ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

সহবাস | গৌতম বিশ্বাস | ছোটগল্প | তীরন্দাজ নববর্ষ সংখ্যা

Basic RGB

তীরন্দাজ নববর্ষ সংখ্যা

এক.

শেষবারের মতো এ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সুপ্রভা। কিংবা বলা ভালো বের করে নিয়ে গেল ওরা। ওরা মানে ছেলে অর্চি, মেয়ে বিনতা, জামাই আনন্দ, নাতি, নাতনি, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন। যেতে পারতেন তমোনাশও। যাননি ইচ্ছে করেই। এই মুহূর্তে তিনি ঝড়ে উপড়ে পড়া বটগাছ। অনেক ঝড় ঝাপটা সামলে দাঁড়িয়ে ছিলেন এতদিন। কিন্তু আজ আর ইচ্ছে থাকলেও সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই। চারপাশে একরাশ নিঃস্তরঙ্গ শূন্যতা। সেদিকে তাকালে দেখছেন রঙিন পৃথিবীটা কেমন বিবর্ণ হয়ে আসছে ক্রমশ। একটা বিষণ্ণ ছায়া ছায়া রোদ গুটিয়ে আনছে নিজেকে। এ যেন দিনান্তের স্পষ্ট ইঙ্গিত। দিন কি তবে শেষ হয়ে আসছে তমোনাশেরও?
একটু আগেও কত লোকজন। বাড়িভর্তি মানুষের আনাগোনা। কান্না, শোক, সান্ত্বনা, ব্যস্ততা। আর এখন – শূন্য বুক জুড়ে কেবলই স্মৃতির হামাগুড়ি। এত দিনের বর্তমানটা একটা রাতের মধ্যেই কেমন ইতিহাস হয়ে গেল। অথচ যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তমোনাশ- ওইতো সদ্য পুজো সেরে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন সুপ্রভা। এক্ষুনি এসে তমোনাশের কপালে ফুল ছোঁয়াবেন। প্রসাদী নকুলদানা নিজে হাতে গুঁজে দেবেন মুখে। তারপর প্রণাম সেরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলবেন, “দিন তো শেষ হয়ে এল, কবে আর ঠাকুর দেবতায় মন দেবে বলো তো?”
দু ঠোটের ফাঁকে হালকা হাসবেন তমোনাশ, “কে বলল দিইনি? এইযে তুমি কপালে ফুল ছোঁয়ালে, প্রসাদ খাওয়ালে, বারণ করেছি আমি? তাছাড়া ঠাকুরঘরে ঢুকে যখন তুমি পুজো দাও, উলু শাঁখের আওয়াজ করো, আমি তো মন দিয়েই শুনি। মানুষটা যে মোটেও নাস্তিক নই, এতে কী প্রমাণ হয় না?”
কী বলবেন সুপ্রভা? হালকা করে হাসবেন? হয়তো বলবেন, “তাহলে আর কী – কাল থেকে পুজোর সময় আমার পাশে গিয়ে বসবে।”
আবার কিছু না বলে চুপচাপ চলেও যেতে পারেন। এত বছর সংসার করেছেন। তমোনাশকে চিনতে কোথাও কি ফাঁক আছে আর? সুপ্রভার এই নিত্য পুজো তো আর কমদিন চলে আসছে না। একটি বারের জন্যেও কি ওমুখো নিতে পেরেছেন তাঁকে? চেষ্টা তো আর কম করেননি সুপ্রভা। তমোনাশের ওই এক কথা, “এসব আমি পারবো না সু। সবার দ্বারা সব কাজ হয় না। তাছাড়া তুমি তো করছই। আমায় আবার কেন করতে হবে।”
কাছাকাছি কারও হেঁটে আসার শব্দ। আচমকা একটা ধূলোর ঝড় এসে যেন ঢেকে দিল চারপাশ। কিংবা একরাশ কুয়াশা এসে তার বৃত্তে টেনে নিল সুপ্রভাকে। ঠাকুরঘরের সামনে ওই যে বেলগাছটার নিচে একটু আগেও যেখানে শুয়ে ছিলেন সুপ্রভা, এখন সেখানে একরাশ নিঃসীম শূন্যতা। যদিও ধুনোর গন্ধটা রয়ে গেছে এখনও। মৃত্যুর ওপারেও কী আরেকটা জীবন আছে? কী করছে এখন সুপ্রভা?
