তীরন্দাজ নববর্ষ সংখ্যা
দিনের শুরুটা, মাসের বাকি উনত্রিশ দিনের মতোই ফ্যাসফ্যাসে রসহীন কষকষে আবহে শুরু হলেও রাতটা কেটেছিল অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোরের অন্যরকম আনন্দের এক চঞ্চল চড়ুই ছুটে বেড়ায় জলিল সাহেবের সারা শরীরজুড়ে, যা তার মন ও মগজে এখনও গেঁথে আছে।
একটু আয়েশ করে শোয়ার জন্য বাঁ-কাত থেকে ডান-কাতে মোড় নেয়ার সময় বাঁ-দিকের মাড়ির শেষ প্রান্তের দাঁতটা টনটন করে ওঠে। হয়তো গতকাল রাতের বাসি কোনো খাবারের টুকুরো আটকে আছে। আটকানোর কথা শুনলেই তার মনটা ফুরফুরিয়ে ওঠে। আজ খেয়াল করলেন আটকালে টনটনে ব্যথাও হয়। দাঁতের টনটনে ভাবটা একটু নিরাময়ের জন্য মুখের ভেতরের মাংসল অঙ্গটাকে খুঁজে, অনুভবে টান পড়ে, বিপত্তিটা সুপ্ত থেকে জাগ্রত হয়। লাফিয়ে ওঠেন ঘুম থেকে…
সামথিং মিসিং! মিসিং মানে উধাও!
কিন্তু উধাও বিষয়টা তো তার জন্য নতুন কিছু না, সরকারি অফিসে অনেককিছু উধাও হয় ৷ একটা সময় আবার হাওযায় মিলিয়ে যায়। মেলাতে হয়, নিজের স্বার্থে, অনেক সময় বসদের স্বার্থে। এ আর নতুন কি?
কিন্তু, এটা কি হলো!
আতঙ্কে চিৎকার করতে গিয়ে পরিস্থিতি, বিষয়কর্ম আরো পরিস্কার হয় জলিল সাহেবের কাছে। ওদিকে চিৎকার থেকে অর্থবহ কোন শব্দ বের হয় না। আরও অস্বাভাবিক লাগে সবকিছু। তাড়াহুড়ো করে খাট থেকে নামতে গিয়ে দুই পায়ের মাঝে বিশেষ অঙ্গটা খাটের শক্ত ডাসার সঙ্গে কিঞ্চিৎ কোলাহল বাঁধিয়ে ফেলে। ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠেন, কিন্ত উঠলে কি হবে, ব্যাথা অনুভবের শব্দটাও তার কান অব্দি পৌঁছায় না। নরম, মাংসল অঙ্গটির অভাবে সঠিক অর্থপূর্ণ শব্দ তরঙ্গটি তিনি বাতাসে খেলাতে পারেন না।
কিন্তু যন্ত্রণাটা মুখে সুস্পষ্ট ছাপ ফেলে দেয়। রাগে গজগজিয়ে একটু খুঁড়িয়ে স্ত্রীকে খুঁজতে শোবার ঘর থেকে বের হতেই চোখ নামক সিসি ক্যামেরাটা বুয়ার ঢেকে রাখা সম্পদে আটকে যায়। আহ…
ওমনি গজগজিয়ে ওঠা রাগটা নিমিষেই জল হয়ে বুয়ার কপালে জমে থাকা ঘামের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। লাউ গাছের তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা কচি ডগার মতো এই মেয়েটাকে দেখলে তার সারাটা দিন বেশ রসালো কাটে। পশ্চাৎদেশের ডান বামের দোলা, আড়ালে লুকিয়ে রাখা সৌন্দর্য গুপ্ত সুখের উল্লাসটাকে ক্ষুধার্ত করে তোলে। হরহামেশাই তিনি এই সৌন্দর্য দেখেন স্ত্রীর আড়ালে।
তিথি, তিথি… (জলিল সাহেবের সহধর্মিণী)
ডেকে ডেকে গলা ব্যথা করেন, কিন্তু কোন সদুত্তর পায় না, পাবো কীভাবে! কোন অর্থপূর্ণ শব্দ তো বের হচ্ছে না। ব্যাপারটা পুরোপুরি বোঝার জন্য আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বোয়াল মাছের মতো হাঁ করতেই ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হয়, জিহ্বা গায়েব হয়ে গেছে! চিৎকার করতে গিয়ে পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেন জলিল সাহেব। এই দেশে তো কতকিছুই উধাও হয়, কখনো ম্যানহোল, কখনো ফাইল, কখনো দলিল, কখনও টাকা। হরহামেশা মানুষজন উধাও হয়,পত্রিকার পাতায় বেশ বড় হেডলাইনে তাজা সংবাদগুলো প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে সেই খবরগুলো বাসি পচা হয়ে একটা সময় হারিয়েও যায়। তারপরে আবার নতুন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত হয় এই সদাব্যস্ত নগরবাসী। সেগুলোর মাঝে এটাতো সামান্য জিহ্বা গায়েব। দাঁত আছে, সেটা ভেবে শুকরিয়া আদায় করেন। অন্তত দাঁত দিয়ে কেটেকুটে কিছু খাবার তো খাওয়া যাবে, কিন্ত গিলতে যে জিহ্বার দরকার পড়ে!
তখন?
