নতর-দেম’।
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর যেদিন উৎসবের উদ্বোধন হবার কথা, সেদিনই জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। সিদ্ধান্ত হয়, উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দশ দিন পিছিয়ে দেয়ার। কিন্তু উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে সিদ্ধান্তটি অন্যান্য ঘটনার অন্তরালে চলে যায়। উৎসবের জন্য নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলো আর প্রদর্শন করা যায়নি। প্রথম উৎসবে যে চলচ্চিত্রগুলো নির্বাচিত হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে আমেরিকার প্রতিনিধিত্বকারী চলচ্চিত্র ভিক্টর ফ্লেমিংয়ের‘উইজার্ড অব ওজ’, হাওয়ার্ড হকসের ‘অনলি অ্যাঞ্জেলস হ্যাভ উইংস’, সিসিল বি. ডেমিলের ‘ইউনিয়ন প্যাসিফি’। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্বকারী চলচ্চিত্র মিখাইল রোমের ‘লেনিন ইন অক্টোবরে’র মতো অসাধারণ সব চলচ্চিত্র। গ্রেট ব্রিটেনের চলচ্চিত্র জোল্টান কোর্দার ‘দা ফোর ফাদারস’, জ্যাক ফেইডারের ‘লা লোই ডু নর্ড’, ক্রিশ্চিয়ান জ্যাকের ‘লনফার ডেসঞ্জস’, জুলিয়েন ডুভিভিয়ারের ‘লা চ্যারেট ফ্যানটম’; যে চলচিত্রগুলো ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করছিলো।

১৯৪৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কান চলচিত্র উৎসব প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় কানের গ্র্যান্ড হোটেলের বাগানে। সূচনা সংগীত পরিবেশন করেন মার্কিন গায়ক গ্রেস মুর। বহুজাতিক আনন্দঘন মুখর পরিবেশে উৎসব চলতে থাকে। উৎসবে ছিল আতশবাজি, টর্চলাইট প্যারেড, ভ্রমণ, শান্তির পায়রাদের আকাশে মুক্তি দেওয়া, ফ্যাশন শো, প্রথম মিস ফেস্টিভ্যাল নির্বাচনসহ আরও অনেক কিছু।
এভাবে কান চলচ্চিত্র উৎসব সামনে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা জগতের রথি-মহারথীরা তাতে যোগ দিতে শুরু করেন। ওই সময় যারা যোগ দেন তাদের মধ্যে ছিলেন, রবার্তো রোসেলিনি, ওয়াল্ট ডিজনি, বিলি ওয়াইল্ডার, জর্জ কুকর, ডেভিড লিন, জ্যঁ রেনোয়াসহ অনেকেই।