উত্তরটা খুঁজে বেড়ানোর সময় পেলেন না তমোনাশ। বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের মহিলা মালা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।
তমোনাশ তাকালেন মালার দিকে। কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেলেছে। শোকটা যে ভেতর থেকে বেশ ভালোমতই নাড়া দিয়ে গেছে তাকে তা একপলক তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায়। কমদিন কী আর এ বাড়িতে আছে মালা। সেই যে বিয়ের পরপরই স্বামী পঞ্চানন ছেড়ে দিল তাকে, তারপর এ বাড়িতেই তো তার একমাত্র ঠাঁই। তমোনাশ কিংবা বলা ভালো সুপ্রভা যদি তাকে আশ্রয় না দিত, এঘাট ওঘাট ঘুরতে ঘুরতে কবেই হারিয়ে যেত। কত বছর হয়ে গেল এ বাড়িতে আছে মালা। অর্চি, বিনতারা যখন এই এ্যাত্তটুকু। ওদের স্কুলে দিয়ে আসা- নিয়ে আসা তো মালই করতো। তমোনাশের তখন সময় কোথায়। অফিসে বিস্তর কাজের চাপ। ভোরে ভোরে বেরিয়ে যেতে হয়। ফিরতে সন্ধে। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে কোনও মতে বাড়িতে এনেই মুক্তি পেতে ইচ্ছে হতো। দৈনন্দিন এই ব্যস্ততার বাইরে অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছেই থাকতো না আর। যেটুকু যা সময় কিংবা সঙ্গ সুপ্রভা আর মালাই দিয়েছে ওদের। তারপর ওরা যখন বড়ো হয়ে গেল, স্কুল ছেড়ে কলেজ ধরলো, তখনও এটা-ওটা খেতে চেয়ে মালার কাছেই যত আব্দার। বিনতার বিয়েতে নিজে হাতে সবকিছু করেছে মালা। সুপ্রভার ভূমিকা ছিল সামান্যই। কেউ একজনা কথাটা তুলতে মালা বলেছিল- “নিজের তো ছেলে মেয়ে নেই, তাই এদের ওপর বড্ড মায়া। ছোট্টবেলা থেকেই তো নিজের ভেবে আসছি এদের। আজ এই শুভদিনেও না হয় মেয়েটাকে নিজেরই ভাবলাম।”
নিজের কানেই কথাটা শুনেছিলেন তমোনাশ। খুব খুশি হয়েছিলেন সেদিন। সুপ্রভাও বলেছিলেন, “খুব ভাগ্য করে এমন একজনকে পেয়েছি গো। যা দিনকাল, নিজের মানুষেরাই পর হয়ে যাচ্ছে। আর ওকে দ্যাখো, কে বলবে ও আমাদের বাড়ির কাজের লোক।”
না, কাজের লোক বলে কোনওদিন অন্য চোখে দ্যাখেননি তমোনাশও। আর সুপ্রভা? সেও তো মনে মনে মালাকে এ সংসারেরই একজন করে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে যখন বিনতার বিয়ে হয়ে গেল, চাকরি নিয়ে অর্চিও চলে গেল দিল্লীতে, তখন চারপাশে কেবল হা করা শূন্যতার গহ্বর। রংটং সব মুছে গিয়ে এক বিবর্ণ দিনযাপন। মালাকে ভীষণভাবে তখন আঁকড়ে ধরেছিলেন তারা। মালারও আর কোথাও যাওয়ার ছিল না। আপনজন বলতে এরাই। যারা সত্যিকার আপন ছিল তারা কবেই দূরে সরে গেছে। পেছন দিকে তাকানোর ইচ্ছেটাও মরে গেছে তার। এদের মাঝেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছে নতুন করে। একদিন কথায় কথায় বলেও ছিল কথাটা। হেসেছিলেন সুপ্রভা, “জীবন মানেই তো কিছু হারিয়ে আবার নতুন করে কিছু পাওয়া।”
একটু একটু করে কমে আসা কষ্টটা মালাকে দেখে ফের মোচড় দিয়ে উঠলো বুকে। মালার কষ্টটাও অনুভব করার চেষ্টা করলেন তমোনাশ। কোথায় যেন খুব সরু অথচ তীব্র একটা যন্ত্রণা। এভাবে বিনা নোটিশে সুপ্রভা চলে যাবেন তা ভাবতেও পারেননি কোনওদিন। আর তাই বুঝি কষ্টটা এত বেশি করেই বিঁধছে বুকে। একটু আগের কান্না চিৎকার আলোচনা সব থেমে গিয়ে সারা বাড়ি জুড়ে এখন একরাশ খাঁ খাঁ শূন্যতা। কারও সঙ্গ যেন ভীষণভাবেই এমুহূর্তে প্রয়োজন তমোনাশের। এই কঠিন নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে ফেলার ইচ্ছে হচ্ছে তীব্রভাবে। ভাঙলেনও তমোনাশ। কিছু একটা বলতে গিয়েও পারছিল না মালা। তমোনাশ জিজ্ঞেস করলেন, “মুখে কিছু দিয়েছো?”
সেই প্রথম দিন থেকে সুপ্রভা ‘তুই’ করে বললেও মালাকে সবদিন ‘তুমি’ করেই বলে এসেছেন তমোনাশ। বয়সের খুব বেশি ব্যবধান না থাকাতেই বোধ হয় এমন সম্বোধন। কিংবা হতে পারে তমোনাশের বাড়তি কিছু শালীনতা বোধ। হয়তো এই সম্বোধনটাই আরও কাছের করে নিয়েছিল মালাকে। তাই মালাও কমিয়ে এনেছিল সম্বোধনের দুরত্ব।
এতক্ষণে না বলতে পারা কথাটা বলে ফেলতে পারলো মালা, “আমি জানি দাদা, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এতগুলো বছর বৌদির সঙ্গে ছিলে। আর আজ একদম একা হয়ে গেলে।”
নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলেন তমোনাশ, “কে বললো একা হয়ে গেলাম? অর্চি আছে, বিনু আছে, তুমি আছো।”
“আমার থাকা না থাকায় কী এসে যায় দাদা? কাছের মানুষগুলোই তো দূরে দূরে থাকে।”
“তবুও তো আছে। যাদের তা-ও নেই, তাদেরও তো বেঁচে থাকতে হয়। তুমিও কী বেঁচে নেই?”
