অনুবাদ ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

ফজল হাসান অনূদিত ফিলিস্তিনের দুটি গল্প | তীরন্দাজ অনুবাদ

তীরন্দাজ অনুবাদ

পনের বছর আগে আমার খালা হাদেল আবু জের হেবরন শহরের একজনকে বিয়ে করেছিলেন এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনে আরও স্থিতিশীল জীবনযাপনের জন্য তিনি গাজা থেকে সেখানে চলে যান। একসময় স্বামীর সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়েছে, হেবরনে খালা রীতিমতো রানীর মতো জীবন কাটাতেন। সেখানে তার গাড়ি ছিল, ছিল সবচেয়ে সুন্দর বাড়িগুলোর মধ্যে একটি এবং দুটি চাকরি থেকে উপার্জন আসত। একটা খেজুরের কারখানার ম্যানেজার এবং অন্যটি হাসপাতালের ডেটা এন্ট্রির কাজ। তিনি দুই সন্তানের জননী এবং মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করছিলেন।

বিয়ের পর বিগত পনের বছরে হাদেল অনেকবার গাজায় বসবাস করা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই ইসরাইলিরা তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি হেবরনে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য গাজায় আমাদের সমস্ত অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। হাদেল তার বোনদের বিয়ে, ভাগ্নির পরীক্ষায় সাফল্যের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান এবং সমস্ত নাতি-নাতনির জন্মের সময় অনুপস্থিত থাকার জন্য ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কখনো আশা ত্যাগ করেননি এবং বারবার চেষ্টা করেছেন এই আশায় যে, পরের বার হয়তো তার অনুরোধ রক্ষা করা হবে।

একদিন, গাজার অন্য অনেক মর্মান্তিক দিনের মতো, আমরা হাদেলের পিতা হাজী আবু আম্মার আবু জেরের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ঘুম থেকে জেগে উঠি। তিনি ছিলেন একজন শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি, সবাইকে ভালোবাসতেন এবং বিনিময়ে তিনি সবার ভালোবাসা পেয়েছিলেন। আমাদের অন্তর দুঃখ-শোকে ভরে গিয়েছিল এবং যখন আমরা হাদেলকে হৃদয়বিদারক এই দুঃসংবাদ জানিয়েছি, তখন ফোনে তার কান্নাকাটি এবং অপ্রতিরোধ্য চিৎকারের শব্দ শুনতে পেয়েছি। পনের বছর ধরে পিতাকে দেখতে না পাওয়ার শোকে তিনি ভেঙে পড়েন।

শোক পালনের দ্বিতীয় দিনে, গাজা সফরের অনুরোধ জানানোর পর, ইজরায়েলিরা তাকে গাজায় যাওয়ার অনুরোধ অনুমোদন করে। এত বছর পর ইজরায়েলিরা হাদেলকে তার বাবাকে বিদায় জানানোর অনুমতি দেয়, তবে কেবল তার কবরে যাওয়ার অনুমতি মেলে। তারা হাদেলকে তার বাবার কবরের একটি ছবিও তুলতে অনুমতি দেয়নি। গাজায় আসন্ন সফর এবং পরিবার সম্পর্কে হাদেলের মনের মধ্যে কোনো আনন্দের অনুভূতি ছিলনা।

একবুক হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে হাদেল সন্তানদের নিয়ে গাজায় পৌঁছান। শোকের দিনগুলো পরিপূর্ণ ছিল তার চিৎকার, কান্নাকাটি এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কারণ তিনি বাবাকে দেখতে চেয়েছিলেন এবং সন্তানদের নিয়ে বাবার সঙ্গে বসে গল্প করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবার সঙ্গে তার সন্তানদের কখনই দেখা হয়নি। প্রিয় বাবার মৃত্যুর কারণে অবশেষে তিনি গাজায় ফিরে আসেন। এই কষ্ট হাদেলকে ক্ষত-বিক্ষত করে এবং ইসরাইলিদের প্রতি তার ঘৃণা আরও প্রবল হয়।