প্রথম দিকে সামাজিক কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু পরে উজ্জ্বল সব তারকা, রেড কার্পেটের চমৎকার আবহ আর মিডিয়ার নিরন্তর মনোযোগের কারণে খুব দ্রুতই কান চলচ্চিত্র উৎসব বিশ্বে অভিজাত মর্যাদাপূর্ণ উৎসবে পরিণত হয়। এর জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। কার্ক ডগলাস, সোফিয়া লরেন, গ্রেস কেলি, ব্রিজিট বার্দোত, ক্যারি গ্রান্ট, রোমি স্নাইডার, অ্যালেন ডেলন, সিমন সিগনোরেট, জিনা লোলোব্রিদিতার মতো সেলিব্রেটিদের ঝলমলে উপস্থিতি এই উৎসবকে শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র উৎসব করে তোলে। পাবলো পিকাসোর অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। ১৯৪৯ সালে পিকাসোর জন্য উদ্বোধন করা নতুন ‘প্যালাইস ক্রোয়েসেট’। উৎসবটি তখন ভিন্ন রূপ পায়।
কিন্তু এর সবই স্নায়ুযুদ্ধ-পূর্ব পৃথিবীর আগের ঘটনা। স্নায়ুযুদ্ধের পর এমন সব চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছিল যেখানে পূর্ব ও পশ্চিম তাদের মুখোমুখি লড়াইকে তীব্র করে তুলছিল। রাজনীতি কান চলচ্চিত্র উৎসবকে যাতে বাধাগ্রস্ত না করে সেজন্য আয়োজক কমিটি উৎসবের শর্তে একটি ধারা বা বিধি সংযোজন করে।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে আয়োজক কমিটি প্রায় এগার বার এই নিয়ম-নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হন। ১৯৫৬ সালে প্রায় ছয়টি চলচিত্র সেন্সর করা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে আয়োজক এই ধারাটি বাদ দেন। ফলশ্রুতিতে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি হয় এই উৎসবে যেখানে চলচিত্রের সিনেমাটোগ্রাফির নন্দন তত্ত্বকে তার কূটনীতিক পরিচয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
নানা টানাপোড়েনের মধ্যেকানকে ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছিল। পুরো পঞ্চাশের দশকটা এভাবেই কেটে যায়। এই মারাত্মক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার কারণে অর্থের অভাবে ১৯৪৮ ও ১৯৫০ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসব বাতিল হয়ে যায়। উৎসবের সময়ে পরিবর্তন আসে, নিয়ে যাওয়া হয় বসন্তকালে। ১৯৫২ সালের পর থেকে উৎসবটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে মে মাসে।১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত জুরি বোর্ডের সব সদস্যই ছিলেন ফরাসি। উৎসবের সর্বোচ্চ পুরষ্কার ছিল গ্রাঁ প্রি। কিন্তু এর বাইরে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কিছু পুরস্কার দেয়া হত। রঙিন আর সিনেমাস্কোপ রীতির চলচ্চিত্রের আবির্ভাবের সাথে সাথে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের জন্য পুরষ্কারগুলি বিশেষভাবে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সমালোচনা হওয়ায় তারা ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে প্রথাগত পুরষ্কার প্রদানে ফিরে আসে। চলচ্চিত্রের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গঠন করা হয় বৈশ্বিক জুরি বোর্ড।

১৯৫৯ সালে ফ্রান্সের পঞ্চম প্রজাতন্ত্র দিবসকে উপলক্ষ করে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রী আন্দ্রে মালরোকে উৎসবের প্রধান আয়োজক নির্বাচিত করা হয়। তিনিই নির্ধারণ করেন কোন চলচ্চিত্রগুলো ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করবে। মালরোর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল। নতুন প্রজন্মের নির্মাতাদের জন্য তিনি নতুন দিগন্তের সূচনা করলেন।
এদেরই এক জন হচ্ছেন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো। তিনি ১৯৫৯ সালে পুরস্কৃত হন। মালরো সাহসী এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার চলাচ্চিত্র যেমন অ্যালাইন রেসনাইসের ‘হিরোশিমা মন আমুর’ [১৯৫৯] এবং ক্রিস মার্কারের ‘দি ওয়ার ইস ওভার’ [১৯৬৬] নির্বাচনের বিচক্ষণতা দেখান। তার এই কর্মকাণ্ডের ফসল আলফ্রেড হিচককের ‘দি বার্ড’ [১৯৬৩], লিন্ডসে অ্যান্ডারসনের ‘দিস স্পোর্টিং লাইফ’, লুচিনো ভিসকোন্তির ‘দি লেপার্ড’, ফেদেরিকো ফেলিনির ‘৮-১/২’-এর মতো অসাধারণ সব ছবি।
এই সময়েই শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র বা আর্ট ফিল্ম গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কান চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। চলচ্চিত্র শিল্পসম্মত একটি ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

ফ্রান্সের সামজিক অস্থিরতার ভেতরে ১৯৬৮ সালের শুরু হয় ২১তম উৎসব। দেখানো হলো ভিক্টর ফ্লেমিংয়ের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘গন উইথ দ্যা উইন্ড’। কিন্তু উৎসব পরিণত হল বিতর্কের কেন্দ্রে। জুরি বোর্ডের সদসসরা পদত্যাগ করলেন এবং অনেক পরিচালক উৎসব থেকে তাদের চলচ্চিত্র প্রত্যাহার কর নিলেন। ১৯ মে লুই ম্যালে, ত্রুফো, গদার, ক্লদ বেরি, মিলোস ফরম্যান, রোমান পোলানস্কি এবং ক্লদ লেলুচ কার্লোস সাউরার চলচ্চিত্র ‘দি পেপারমিন্ট’ মঞ্চে উঠে প্রদর্শনে বাধা দেন।