ফের চোখে জল এসে গেল মালার। সত্যিই তো কাছের মানুষগুলো তো সেই কবেই দূরে সরে গেছে। তাদের মুখগুলোও আজ আর মনে পড়ে না তেমন করে। সব কেমন ঝাপসা মনে হয়। তবুও তো বেঁচে আছে মালা। বরং ভালো ভাবেই আছে।
আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোন দুটো মুছে নিল মালা। বলল, “জানো তো দাদা, চোখের জলে কষ্টটা অনেকখানি ধুয়ে যায়। যারা কাঁদতে পারে তাদের দুঃখ অনেকটাই কম। যারা পারে না, কষ্টটা তাদের কেবল কুরে কুরে খায়।”
তমোনাশ তাকালেন মালার দিকে, “তুমি কি আমায় কাঁদতে বলছো?”
মালা বলল, “সে যদি ভেতর থেকে আসতে চায়, তাকে আটকে রেখে লাভ কী, দাদা?”
ক’দিন ধরেই শরীরটা পুরোপুরি ভালো যাচ্ছিল না সুপ্রভার। এমনিতে অসুখ বিসুখ তেমন একটা হয়নি কোনদিনই। ওই সামান্য সর্দি জ্বর, একটু আধটু মাথা ধরা আর বড়জোর খাওয়া দাওয়ায় কোন অনিয়ম হলে পেটের গণ্ডগোল। এর বাইরে তেমন কিছু হয়েছে বলে মনে পড়ে না। তবে ইদানীং বুকের বাঁ দিকটায় দিন কয়েক হল সূক্ষ্ম চিনচিনে একটা যন্ত্রণা উঁকি দিচ্ছিল। শরীরটা যে ভাঙছে বোঝা যাচ্ছিল বেশ। বয়স তো আর কম হল না। ষাটের কোঠা পেরিয়ে গেছে বছর কয়েক আগেই। এই সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে এসে একটু আধটু তো হতেই পারে ভেবে তমোনাশকেও বলেননি কথাটা। তবে সেদিন ব্যথাটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হতে আর না বলে পারেননি। শুনে ব্যপারটাকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও তমোনাশ নিয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তার দিবানাথ চ্যাটার্জীর চেম্বারে। পাঁচ-সাত রকমের ওষুধ লিখে দিয়ে ডাক্তার বলেছিলেন, “খেয়ে দেখুন মিসেস চৌধুরী। আশা করি এতেই ঠিক হয়ে যাবে।”
ঠিক যে হচ্ছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন তমোনাশ। তবু দিনান্তে অন্তত একটিবার জিজ্ঞেস করেছেন, “কেমন বুঝছো?”
মাথা নেড়েছেন সুপ্রভা, “ভালোই তো লাগছে।”
তমোনাশ বলেছেন, “আসলে বয়স হচ্ছে তো। শরীরের বাঁধুনি এবার একটু ঢিলে হবেই। আর এই ঢিলেঢালা কলকব্জা নিয়ে চলতে গেলে ছোটখাট বিপত্তি হতেই পারে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই সু। এ বয়সে মনের জোরটাই আসল।”
কথাটা যে মিথ্যে নয় সেটা বেশ বুঝতেন সুপ্রভা। তবু কোথায় যেন মনের বাঁধনটা আলগা হতে শুরু করেছিল। ছেলেমেয়েদের কথা মনে পড়তে শুরু করেছিল একটু ঘন ঘন-ই। মাঝে মাঝেই একলাটি আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে কী সব ভাবতেন। না ভেবে উপায়ই-বা কী। তারা তো আর ঘরের কাছে নেই যে ডাকলেই সাড়া দেবে। ছেলেটা বছরে একবারই আসে। মেয়েটাও প্রায় তাই। দুজনেরই এখন ওদের সংসার হয়েছে। হাজারো কাজ। নিত্য ব্যস্ততা। তাই একলাটি স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করা ছাড়া পথ ছিল না আর। বিশেষত গোধূলির আলো যখন কমে আসতো একটু একটু করে, চারিদিকে জেগে উঠতো কেমন এক শূন্যতার ছবি, তখন ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আকাশটাকে দেখতে দেখতে মনে হত ওই বিরাট শূন্যতার মতই একটা অসহ্যরকমের শূন্যতা যেন গিলে ফেলেছে বাড়িটাকে।
সেদিন নিজেই ফোন করেছিলেন অর্চিকে। ব্যস্ত মানুষ অর্চি। ফোন ধরেই বলেছিল, “হ্যাঁ মা বলো।” ছেলেমেয়েদের গলা শুনতে পেলেই শূন্য বুকটা ভরে যেত সুপ্রভার। থমকে গিয়ে চুপচাপ ছিলেন দু সেকেন্ড। তারপর বলেছিলেন, “তোকে যে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছেরে বাবা।”
ফোনের ওপাশে অর্চির বিস্মিত কন্ঠ, “সে কী মা, এই তো কমাস আগে ঘুরে এলাম।”
“আসলে তোদের দু’ভাই বোনকে একসাথে দেখা হয় না বহুদিন। একবার আয় না বাবা। বিনুকেও আসতে বলবো। তোরা নেই, বাড়িটা বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগে। একরাশ অসহ্যরকমের শূন্যতা বাড়িটাকে গিলে খায় সারাদিন। তার ওপর শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না ক’দিন। বয়স হচ্ছে। কবে কী হয়ে যায়। তাই বলি, একবার ভাই-বোনে একসাথে ঘুরে যা।”
ছেলে কি কিছুটা বিরক্ত হয়েছিল মায়ের আব্দারে? হতেই পারে। ব্যস্ত মানুষ সে। তার বাবা-মায়ের না হয় এখন হাতে অফুরন্ত সময়। তা বলে ওর তো তা নেই। অফিস আর যাওয়া আসা দিয়ে দিনটা কেটে যায়। রাতটুকুই যা পায় নিজেকে নিয়ে ভাবার। কিন্তু ক্লান্ত শরীরটা তখন মনের সাথে বিদ্রোহ করে। তার বিশ্রাম চাই। মন আর পেরে ওঠে না।
সুপ্রভার কথা শেষ হতেই অর্চি বলেছিল, “সে কী মা, তুমি তো জানো অফিসে এত কাজের চাপ যে একটানা ছুটি পাওয়া মুশকিল। তবু তো বছরে একবার ছুটি নিতেই হয়। চাইলেই কি আর ছুটি পাবো তখন?”