যা-ই হোক, দুঃখ-শোক এবং স্বজন হারানোর ক্ষতি সত্ত্বেও জীবন চলতে থাকে। গাজায় পৌঁছানোর কয়েকদিন পর হাদেল তার ঘনিষ্ঠ পরিবার এবং অন্য আত্মীয়দের দেখে নিজেকে শান্ত করতে শুরু করেন। তিনি গাজা শহর দেখতে এবং শহরের রাস্তায় হাঁটতে বেরুতেন। কারণ এ দিনগুলো তার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে হয়েছে; যা হয়তো আর না-ও আসতে পারে। এছাড়া তাকে আর কখনই গাজায় ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হবে না বলে মনে করতেন। তিনি সমুদ্র দেখতে যান, যা তিনি বিগত পনের বছর ধরে দেখবেন বলে আশা করছিলেন। কিন্তু বাবাকে ছাড়া এই সফরটি তার কাছে অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

হাদেল গাজায় পৌঁছানোর এক সপ্তাহ পরে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে, ইজরায়েলিরা গাজায় যুদ্ধ শুরু করে। সেটাই ছিল হাদেলের দেখা প্রথম যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের সময় ইজরায়েলি সৈনিকেরা আমাদের উপর যে বিমান হামলা চালিয়েছিল, তখন তিনি এখানে ছিলেন। হাদেলকে গাজায় আমাদের সঙ্গে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। কারণ তখন সীমান্ত অতিক্রম করার সব পথই বন্ধ ছিল এবং যাতায়াত ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাকে তার কাজ, বাড়িঘর, পড়াশোনা এবং হেবরনের জীবন ছেড়ে আসতে হয়েছিল। তিনি জানতেন না কখন আবার সেখানে ফিরে যেতে পারবেন।
বোমাবর্ষণ তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের জন্য হাদেলের ভয় আর আতঙ্ক বাড়তে থাকে। তিনি আশঙ্কা করেন, সন্তানদের মধ্যে একজন কিংবা উভয়েই নিহত বা আহত হবে এবং তাদের গাজায় নিয়ে যাওয়ার প্রথম সফরটি হবে তাদের হারিয়ে ফেলার কারণ।

গাজা সফরের আগে হাদেল, আমাদের শাহজাদী খালা, ফ্যাশন ও সাজসজ্জার প্রতি সচেতন ছিলেন। তিনি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর গাড়ি পরিবর্তন করতেন এবং ঘন ঘন বাড়ির আসবাবপত্র বদলাতেন। তিনি সবসময় পরিপাটি থাকতেন এবং বেশভূষায় খুবই মার্জিত ছিলেন। হঠাৎ করেই তিনি গাজা শহর থেকে খান ইউনিস, তারপর রাফাহ পর্যন্ত শহরে উদ্বাস্তু হয়ে জীবনযাপন করেছেন। তাকে গাধার গাড়িতে চড়ে বাড়িঘর ছেড়ে বের হতে হয়েছিল। প্রতিদিন তিনি ক্ষুধা এবং ভয়ের মধ্যে কাটিয়েছেন। আমাদের আশ্রয়ে থাকার সময় আমরা তার জন্য একটি মনোরম পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করেছি, যাতে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলে থাকতে পারেন। তার মেজাজ হালকা রাখার জন্য আমরা ছোট ছোট জিনিস নিয়ে কৌতুক করতাম এবং আমরা তাকে কখনই একা থাকতে দিতাম না। কিন্তু আমাদের সবার চেয়ে যুদ্ধ ছিল আরও শক্তিশালী।

ছয় মাসের বোমাবর্ষণ, স্থানচ্যুতি, যন্ত্রণা, হতাশা এবং ক্লান্তির পরে চোরাচালানীরা গাজা ভ্রমণের আবেদন গ্রহণ করতে শুরু করে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সমন্বয় ফি ছিল দশ হাজার মার্কিন ডলার এবং শিশুদের জন্য ছিল পাঁচ হাজার ডলার। এই ফি ছিল শুধু গাজা স্ট্রিপ থেকে গাজার কাছাকাছি মিশরে পৌঁছানোর জন্য। গাজায় যাওয়ার জন্য হাদেলের একদিনের অপেক্ষাও অসহ্য লাগছিল। অথচ তার যেতে লাগবে কুড়ি হাজার ডলার।