জুস,পানি দিয়ে না হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়। জিহ্বা ছাড়া তো কথা বলা যাবে না। অফিস তো কথার কারবার।
ফাইল লুকানোর কাজ না হয় ইশারা ইঙ্গিতে করা যায়। কিন্তু সেই ফাইলের লগ্নিকারিদের সাথে কথোপকথন, সেগুলো কথা না বলে করা অসম্ভব। অফিসের অন্য কাজও তো আছে। হাজারটা ভাবনা তাকে ঘিরে ধরে। বেগতিক দশা এড়াতে, সকালের নাস্তা না করেই ছোটে ডাক্তারের কাছে। ইশারা ইঙ্গিতে সবাইকে বোঝায়, তিনি অঙ্গ হারা সঙ্গিন এখন। ডাক্তার তার সমস্যার কথা শুনে চোখ দুটো কপালে তুলে ফেলেন। অনেকটা সময় পরীক্ষা করে বললেন, এটি তো খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। মেডিক্যাল ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। আপনাকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে। কথাটা শুনে ডাক্তারের উপর প্রচণ্ড রেগে যান জলিল সাহেব। অনুভব করেন, রাগটা ফোঁস ফোঁস করে তার কান দিয়ে বের হচ্ছে। মনে মনে ভাবেন,অফিসে গিয়ে সহকর্মীদের কি বলবেন? তারা কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে? এই ভাবনার মাঝে অফিসে পৌঁছে যান। অফিসে পৌঁছে পকেটের রুমালটি দিয়ে মুখটা ঢাকতেই, চারপাশ থেকে বজ্রপাতের মতো হাসির শব্দগুলো সামনে এসে হোঁচট খায়। পাশের টেবিলের সহকর্মী জানায়, বস তিনবার ডেকেছেন। সরু চোখে বাঁকা চাহনিতে তাকায় জলিল সাহেবের দিকে। দেরির কারণ জানতে চায়। কেননা দু’জনেই এই অফিসের মাসতুতো ভাই, সামনের অংশটুকু সবাই জানে।
জলিল সাহেব সরু চোখের বাঁকা চাহনির দৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে স্যারে সামনে গিয়ে দাঁড়ান।
কী হলো,? মুখে কাপড় কেন?
পাশ থেকে একজন রসিকতা করে বলে ওঠেন, নতুন জামাই মনে হয়।
মুখ থেকে খারাপ বাণী বের করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সাময়িক রূপবদলের কারণে শব্দগুলোকে নীরব রাখেন । ইশারায় বসকে বলেন, জিহ্বা গায়েব। তার মাথা মোটা বস ইশারার ভাষা বুঝতে পারেন না। বরাবরের মতো গলা চড়িয়ে বলেন…
রসিকতা করছেন? নাকি মাথার সমস্যা?
জলিল সাহেব রেগে যান। নীরবে নখ দিয়ে চেয়ারের পুটিং খোটাখুটি করেন। চেয়ারের ছিঁড়ে যাওয়া কাপড়টা আরো একটু ছেঁড়ার চেষ্টা করেন আর ভাবেন, কীভাবে দুর্বোধ্য বিষয়টা বোধ্য করবে হাঁটুতে বুদ্ধি রাখা এই লোকটার। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিটে যায়, তিনি ভাবেন, মিনিট গড়িয়ে ঘণ্টা যায়, তিনি ভাবেন। পুরো অফিসের চুয়ান্নজন সহকর্মীর চুয়ান্ন জোড়া চোখ তখন তার পানে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো তাকিয়ে। খাবি খেয়ে ভাবতে থাকেন কেন এমনটা হলো? কোনো বিশেষ ফাইল লুকানোর কারণে কি এমনটা হয়েছে? ঘটনার পেছনে কি কোনো গোপন রহস্য আছে?
মাথায় হাত রেখে টেবিলে ঝুঁকে পড়েন জলিল সাহেব।
সারাদিনে ভাবনার তাঁর ছিড়ে বিকেলের দিকে হঠাৎ তার মনে পড়ে, গতকাল অফিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তিনি লুকিয়েছিল, সেটার কারণে কি এমন কিছু ঘটেছে? ফাইলের ভেতরে এমন কি আছে যার কারণে তিনি এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। মনে মনে সেই ফাইলটা উদ্ধার করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
সন্ধ্যায় অফিসের সবাই চলে গেলে, আবারও অফিসে ঢুকে পড়েন অনেকটা সতর্কতার সঙ্গে, একা-একাই সেই ফাইলটা খুঁজে বের করেন বসের টেবিল থেকে। অতি আনন্দে ফাইলটা তাড়াহুড়ো করে খুলতে গিয়ে দেখেন, একটি কাগজে লেখা আছে, যদি সত্য লুকাতে চাও, নিজের জিহ্বা হারাও। হঠাৎ পিছন থেকে অফিসের বিগ বস এসে পিঠে চপেটাঘাত করেন আর জলিল সাহেব চমকে লাফিয়ে ওঠেন।
উঠে দেখেন ছোট মেয়েটা জো্রে জোরে চিৎকার কারে তাকে ডাকছে, ও বাবা সকাল সাতটা বাজে, ওঠো, অফিসে দেরি হয়ে যাবে তো…
জলিল সাহেব কিছু সময় বিভ্রান্ত হয়ে শুয়ে থাকেন। এতটা সময় তিনি কী স্বপ্ন দেখেছেন! কিন্তু কেন? এমন কিছু কি ঘটবে! ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় যান, ততক্ষণে সাদামাটা মেঘ ও রোদের আবহের মাঝে সংসারিক আবহ ঢুকে পড়েছে। সকালটা তার লেজেগোবরে হয়ে যায়। চুপচাপ মাথা ঠান্ডা করে রোজকার কাজে মন দিতেই বুয়ার সঙ্গে বৌয়ের চিৎকার চেঁচামেচি কানে আসে। এ আর নতুন কিছু নয়, রোজকার রুটিন। জলিল সাহেব ওদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে রুটিন মাফিক কাজে মন দেন। তাছাড়া এই স্বপ্নের কথাটা আজ অফিসে গিয়ে সবাইকে আরও রসালো করে কিভাবে বলা যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকেন।
Leave feedback about this