“কোনওদিন কী তোকে এমন করে বলেছি? কেন যেন তোদের জন্য মনটা ক’দিন খুব ছটফট করছে। দ্যাখ না, যদি কোনওভাবে আসতে পারিস।”
সামান্য সময় নিয়ে কী যেন ভেবেছিল অর্চি। তারপর বলেছিল, “ঠিক আছে মা, দেখছি চেষ্টা করে।”
সুপ্রভা বলেছিলেন, “বৌমা আর দাদুভাইকেও সঙ্গে করে আনিস।”
খবর পেয়ে স্বামীকে নিয়ে বিনতাও এসেছিল। সঙ্গে ছেলে-মেয়ে। অর্চির সঙ্গে বৌ সুনন্দা, ছেলে আয়ুষ। সারা বাড়ি জুড়ে সে এক উৎসবের আমেজ। ঘুমিয়ে পড়া দৈত্যটা জেগে ওঠার মতো ঝিমিয়ে পড়া বাড়িটায় প্রাণ ফিরে এসেছিল হঠাৎই। সে জাদুর ছোঁয়ায় বুকের ব্যথাট্যাথাও উবে গিয়েছিল সুপ্রভার। সারাদিন হৈ-চৈ। নাতি-নাতনি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। তার ফাঁকে আবার নিত্য পুজো, কে কখন কী খেল না খেল সেদিকে খেয়াল রাখা। সন্ধ্যেবেলায় একফালি উঠোনটার মাঝখানে খেজুর পাতার মাদুর পেতে গোল হয়ে বসে সবাই মিলে আড্ডা জমানো।
খুশি হয়েছিলেন তমোনাশও। সেদিন অর্চিকে বলেছিলেন, “বয়স যত বাড়ছে, মনের জোরটাও আস্তে আস্তে আলগা হয়ে আসছে। যতদিন তোরা এ বাড়িতে ছিলি সারাদিন একটা হৈ চৈ লেগেই থাকতো। তুই চলে গেলি, বিনুরও বিয়ে হয়ে গেল। বাড়িটাও কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে পড়লো। এ যেন থাকতে হয় তাই থাকা। এ থাকায় কোন সুখ নেইরে।”
অর্চি বলেছিল, “তোমাদের তো কতবার বলেছি আমার কাছে চলে যেতে। এখানে থেকে কিছু একটা হয়ে গেলে কে দেখবে বলো তো? আমি খবর পেয়ে আসতে আসতেই তো হয়ে যাবে যা হওয়ার।”
সুনন্দা বলেছিল, “হ্যাঁ বাবা, এবার আর না করবেন না। আপনাদের যেমন ইচ্ছে হয় আমরা কাছে থাকি, আমাদেরওতো ইচ্ছে হয়। কীসের মায়ায় আর এখানে পড়ে থাকবেন বলুন তো? তারচে’ চলুন আমাদের কাছে। ওখানে জায়গাটা কিন্তু মন্দ নয়। চারপাশে কত বাঙালি। বুঝতেই পারবেন না বাংলার বাইরে আছেন।”
হেসেছিলেন তমোনাশ, “বাংলার এই যে হাওয়া, জল, গাছপালা, মাটির গন্ধ- এসব আর কোথায় পাবো বলো তো বৌমা? এই শেষ বয়সে এসে নাড়ির টান ছিঁড়ে ফেলার মতো সাহসও আমাদের নেই। তার চেয়ে মাঝে মধ্যে তোমরা এসে ক’দিন থাকলে, সময় করে আমরাও গিয়ে থেকে এলাম– এই বেশ।”
সুপ্রভাও সায় দিয়েছিলেন, “উনি ঠিকই বলেছে বৌমা। এতগুলো বছর এ বাড়িতে আছি। একে ছেড়ে যেতে মন চায় না। তাছাড়া ছেলে মেয়ে দু’টোর হাজারো স্মৃতি, ওদের ছেলেবেলা- সব তো এই বাড়িটাকে ঘিরেই। আজও চোখ বুজলেই ওদের শৈশবটা স্পষ্ট দেখতে পাই। বাড়িটাকে ছেড়ে গেলে সে সব স্মৃতিও যে হারিযে যাবে।”
সুনন্দা বলেছিল, “কিন্তু মা, একদিন তো সব ছেড়ে যেতেই হবে।”
কথাটা যে এত তাড়াতাড়ি সত্যি হবে কে জানতো। তমোনাশ নিজেও তো হালকাভাবেই নিয়েছিলেন কথাটা। সবাইকে তো একদিন যেতেই হয়। তাই বলে এভাবে? বৌমা কথাটা বলেছিল কাল সন্ধ্যেবেলায়। আর রাতেই কিনা…

দুই.