এই বিশাল অংকের টাকাকড়ি জোগাড় করা হাদেলের জন্য খুব সহজ ছিল না। কিন্তু সন্তানদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য তিনি অনেক বছর ধরে অর্থ সঞ্চয় করে গেছেন। এই যুদ্ধ থেকে সন্তানদের জীবন বাঁচানোই ছিল তাদের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি গাজা থেকে পালিয়ে মিশর হয়ে তার জন্মভূমি হেরবনে যাওয়ার জন্য সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেন, যা তিনি গত পনের বছর ধরে স্বপ্ন দেখে আসছেন।

দু’দিন পর ভ্রমণকারীদের তালিকায় হাদেলের নাম ওঠে। অশ্রুসিক্ত শেষ বিদায়ী আলিঙ্গনের পর তিনি ভয় আর স্থানচ্যুতি থেকে পালিয়ে সন্তানদের নিয়ে মিশরে পাড়ি জমান। যুদ্ধের ক্ষত থেকে নিরাময়ের চেষ্টা করার জন্য তিনি মিশরে এক মাস অবস্থান করেন। কিন্তু তার পরিবার তখনো গণহত্যার মধ্যে থাকায় তিনি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেননি।

এক মাস অবস্থানের পর হাদেল যাতে হেবরনে পৌঁছুতে পারেন সে জন্য তিনি জর্ডানে যান। অবশেষে তিনি তার জীবনে, ঘর-বাড়িতে, পড়াশোনায়, চাকরি এবং বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে ফিরে আসেন। কিন্তু গাজা সফরের দুঃস্বপ্ন থেকে তিনি কখনোই পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি।

আজ রাতে ঠান্ডা এমন একটা কিছু, যা আমি শুধু অনুভব করছি না; বরং এমন কিছু যা আমি দেখছি।

নির্মম ঠান্ডা ভূতের মতো মাটি থেকে উঠে এসেছে। আমি যতই শক্ত করে নিজেকে কম্বলের ভেতর জড়িয়ে রাখি এবং লুকিয়ে রাখি না কেন, ঠান্ডা আমার চারপাশে তরঙ্গিত ঢেউয়ের মতো পেঁচিয়ে ধরে। তারপর অজানা স্থান থেকে হিমশীতল ঠান্ডা বৃষ্টির মতো চুঁইয়ে পড়ে এবং আমার চামড়া আঁকড়ে ধরে হাড়ের ভেতর স্থির হয়ে যায়।

আমার তাঁবু মজবুত এবং তারপরও রাতের তিক্ততার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
যখন সূর্য ওঠে, আমি অবাক হই এই ভেবে যে, কেন আজকের এই সকাল বিগত সকালের চেয়ে ভারী মনে হয়। এই নিরলস স্থানচ্যুতির প্রতিটি দিন মনে হয় তিক্ত ওষুধ গিলে খাওয়ার মতো, যা নিরাময় করে না কিংবা বিষাক্ত পানি পান করার মতো, যা কেবল বেদনাকে আরও গভীর করে।

তারপরও আমি জোর করে তাঁবু ছেড়ে চলে যাই। স্বাভাবিকভাবেই আমি পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে দেখতে পেয়েছি, কিন্তু তাদের নীরবতা ছিল অন্যরকম, গভীর এবং শ্বাসরুদ্ধকর।

