যুদ্ধ কবিতা
যুদ্ধ সম্পর্কে একটি কবিতা লেখার জন্য
আমি যাত্রা শুরু করেছি।
কিন্তু বুঝেছি, এটা হবার না।
কলম তো আর আমার হৃদয়ের জিভ নয়।
আমিই বলছি :
‘কলম ছুড়ে ফেলে দেওয়া উচিত।’
কথার অস্ত্র আর কার্যকর নেই।
এর চেয়ে আরও ধারালো কোনো অস্ত্রের প্রয়োজন।
যুদ্ধের কথা বলতে গেলে আমাকে বন্দুক ও ব্যারেলের কথা বলতে হবে
শব্দকেই হতে হবে বুলেট –
যুদ্ধ সম্পর্কে একটি কবিতা লেখার জন্য
আমি যাত্রা শুরু করেছি
আমার নিজের শহর ডিজফুল সম্পর্কে কবিতা লিখতে হলে
বুঝতে পারছি আমাকে সেই অপ্রীতিকর ‘
ক্ষেপণাস্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করতে হবে
কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্র তো
আমার কথার সৌন্দর্য কমিয়ে দেবে।
আমি নিজেকে বোঝালাম আমার কবিতার
বিকৃত লাইনগুলো
শহরের বাড়িঘরগুলোর চাইতে ভালো কিছু হবে না।
যাক, আমার কবিতা
মানুষের মাটির ঘরের মতো ছিন্নভিন্ন, ধ্বংসপ্রাপ্ত,
রক্তে ভেজা হোক।
যা দরকার তা হলো কবিতা আজ ধুলো আর
রক্তে পরিপূর্ণ থাক
ক্রোধ নিয়েই আমাকে কবিতা লিখতে হবে
কোলাহলে ভরা একটি সুস্পষ্ট কবিতা
এমনকি অসম্পূর্ণ –
আমিই বলছি :
আমাদের এই শহরের
দেয়ালগুলো আবার টিউলিপের ছবিতে
ছেয়ে গেছে
এখানে
যেভাবে ভীষণ সতরক থাকতে হয়
সেই অবস্থার কখনও অবসান হয় না
লাল-সতর্ক করে দেওয়া সাইরেনটি
কী যে চিৎকার করছে।
রাতের নীরবতার ভেতরে একা
শত্রুর বর্বর বাদুড়েরা কী যে লোভী হয়ে ওঠে,
এমনকি ছোট্ট কোনো ফোকর দিয়ে
এক চিলতে আলো এলেই
মৃতদেহের অসমাপ্ত ঘুমের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে।
আমাদের সব জানালা ভারী পর্দা দিয়ে
ঢেকে দেওয়া দরকার
এখানে,
এমনকি দেয়ালগুলোও কাউকে
আশ্রয় দেয় না অথবা আড়াল করে না।
দেয়ালগুলো কবর, রাত্রি নামার অপেক্ষায়
খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এমনকি নক্ষত্রদেরও আর
বিশ্বাস করা যায় না।
তারা হতে পারে
শত্রুর রাতকালীন পাহারাদার।
এখানে,
চাঁদে বিস্ফোরণ ঘটলেও মানুষ অবাক হতো না!