দাহ সেরে ফিরতে ফিরতে ওদের অনেকটা রাত। এতক্ষণ ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে একা একাই আকাশ দেখছিলেন তমোনাশ। এভাবে একা দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা হয় না কতদিন। অন্যদিন সুপ্রভা পাশে থাকেন। কত কথা হয়। আজ সারা ছাদ জুড়ে একরাশ নৈঃশব্দ্য। মালা এসে দু বার ডেকে গিয়েছে। তবু নামেননি তমোনাশ। শূন্য ঘরটায় সন্ধ্যেবেলাটুকু থাকতেই হাঁপিয়ে উঠেছেন। সুপ্রভার ফটোটা হাজারটা কথা বলে উঠেছে। এক অসহ্য রকমের কষ্ট তমোনাশের ভেতরটা ভেঙেচুরে দুমড়ে দিয়ে গেছে বারবার। শেষে থাকতে না পেরে উঠে এসেছেন ছাদে। রাত্রি যত বেড়েছে, নৈঃশব্দ্য ততই প্রকট হয়েছে। তমোনাশও হারিয়ে গিয়েছেন স্মৃতির অতলে। নুড়ি কাঁকড়ের ভেতর থেকে তুলে এনেছেন মুক্তকণা।
মালা এসে ডেকেছে, “অনেক তো রাত হল দাদা, এবার একটু শুতে চলো।”
আকাশের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে মালার দিকে তাকিয়েছেন তমোনাশ। বলেছেন, “কতই তো শোওয়া হলো। আজকের রাতটা না হয় না শুয়েই কাটালাম। আর শুলেই কি ঘুম আসবে?”
“সারাদিন এত ধকল গেল শরীরের ওপর দিয়ে, চোখ দুটো খানিক বুজে থাকলেও একটু ভালো লাগবে। ওরা এলেই তো আবার উঠতে হবে।”
তমোনাশ ঘাড় ঘুরিয়ে ফের তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। উত্তর দিকের আকাশে জ্বলজ্বল করা বড়ো তারাটার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “এতক্ষণে মনে হয় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সুপ্রভা। ওই তারাটাকে যেমন তাকালেই দেখা যায় অথচ ধরাছোঁয়ার কত বাইরে। তেমনি আজ থেকে সুপ্রভাকেও ইচ্ছে হলেই মনে মনে দেখতে পাবো, অথচ ছুঁতে পারবো না কোনদিন। ওই তারাটার মতই দূরে চলে গেছে সে।”
“এসব ভেবে আর লাভ কী দাদা। এতে নিজেই কষ্ট পাবে।”
তমোনাশ বলেছিলেন, “তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো, আমি আরেকটু থেকে আসি। ঘরে থাকতে বড়ো অস্থির লাগছে। এত বড়ো নৈঃশব্দ্য আমি সহ্য করতে পারছি না।”
আর জোরাজুরি করেনি মালা। কেবল নামতে নামতে বলে গিয়েছিল, “কার্তিকের হিম শরীরে বেশি না লাগানোই ভালো। এমনিতে দুর্বল মন, তার ওপর শরীরটাও যদি দুর্বল হয়ে পড়ে—”
চলে গিয়েছিল মালা। তমোনাশের একবার ইচ্ছে হয়েছিল নেমে আসতে। পারেননি। চারপাশে স্মৃতির এত ভীড়, তা ঠেলে সরিয়ে পথ করতে পারেননি তমোনাশ। কার্তিকের হালকা কুয়াশায় চারিদিকে কিছুটা হলেও ঝাপসা হয়ে এসেছিল। আকাশের তারাগুলোকে মনে হচ্ছিল সন্ধ্যারাতের থেকে অনেকটাই নিষ্প্রভ। অথচ সুপ্রভার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন তখনও।
কী ছিল ওই মুখে কে জানে। নামতে ইচ্ছে হয়নি তমোনাশের। সুপ্রভার সঙ্গটা একদম নিজের করে পেতে চাইছিলেন আরও কিছুটা সময়। আকাশের গায়ে ছড়িয়ে পড়া হালকা কুয়াশার আস্তরণ ক্রমশ ভারী হয়ে নেমে এসেছিল অনেকটা নিচে। কার্তিকের উত্তুরে শিরশিরে হাওয়াটা ছড়িয়ে দিচ্ছিল বেশ একটা হিমের আভাস। তাও দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।
তারপর এক সময় হেডলাইটের চোখ ধাঁধানো তীব্র আলো জ্বেলে অর্চিদের গাড়িটা গেটের মুখে শব্দ করে থামতে ভেতরের মগ্নতা ভেঙে নেমে এসেছেন তমোনাশ। কত রাত হল কে জানে। একবার তাকালেন দেওয়াল ঘড়িটার দিকে। দু’টো পেরোতে চলল। কাল ঠিক এ সময়েই- ভাবতে পারলেন না তমোনাশ। এতগুলো বছরের অখণ্ড দাম্পত্য। এত সুখ, এত ভালোবাসা একটা রাতেই এভাবে শেষ হযে যাবে- ভাবতে বড়ো কষ্ট হয়। সুপ্রভা বলতেন, “এত ভালোবাসো আমায়, তোমায় রেখে কী করে যাবো বলো তো?”
কথাটাকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না তমোনাশ। বলতেন, “তুমি কেন যাবে? যাবো তো আমি। তোমার থেকে না হলেও অন্তত বছর সাতেকের বড়ো কি না। কতটা পথ এগিয়ে আছি একবার ভাবো তো।”
বয়সে এতটা ছোট হয়েও আগে আগে চলে গেল সুপ্রভা। এ যে কত কষ্ট তমোনাশের। ‘‘যাওয়ার কি আর সময় হয়েছিল? আরও তো কিছুদিন থেকে যেতে পারতো” ভাবলেন তমোনাশ। ওদিকে গেট খোলার শব্দ। মালাই খুলে দিয়েছে। তার মানে সেও এতক্ষণ জেগেই ছিল। আত্মীয়তা কি কেবল রক্তের সম্পর্ক দিয়েই হয়? কই মালার সাথে তো তেমন কোনও সম্পর্ক নেই এ বাড়ির। তাহলে কীসের এত টান? কীসেরই-বা কষ্ট?
পুরোটা না হলেও কিছুটা বুঝতে পারেন তমোনাশ। এ-ঘাট ও-ঘাট ঘুরে যখন এ বাড়িতে এসে উঠেছিল মালা, তখন সুপ্রভাই আশ্রয় দিয়েছিলেন তাকে। কথাটা মালা ভোলেনি কোনওদিন। আর তাই প্রায়ই বলতো, “তোমরা আশ্রয় না দিলে কী যে হতো আমার। ঘাটে-ঘাটে ঘুরে বেড়াতাম আর সাত শেয়ালে ছিঁড়ে খেত। যদি কোনওদিন তাড়িয়ে দাও, আমি ভেসে যাবো।”
এ-কথায় রাগ করতেন সুপ্রভা। বলতেন, “বারবার কেন একথা বলিস বল দেখি? বাড়িটাকে নিজের ভাবতে পারিসনে?”
কাজের মেয়েকে ক’জন পারে এ কথা বলতে? সুপ্রভা পেরেছিলেন। আর সে জন্যেই তাঁকে এতটা ভালোবাসতে পেরেছিল মালা। তার চলে যাওয়াটা ভীষণভাবে আঘাত করেছিল বুকে। তাইতো শেষরাতে সুপ্রভার শরীরটা জড়িয়ে ধরে সেই যে কেঁদে উঠেছিল, চব্বিশটা ঘণ্টা পেরিয়েও নীরবে কেঁদেই চলেছে। সারাদিন তার চোখের দিকে ভালো করে প্রায় তাকাতেই পারেননি তমোনাশ। তাকাতে গেলে নিজের বুকেই মোচড় দিয়ে উঠেছে এক অসহ্য রকমের কষ্ট।
সুপ্রভার কথায় তমোনাশ একদিন বলেছিলেন, “আচ্ছা, ধরো তুমি আগে চলে গেলে। তাহলে আমার কী হবে একবার ভেবেছো? মেয়ের বিয়ে হয়ে চলে গেছে, ছেলেটাও অত দূরে।”
সুপ্রভা বলেছিলেন, “তাতে কী, মালা তো রয়েছে। কিবা এমন কাজ। ঘর-দোর, জামা-কাপড় পরিষ্কার রাখা। দু বেলা রান্না। এটুকু সে ঠিকই পারবে।”
ভাবতে ভাবতে ফের একবার হারিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন তমোনাশ। চারিদিকে নিকষ আঁধারের মাঝে এক চিলতে সরু আলোর রেখা। সেই রেখায় কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছে জীবন্ত অতীত। তারা কী এক আকর্ষণে শুধুই টানছে।
পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগেই নৈঃশব্দ্যটা ভেঙে গেল। মগ্ন মুহূর্তটাও হারিয়ে গেল অমনি। ঘরে ঢুকে বাবাকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে উঠলো বিনতা। বুকের মধ্যে একবাটি রক্ত ছলকে উঠলো তমোনাশের। মেয়ের মাথায় হাত ছুঁইয়ে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দেখলেন ভাষাগুলো হারিয়ে গেছে। হাতড়ে খুঁজতে গিয়ে কেবল নুড়ি-কাঁকড়ই উঠে এল। কিছু বলতে পারছেন না তমোনাশ। কী বলবেন? “কাঁদিসনে মা, আমি তো আছি।” হ্যাঁ, তিনি আছেন। কিন্তু মায়ের মমতা কি একজন বাবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব? কোনো আপন জনের শূন্যস্থান কী অপর জনকে দিয়ে পূরণ করা যায়?