‘শুভসকাল’, পরিবারের সবাইকে আমি বললাম। আমার কণ্ঠস্বর নিচু এবং দ্বিধাগ্রস্ত। কারো মুখে জবাব নেই। এই না-বলা সত্য বিষয়টি, যা ঠান্ডা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, আমরা সবাই অনুভব করি : আমার ভাই নূর এখনো নিখোঁজ রয়েছে।
যখন আমরা ২০২৪ সালের ৬ মে রাফাহ শহর ছেড়ে চলে আসি, তখন আমাদের অন্যান্য জিনিসপত্র সংগ্রহের জন্য নূর পেছনে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি পরদিন আমাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। আমি নূরকে বিশ্বাস করতাম; সবসময়ই করতাম। কিন্তু জীবন আমাকে অন্যরকম কিছু শিখিয়েছে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করেছি সেই সব দিনে, যা সপ্তাহে, পরে মাসে গড়ায়। নূর আর ফেরেননি। আমি এখনো তার জন্য অপেক্ষা করছি।

আমি আমার সবচেয়ে ছোট ভাই মোহান্নেদের দিকে ঘুরে তাকাই এবং তাকে ছবি তোলার জন্য দাঁড়াতে বললাম। সে ওঠে এবং বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আমার আসল উদ্দেশ্য তার ছবি তোলা নয়, বরং বাবার মুখের ছবি তোলা, যেখানে ক্লান্তি ও দুঃখের বিষণ্ণ ছায়া ফুটে উঠেছে। আমি নূরকে দেখাতে চাই, যখন তিনি ফিরে আসবেন; তার জন্য আমাদের দিনগুলো কত কঠিন এবং উৎকণ্ঠায় ভরা ছিল।
যে-ই আমি ছবি তোলার জন্য ফোন তুলেছি, ঠিক তখনই বাবা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন। তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে – নূরের জন্য শব্দহীন কান্না। আমি বাবার এরকম একটি মুহূর্ত সংরক্ষণ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তার পরিবর্তে ছবিতে আমি নূরের রেখে যাওয়া শূন্যতাকে ধারণ করেছি।

আরবি ভাষায় নূর নামের অর্থ ‘আলো’ – আমার ভাই নূরকে ছাড়া আমাদের জীবন অন্ধকারে ডুবে আছে।

আমাদের তাঁবুতে পরিবারের সবাই প্রতিদিন এই হিমশীতল আবহাওয়া এবং দুঃখজনক পরিবেশ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে কফির জন্য কেতলিতে পানি গরম করতাম; কাজটি ছিল এমন যা একসময় আমার কাছে সাধারণ কাজের মতো অনুভূত হতো, কিন্তু এখন ভারী এবং কঠিন মনে হয়। আমি মা ও বোনের দিকে কফিভর্তি কাপ এগিয়ে দেই। আমার বোন বিড়বিড় করে বলল, ‘প্রতিদিনের কফির স্বাদ আলাদা।’ আমি মায়ের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। মনে হলো তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন, ‘আমারও একই অনুভূতি হয়।’ কিন্তু তার দুঃখ-শোক তাকে চুপ করিয়ে রাখে; আমি জানি কফির স্বাদ আগের মতো নেই।

নূরের চলে যাওয়াটা আমরা মেনে নিতে পারছি না। আমি এই আশায় বুক বেঁধেছি যে, নূর আমাদের বাড়িতেই রয়েছে এবং কোথাও যেতে পারেনি।

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরে ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি বাবা এবং আমার এক চাচাতো ভাইকে নিয়ে আমি রাফায় ফিরে যাই। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নূরকে খুঁজে বের করা। কিন্তু আমরা আমাদের পরিচিত রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় দেখতে পেলাম, চেনাজানা সবকিছু ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা নিজেদের রাস্তা চিনতে পারছিলাম না। অন্যরা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে একসময় আমাদের বাড়িটি দাঁড়িয়ে ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। আমাদের বাড়ির আশেপাশের প্রতিটি বাড়ির একই পরিণতি হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম বাড়িটা ঘুরে দেখব, ভেতরে নূরকে খুঁজব, কিন্তু খোঁজার মতো কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