১৯৬৮ সালের বিপ্লবের পর আয়োজকরা আধুনিকতার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। প্রচলিত ধারণার সাথে নতুন সৃজনশীল ধারণা এবং শিল্পের প্রতি গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৯ সালের উৎসবে বৈপ্লবিক ধারণা এবং তার দ্বারা উৎসাহিত চলচ্চিত্র বেশি মনোনীত হয়, যা বিপ্লবের আবহকে তুলে ধরেছিল। স্বভাবতই এই ধারার চলচ্চিত্র পুরস্কৃত হয়। যেমন ডেনিস হপারের ‘ইজি রাইডার’ এবং কোস্টা-গাভ্রাস এর ‘জেড’।

পৃথিবীর নানা প্রান্তের চলচ্চিত্র কানে স্থান করে নিতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ফিলিপাইন, চীন, কিউবা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনার মতো দেশের ছবি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। প্রতি বছর নতুন তারকারা আলো ছড়াতে থাকেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পশ্চিমী দুনিয়ার বাইরের চলচ্চিত্র ও পরিচালকেরা স্বীকৃতি পাওয়া শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় অ্যালাইন কর্নিউ, আন্দ্রে টেচিনি, স্টিফেন ফ্রেয়ার্স, লিওস ক্যারাক্স, লার্স ভন ট্রিয়ার, স্পাইক লি, জিম জার্মুশ এবং এমির কুস্তুরিকার মতো প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। দর্শক সারিতে উপস্থিত হতে থাকেন বিশ্বখ্যাত অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সার্জিও লিওন, থিও অ্যাঞ্জেলোপোলোস, বার্ট্রান্ড ট্যাভার্নিয়ার, পিটার গ্রিনওয়ে, ইটোর স্কোলা, তাভিয়ানি ব্রাদার্স, নিকিতা মিখালকভ, উডি অ্যালেন, জঁ-লুক গদার, বার্নার্ডো বার্তোলুচ্চি, মিলোস ফরম্যান, ফ্রান্সেস্কো রোসি, আন্দ্রে তারকভস্কি, জন হুইস্টন, আন্দ্রে ওয়াজদা, লোচ আন্ড্রেভস্কি, জেমস কেনোভ, আকিরা কুরোসাওয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত বিশ্বখ্যাতরা।
আকিরা কুরোসাওয়া সম্মানিত হন তার চলচিত্র ‘কাগেমুশা’র [শ্যাডো ওয়ারিওর] জন্য। উইম ওয়েন্ডার্সকে সম্মানিত করা হয় ‘প্যারিস, টেক্সাস’ সিনেমার জন্য, যা ওই দশকের সবচেয়ে প্রশংসিত ‘পাম ডি’ও’ পাওয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে।
১৯৮৭ সালে ইয়ভেস মন্তান্ড ছিলেন কানের ৪০তম উৎসবের প্রেসিডেন্ট এবং উৎসবটি উৎসর্গ করা হয় মায়েস্ত্রো ফেদেরিকো ফেলিনিকে। এর সমাপ্তি অনুষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে তাঁর বিখ্যাত আর অসম্ভব বিতর্ক সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র ‘আন্ডার দ্যা সন অফ স্যাটান’ সিনেমার পাম ডি’ও পুরষ্কার পাওয়ার জন্য।
দুই বছর পর ১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়াল পতনের আনন্দ, মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার ঘোষণার মধ্য দিয়ে পালিত হয় উৎসবটি। বিভিন্ন দেশের একশো জন নির্মাতা উৎসবে অংশ্রহণ করে। তারা বাকস্বাধীনতা এবং ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি উল্লেখ করেন। থিও অ্যাঞ্জেলোপোলোস, বার্নার্দো বার্তোলুচি, ইয়েভেস বোয়েসেট, ইউসেফ চাহিন, জেরি শ্যাটজবার্গ, উইম ওয়েন্ডারস, আমির কুস্তুরিকা এবং ইটোর স্কোলা-সহ আরও অনেকে সব রকমের সেন্সরের বিরুদ্ধে একটি ঘোষণাপত্র দাখিল করেন।