ব্যাপারটা আন্দাজ করেই হয়তো আনন্দ এসে সরিয়ে নিল বিনতাকে। বলল, “কী করছো বিনু? এত করে বুঝিয়ে এলাম, আর এসেই নিজের কথাই ভাবছো? বাবার কথাটাও তো একবার ভাববে।”
কিছুটা শান্ত হল বিনতা। তবে সেটা বাইরে। ভেতরে ভেতরে ঠিক কেঁদে চলেছে। অর্চির চোখেও জল, ছেলে মানুষ গলা ছেড়ে কাঁদতে পারে না সে জন্যই কষ্টটা বোধ করি বেশি। চোখ দু’টো জবা ফুলের মতো লাল এবং অনেকটা ফুলে উঠেছে। তমোনাশের বুকে ফের একবার চিড়িক দিয়ে উঠলো যন্ত্রণা। কিছু বলা প্রয়োজন মনে করেই বললেন, ‘‘তোদের কষ্টটা বুঝি। যতই দূরে দূরে থাকিস, তবু মা তো। নাড়ির টান কী আর মুছে যায় রে। কিন্তু কী আর করবি বল। বাবা-মা তো চিরকাল কারও বেঁচে থাকে না। মেনে নিতে হয়। আমরাও নিয়েছি। এই আমি- আমিও কী আর খুব বেশিদিন থাকব। এলে যেতে হবে- এই তো জগতের নিয়ম। একে উপেক্ষা করা যায় না। বরং ওসব না ভেবে এখন সামনের দিনগুলোয় কীভাবে কী করা যায় ভাব। অনেক লৌকিকতা আছে। জানি ওসব কিছু নয়। তবু- “

তিন

সন্ধ্যেবেলার আবছায়া ভাবটা গাঢ় হয়ে এখন বলা চলে পুরোপুরি রাত্রি। দু’দিন হল কার্তিক শেষ হয়ে অঘ্রাণে পড়েছে। এরই মধ্যে বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে শীত। কে বলবে এটা হেমন্তের মাঝামাঝি। শীত এ বছর আগে-ভাগেই জায়গা দখল করে নিয়েছে। বর্ষা খুব বেশিদিন স্থায়ী না হওযাতেই বুঝি এই। বেলা হেলে পড়তেই উত্তুরে হাওযার টান শুরু হয়।
সন্ধ্যের অনেক আগেই গা ঢাকতে হয় গরম জামা কাপড়ে। তার ওপর মনটাও ভালো নেই তমোনাশের। আর মন ভালো না থাকা মানেই প্রকৃতির থাবা বেশি করে আঁচড় কাটে শরীরে। গরম জামা-চাদরে শরীরের প্রায় সবটুকু মুড়ে চেয়ার নিয়ে উঠোনেই বসে আছেন তমোনাশ। ঘরে যেতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না। একদিকে লোডশেডিং, তার ওপর সারা ঘরজুড়ে সুপ্রভার স্মৃতি। ভাসা ভাসা স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে যখন তখন। অবশ্য তিনি একা নন। মেয়ে-জামাই, ওদের ছেলে, মেয়ে- ওরাও বসে আছে একটু তফাতে। রান্নাঘরে মালার উপস্থিতির আওয়াজ। কিছু একটা কড়াইতে দিল। বেশ একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পেলেন তমোনাশ। ঘাড় কাৎ করে একবার তাকালেন আকাশের দিকে। কুয়াশামাখা তারাদের দৃষ্টি অনেকটাই ম্রিয়মান। যেন বৃদ্ধ বয়সের ঋজুতা ওদের শরীরে। ফের মনে পড়লো সুপ্রভার কথা। এক-একদিন এমনই কুয়াশাভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন। শীতের তারারা গায়ে কুয়াশার ভার নিয়ে নেমে আসতো অনেকটাই নিচে। তাদের দিকে তাকিয়ে ছেলেমেয়েদের মুখটাই যেন দেখতে পেতেন স্পষ্ট। অন্যদিকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলতেন, “দ্যাখো, দ্যাখো, ওই হচ্ছে অর্চি। আর ওই, ওই যে কোণের দিকে জ্বল জ্বল করছে যে বড়ো তারাটা, ওটাই আমার বিনু। দূরে আছে জন্যেই ওদের এমন ঘোলাটে লাগছে।”
আলতো করে গায়ে টোকা দিতেন তমোনাশ, “তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেল সু? কী সব যা-তা বলছো? ওরা তারা হতে যাবে কেন? আরে তারাদের কী কখনো ছোঁয়া যায়?”
চমকে উঠে বাস্তবে ফিরে আসতেন সুপ্রভা। এই মূহূর্তে বাস্তবে ফিরে এলেন তমোনাশও। কারেন্ট আসাতেই শব্দ করে উঠেছে অর্চি, বিনুর ছেলেমেয়েরা। বিনতাও চেয়ার নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আনন্দ এসে ডাকলো, “বাবা ঘরে চলুন। এভাবে আর ঠান্ডা লাগানো ঠিক হবে না।”
পিঠটাকে সোজা করলেন চেয়ারে। তারপর তমোনাশ বললেন, “তোমরা যাও, আমি আসছি।”
এতক্ষণে বিনতাও এগিয়ে এসেছে, “না বাবা, বাইরে আর একদম নয়। শরীরের দিকে এবার একটু বেশি করে নজর দিও। মা তো তা না করেই…”
কথাটাকে শেষ করলো না বিনতা। সুপ্রভা মারা যাওয়ার পর থেকেই এমনটা হয়েছে। মায়ের কথা বলতে গিয়ে শেষ করে না মেয়েটা। কিংবা হয়তো শেষ করতে পারে না। বাষ্পায়িত একটা কষ্টে গলাটা রুদ্ধ হয়ে আসার আগেই থেমে যায়।
ঘরে এসে বসতে না বসতেই সামনে এসে দাঁড়ালো অর্চি। অশৌচের কারণে মুখে ক’দিনের শেভ না করা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় এলোমেলো চুল। হাতে সাদা কাগজে লেখা নিমন্ত্রিতের লম্বা তালিকা।
ছেলেমেয়ে দুটো সামনে এসে দাঁড়ালেই কষ্ট হয় তমোনাশের। শোকের ঝড়টা ভেতরে ভেতর ওদের যা ক্ষত-বিক্ষত করে গেছে তা বাইরে থেকেও দেখতে পান তমোনাশ। অথচ এখনই এতটা শোক পাওয়ার কথা ছিল না ওদের। বাবা হয়ে সন্তানের এত কষ্ট দেখা যে কত যন্ত্রণার।
ছেলের দিকে তাকালেন তমোনাশ, “কিছু বলবি?”