আমি ধ্বংসস্তূপের কাছে তাঁবু খাটাতে চাই। একসময় আমাদের যা কিছু ছিল, তার কাছাকাছি থাকতে চাই। কিন্তু কোনো জায়গাই খালি নেই। যা অবশিষ্ট আছে তা হলো শূন্যতা – মাটিতে এবং আমার হৃদয়ে।
বাড়িঘর নেই।
নূর নেই।
নূরকে এখনও পাওয়া যায়নি।
অন্য একদিন আমি যখন আমাদের বাড়ির অবশিষ্টাংশের কাছে আগুন জ্বালাচ্ছিলাম, তখন আমার প্রতিবেশীরা একে একে আমার সঙ্গে যোগ দিল। তাদের মধ্যে একজন আমাকে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার এক আত্মীয়, কারাগারে বন্দী ছিলেন। তিনি মুক্তি পেয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, কারাগারে নূরের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল।
লোকটি আমাকে অবাক করে দিলেন, ‘কেন আমার ভাই তাহলে আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন না, যদি সত্যিই তিনি সেখানে থেকে থাকেন? কিন্তু আমি নূরকে ক্ষমা করেছি, কারণ আমি জানি যদি তিনি পারতেন, অবশ্যই যোগাযোগ করতেন।
আমি সাত অক্টোবরকে দুঃস্বপ্ন হিসেবে দেখেছি। আমি বিশ্বাস করতে চাই, একদিন আমরা জেগে উঠব এবং উপলব্ধি করব যে, আমরা যা কিছু পেরিয়ে এসেছি, তা ছিল শুধু বেদনাদায়ক দীর্ঘ এবং ভয়ানক স্বপ্ন, অলীক অস্তিত্বে বিশ্বাস,যা থেকে আমরা পালাতে পারিনা। আর নূর ফিরে আসবেন, তিনি বেড়াতে গিয়েছেন মাত্র।
একরাতে যখন আমরা পরিবারের সবাই একত্রিত হয়েছি, তখন আমি অশ্রুভেজা চোখে নিঃশব্দে হেসেছিলাম। ‘আমি স্বপ্নে নূরের সঙ্গে দেখা করেছি, ’আমি তাদের বললাম, ‘তিনি আমার তাঁবুতে এসেছিলেন এবং আমাকে আসসালামুআলাইকুম বলে অভিবাদন করেছেন, বলেছেন আমি বেঁচে আছি। তারপরই তিনি অদৃশ্য হয়ে যান।’
আমার স্বপ্নের ভেতর নূরের এক বারের দর্শন আমার জীবন চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। এমনকি আমাকে আশা এবং বিশ্বাস রাখতে সাহস যোগাতে যথেষ্ট যে, তিনি ফিরে আসবেন।
আমি এমন একটি দিনের স্বপ্ন দেখি যেদিন এই দুঃস্বপ্নের অবসান হবে এবং আমি আবার আমার আলো খুঁজে পাব, আমার নূর, জীবন্ত, কোথাও।
ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আশা ছাড়ব না।
এখনও ছাড়িনি, নূরের জন্য।
আমার যা ছিল, তার জন্য।

গল্পসূত্র : ‘গাজায় আকাঙ্ক্ষিত সফর’ (ইংরেজিতে A longed-for visit to Gaza) এবং ‘কোথায় নূর?’ (ইংরেজিতে Where is Nour?) গল্প দুটি ‘উই আর নট নাম্বার্স’ অনলাইন ম্যাগাজিনে যথাক্রমে ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল এবং ১৯ মার্চ প্রকাশিত হয়।

লেখক পরিচিতি

আবদাল্লাহ্ আল জাজার

জন্ম গাজায়, কিন্তু শৈশব কেটেছে গাজা উপত্যকার সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত রাফায়। তিনি গাজার আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে ব্যাচেলার ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ টাউন ইউনিভার্সিটিতে আরব স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি ‘উই আর নট নাম্বার্স’-এর একজন নিয়মিত লেখক। উল্লেখ্য, ইজরায়েলিদের বোমা হামলায় তাঁর পরিবারের ৩৬ সদস্য শহীদ হয়েছেন। সর্বশেষ খান ইউনুসে (রাফা থেকে খানিকটা উত্তরে) বসবাস করছিলেন। গাজার সাম্প্রতিক গণহত্যার পর কোথায় আছেন জানা যায়নি।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field