উৎসবের নতুন যুগ শুরু হয় নতুন স্থানের প্রতীকী পরিবর্তনের মাধ্যমে। সত্তরের পর থেকে সবাই বুঝতে পারের ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই উৎসবের জন্য একটি নতুন স্থান দরকার। ১৯৮২ সালের উৎসবে স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘ইটি- দ্যা এক্সট্রা টেরেসট্রিয়াল’ এর প্রদর্শনী ছিল প্যালেস ক্রোয়েসেটে প্রদর্শিত শেষ ছবি। তখন ঘোষণা করা হয় যে ১৯৮৮ সালে প্যালেস ক্রোয়েসেট ভেঙে ফেলা হবে।
ড্রুয়েট ও বেনেট নতুন ভবনের নকশা তৈরি করেন। ১৯৮৩ সালে নতুন ভবনটি নির্মাণ করা হয় এবং এর নামকরণ করা হয়্য প্যালে ডে ফেস্তিভ্যালস ডে কংগ্রেস’। ভবনটি বাঙ্কার’ নামেও পরিচিত। মার্টিন স্করসেসির ‘দ্য কিং অফ কমেডি’র প্রদর্শনীর মাধ্যমে ভবনটির যাত্রা শুরু হয়।
নতুন সিনেমা হল ‘গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে’ আর ‘ক্লদ ডেবাসি অডিটোরিয়াম’ উৎসবের প্রভাব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। যেমন মার্চে ডু ফিল্ম’-এর প্রদর্শনী বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র মেলায় পরিণত হয়। দুই হাজারেরও বেশি দর্শক এবং ছয়শটি প্রদর্শনী হয়েছিল এক দশকে। এই সময়ে ভবনটির ২৪টি বিখ্যাত লাল কার্পেটমোড়া সিঁড়ি হেঁটে তারকাদের শোভাযাত্রা প্রদর্শনী স্থলে পৌঁছাতে থাকে। এটিই হয়ে ওঠে কান উৎসবের বিশেষত্ব। বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই শোভাযাত্রা।

এখন কান উৎসবটি আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, অর্থাৎ সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র তীর্থে পরিণত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পাম ডি’ও এশীয় নির্মাতারাও জিতেছেন। প্রায় সব ক্যাটেগরিতে তারা পুরস্কার জিতছেন।

৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কানের মঞ্চে জড়ো হন পাম দি’অরজয়ী নির্মাতারা। ইনগ্রিড বার্গম্যানের অনুপস্থিতিতে লিন উলম্যান, বার্গম্যানের স্ত্রী ও কন্যা গ্রহণ করেন পাম দেস পাম (শ্রেষ্ঠতের শ্রেষ্ঠ) সম্মাননা। উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে ইউসুফ চাহিন তার চলচ্চিত্র ‘দ্য ডেস্টিনি’র জন্য ৫০তম বর্ষপূর্তির পুরস্কার লাভ করেন। ইরানের আব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘টেস্ট অফ চেরিস’ এবং শোহেই ইমামুরার ‘দ্য এল’ যৌথভাবে পাম জিতে নেয়।
এর পর উৎসবটি একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করে। নতুন যুগ, নতুন উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে উৎসবটি।
পরিবর্তিত আবহের সূত্রে নতুন যুগে প্রবেশ করে। এগিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে।
এবছর কান চলচ্চিত্র উৎসব ৭৮তম বছরে পদার্পণ করেছে। জমকালো উদ্বোধনী হয়ে গেছে। দেখা যাক কী ঘটে এবছর।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field