এখানে,
কেবল তারারা, তাদের দূরবর্তী
ওয়াচ-টাওয়ার থেকে দেখে
কীভাবে রাতটা কত ঘিনঘিনে হয়ে উঠছে।
কিন্তু তারাদের যদি জিভ থাকত
তাহলে রাতের শয়তানদের নিয়ে কবিতা
আবৃত্তি করত,
আমার নীরব ভাষণের চেয়ে যা হতো
অনেক বেশি স্পষ্ট-বাচন।
হ্যাঁ,
রাতগুলো খারাপ।
প্রতি রাতে আমরা সবাই তীক্ষ্ণ চোখে
মৃত্যুর রাক্ষসকে দেখি।
প্রতি রাতে, শহরের ছোট বাচ্চারা বাস্তবের পোশাক খুলে
দেখে সেই পরিচিত দুঃস্বপ্ন।
এখানে,
প্রতিটি রাত নামলে,
আমরা নীরবে নিজেদের বলি :
সম্ভবত আজই হবে আমাদের জীবনের শেষ রাত।
আজ রাতে
ঘুমের মধ্যে পুড়ে যাওয়া মাটির ঘরে
কোন মা জেগে থাকবেন,
তার আর্তনাদ শুকিয়ে গেছে,
এমনকি কান্না তার গলা পর্যন্ত পৌঁছায় না
এখানে,
মাঝে মাঝে অনেক দূরের ছাদ থেকে
মানুষের ছিন্ন মাথা আমাদের আনতে হয়,
কবরে ঘুমনোর জন্য তাকে শুইয়ে দিতে হয়।
অথবা আমরা যখন রক্তমাখা পাথর, মাটি ও ধাতুর গায়ে
নখ দিয়ে খুঁড়ি ও আঁচড়াই
তখনই দেখতে পাই কাদা মাটির নীচে
এক মহিলা
নীরব হয়ে একটি ছোট সেলাই মেশিনের উপর
ঝুঁকে আছেন।
এখানে, প্রতিদিন সকালে ঝাড়ুদার এমন একজনের
ছাই নিয়ে চলে যায়, যে সবার ভালোবাসা পেয়েছিল।
এখানে, বেঁচে থাকার মতো পর্যাপ্ত বাতাসও নেই,
তবে এখানে, সবসময় অসংখ্য খবরাখবর থাকে।
আমার কাছে আছে হৃদয় থেকে উৎসারিত খবর,
আমার মায়ের হৃদয় থেকে উঠে আসা খবর,
আমার ভাইয়ের আর্দ্র চোখের ঝলকানি থেকে
উত্থিত খবর।
আমি তোমাকে অন্যরকম খবর দেব :
ছোট ছোট হৃদয়ের
সরু কবরের মাটি ও পাথরের টুকরোর খবর।
রক্তেভেজা ঘরের খবর,
রক্তাক্ত পুতুলের গল্প,
স্বপ্নে ভরা বালিশের ওপর ছোট্ট মাথা ফেটে যাওয়ার খবর
সেই কালো রাতের
মিষ্টি শিশুসুলভ স্বপ্ন –
সেই ধুলো-ওড়া রাত,
যখন একজন মানুষ রক্তবর্ণ উদ্বিগ্ন চোখে
নর্দমার উপর ঝুঁকে পড়ে তার অন্য হাতটি খুঁজছিল।
বিশ্বাস করো,
বিশ্বাস করো।
আমি আমার নিজের দুই বিস্ময়ভরা চোখে দেখলাম
একটি শিশু ভয়ে দ্রুত দৌড়াচ্ছে,
কিন্তু কাঁধের ওপর তার মাথা ছিল না।
কিছুক্ষণ পর সে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
আরও কিছু পরে, একজন কুঁজোমতো লোক
দ্রুত এগিয়ে এলো,
সাইকেলের পেছনে মাথাটা নিয়ে তার সন্তানের
কবরে চলে গেল!
তার বুকের ভেতরে কিছু একটা অনুপস্থিত ছিল…
কিন্তু
এই ধুলোয় ঢাকা কাঁধগুলো, কতটা শিল্পহীন আর ধৈর্যশীল,
বিপর্যয়ে কেঁপে উঠল।
যদিও
তাদের হাঁটু ও পিঠ ভেঙে গেছে,
তবুও তারা বিজয়ী এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
কোন ঘর বা আশ্রয় ছাড়াই –
ইমামের কথাগুলো তাদের কানে বাজছে,
সংকল্প ও ত্যাগের ফতোয়া শুনছে তারা।
নিজেদের কাঁধে তারা প্রতিরোধের ব্যানার বহন করছে।
নিশ্চয়ই,
এমনকি দেয়ালগুলোও আমার হৃদয় থেকে
বেরিয়ে আসা জ্বলন্ত শব্দগুলো শুনে
সহ্য করতে পারেনি।
তুমি কি পার তাদের কথা শুনে সহ্য করতে?
দেয়াল?
ঠান্ডা, পাথুরে এবং চলমান দেয়াল!
তুমি মরে গেছ বলে এইসব ঠিকঠাক করা হচ্ছে।
বেঁচে থাকার জন্য তুমি কি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ?
না!
যতক্ষণ “আমার সন্তান, আমার সন্তান” এই কান্না
না থামবে
“আমার সন্তান, আমার সন্তান বলে
আমাদের মায়েদের গলা পুড়িয়ে দেওয়া উচিত
আর এই চিৎকারের সঙ্গে
আমাদের দরকার হবে আরও ধারালো অস্ত্র
হাতে তুলে নেওয়া
কেননা ভাষার ঠান্ডা অস্ত্র আর
কার্যকর নেই।”
উৎস : A Poem about War, by Qeyṣar Amīnpūr
কায়সার আমিনপুর ইরানের একজন প্রখ্যাত কবি।
Leave feedback about this