সাদা কাগজে লেখা তালিকাটা সামনে এগিয়ে দিয়েছে অর্চি, “হ্যাঁ বাবা, দ্যাখো তো কেউ বাদ গেল কি না। নিমন্ত্রণ মোটামুটি শেষ বলা যায়। যা বাকি আছে কালকের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে। সময়ও তো বেশি নেই আর।”
অর্চির হাত থেকে তালিকাটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন তমোনাশ। পারিবারিক আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, অর্চি-আনন্দর অফিস স্টাফ মিলিয়ে তিন শর কাছাকাছি। তার ওপর পাড়ায় প্রায় এক শ। ইদানীং এ পাড়ায় কারও বাড়িতে কিছু হলেই তমোনাশ, সুপ্রভাকে বলে যেত। বাদ যেত না মালাও। নিজের বাড়িতেও তাই সবাইকে বলা তমোনাশের কর্তব্য।
অর্চি জিজ্ঞেস করলো, “ঠিকঠাক আছে তো সব?”
কাগজটা অর্চির হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে তমোনাশ বললেন, “ক্লাবের ছেলেদের আলাদা করে একবার বললে হতো না? সময়-অসময়ে ডাকলেই পাওয়া যায় ওদের। তাছাড়া আমাকে খুব সম্মানও করে ছেলেগুলো। পুজোমণ্ডপ, ফাংশান, খেলার মাঠ- সবেতেই আমাকে সামনে রাখে ওরা। এত কাজ- দেখাশোনার জন্যেও তো লোক দরকার। তাই বলছিলাম…”
অর্চি বলল, “এত কিন্তু কিন্তু করছো কেন বাবা? পাড়ার ক্লাব, আলাদা করে বলাই তো উচিৎ। ভুলটা আমারই। ও-নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। কালই আমি বলে আসবো ওদের। আর দেখাশোনার ভারটাও ওদের ওপরই ছেড়ে দেবো।”
বলতে বলতে চলে যাচ্ছিল অর্চি। ফের ডাকলেন তমোনাশ।
“কিছু বলবে বাবা?”
মাথার মধ্যে কী সব ভাবনারা ঘুরে বেড়াচ্ছে এলোমেলো। তাদের একটা জায়গায় দাঁড় করানোর ক্ষমতা তমোনাশের নেই। উপড়ে-পড়া গাছের মতো তিনি নিজেই আজ অর্ধমৃত। ছেলেকে কেন যে ডাকলেন, নিজেই জানেন না। তাই বললেন, “আমার কাছে একটু বসবি?”
আরেকটা চেয়ার টেনে বসলো অর্চি, “বলো।”
“বলছিলাম এতদিন আছিস, অফিসে কোনো সমস্যা হবে নাতো?”
“না না, ফোন করে দিয়েছিতো।”
“বলছিলাম যদি তেমন সমস্যা না থাকে আর কিছুদিন থেকে যাবি?”
কিছুটা অবাক হল অর্চি, “কেন বলো তো?”
“না মানে তোরা চলে গেলে বাড়িটা একদম শূন্য হয়ে যাবে। এত বড়ো শূন্যতায়…”
“তোমায় তো কতবার করে বলেছি আমার কাছে চলে যেতে। মা নেই, আর কেন পড়ে থাকবে বলো তো?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মাথা দোলালেন তমোনাশ, “না রে, আর তা হয় না। তোর মা চলে গেলেও এ বাড়ির সর্বত্র তার স্মৃতি লেগে আছে। আমার সাধ্য নেই সেই স্মৃতি মুছে ফেলার। তোর মাকে হয়তো আর পাবো না। কিন্তু তার স্মৃতি নিয়ে তো বাঁচতে পারবো।”
“কিন্তু বাবা-”
“না রে, এ নিয়ে আর জোর করিস নে। তাছাড়া মালার কথাটাও একবার ভাব। সেই কবে থেকে এ বাড়িতে আছে। ছোটবেলা থেকে সে-ই তো কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে তোদের। ওকে আজ যদি একলা ফেলে আমি চলে যাই, কার কাছে গিয়ে উঠবে সে? সময়ের স্রোতে এতদিনে কোথায় ভেসে গেছে ওর সব কিছু। কিছুই আর পড়ে নেই। তোর মায়ের স্মৃতি, তোদের ছোটবেলা- এসব নিয়ে বেশ কাটিয়ে দিতে পারবো। তাছাড়া মালা তো রইলোই। বুড়ো মানুষটাকে দু-বেলা দু-মুঠো রান্না করে দেওয়া- ঠিকই সে পারবে।”
কোথায় যেন একটা কষ্ট অর্চির। এ কষ্টটা কেবল মা-কে হারানোর নয়। এ কষ্ট বাবাকে নতুন করে আবিষ্কারের কষ্ট। সে জন্যেই প্রশ্নটা করতে ইচ্ছে হলো তার। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করবো বাবা?”
ছেলের দিকে তাকালেন তমোনাশ, “বল না।”
“মা কে খুব ভালোবাসতে, তাই না?”
অসহ্য রকমের কষ্টটা ফের একবার আটকে গেল গলার কাছে এসে। বাইরেটা শক্ত করতে গিয়ে তমোনাশ দেখলেন ভেতরটা ভেঙেচুরে দুমড়ে যাচ্ছে।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field