তীরন্দাজ নববর্ষ সংখ্যা
বাড়িটা নিঝুম। সন্ধ্যার ছায়া ছায়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একাকী ভিজছে| কাঁদছে কি? কার শোকে? না কি আমারই কল্পবিলাসী মন বৈশাখের এই ছায়াঘন অন্ধকারে বাড়িটাকে অচিন কোনো শোক-সায়রে কল্পনা করে ভাসতে চাইছে বিষণ্ণ এক বোধে? একটু আগের ঝুম বৃষ্টিটা ধরে এসেছে প্রায়| হালকা বাতাস বইছে, দারুণ শীতল| গ্রীষ্মের খরতাপে পুড়তে থাকা প্রকৃতি ভীষণ শান্ত এখন, শ্রান্ত| সারাদিন গ্রীষ্মের রুদ্ররোদ্দুরে অঙ্গার হয়েছে, দারুণ গরমে সেদ্ধ হয়েছে যে, সেটা এই মুহূর্তে তার শ্যাম,শান্তশ্রী দেখে বিশ্বাস করা শক্ত| ঝুম বৃষ্টির সাথে হালকা ঝড়ে বিদ্যুৎ গেছে সেই সন্ধ্যার শুরুতেই| গাঢ় মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে বাড়িটাকে প্রাগৈতিহাসিক লাগছে এখন, আধিভৌতিক| টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে এখনো, বাড়িটাকে ঘিরে রাখা ইটরঙা, খয়েরি প্রাচীর ভিজে কালচে হয়ে গেছে অনেকটাই| সন্ধ্যার অন্ধকারে তাকে আলাদা করে আর চেনাই যায় না প্রায়| সারাদিনের কর্মক্লান্তিতে দ্বাররক্ষী গেটে ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে তার নির্ধারিত ছোট্ট কামরাটায় ঢুলছে কাঠের টুলে বসে| উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখা গেল একপলক| সস্তা একটা টিমটিমে চার্জার লাইট জ্বলছে| চার্জ ফুরিয়ে এসেছে, যে কোনো মুহূর্তে নিভে যাবে দুম করে| মাথার ওপর মেলে রাখা ছাতাটা একদিকে কাৎ করে লোকটাকে মৃদুস্বরে ডাকতেই চমকে তাকাল, চোখ লাল, মুখে বিরক্তির রেখা এই স্বল্প আলোয়ও স্পষ্ট পড়া যায়|
কী চান? ছয়টার পরে গেট বন্ধ| কারো ভিতরে ঢোকা নিষেধ এখন|
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে লোকটা নিজের কাজে মন দেয় আবার| উটকো ঝামেলায় তার আগ্রহ নেই একদম, বোঝাই যায়|
একটু এদিকে আসবেন, ভাই? একটা দরকার ছিল!
কী দরকার? লোকটার ঝাঁঝাল কণ্ঠে উৎকট সন্দেহ|
আমাকে হাসিব ভাই পাঠিয়েছেন| আপনার পরিচিত তিনি|
কে পাঠিয়েছেন?
হাসিব ভাই| যশোরে বাড়ি| চেনেন?
ম্যাজিকের মতো কাজ হয় এবার| লোকটা প্রায় ছুটে বের হয়ে আসে তার ছোট্ট ডেরা থেকে| চার্জার লাইটের প্রায় নিভে আসা আলো আমার মুখে ফেলে বোঝার চেষ্টা করে ঘটনা| ব্যাকুল হয়ে বলে, হাসিব ভাইয়ের কে হন আপনি? আর রাতে কেন এসেছেন?
হাসিব আমার বন্ধু| এসেছিলাম দিনেই| পথে ঝড়ের জন্য দেরি হয়েছে| আপনি হাসিবের সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলে নিন|
হাসিবকে ফোনে লোকটাকে ধরিয়ে দিয়ে আবার বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা বাড়িটার দিকে নজর দেই আমি| নিঃসঙ্গ বাড়িটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী করুণ, অসহায়ভাবে ভিজছে| আমার কেবলই মনে হয়, বাড়িটা কাঁদছে| তার চোখ বেয়ে ঝরছে অঝোর শ্রাবণ| বাড়িটার দিকে তাকিয়েই আমার মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর বইটার নাম মনে পড়ে গেল| বাড়িটা যেন এই নামের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা|
হাসিবের সঙ্গে কথা শেষে দ্বাররক্ষী লোকটার ব্যবহার আমূল বদলে গেছে ততক্ষণে| আমাকে সে কোথায় বসাবে, কী খাওয়াবে, সেই ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ভীষণ| সহসাই নিরস্ত করি আমি তাকে| হাসিব পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তার কথায় বাঘে-মহিষে একঘাটে জল খায়, দ্বাররক্ষী লোকটাকে চাকরি সে-ই দিয়েছে, লোকটা তার দূরসম্পর্কের আত্মীয়, নাম বদরুল| বদরুল সম্ভবত আমাকেও হাসিবের মতো কেউকেটা কেউ একজন ভেবে নিয়েছে, যদিও পরনের ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কাঁধের ঝোলা ব্যাগ দেখে সে খানিক পরপরই সন্দিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে|
বদরুল!
জি স্যার!
আমি আজ এই বাড়িটাতে সারারাত থাকব| সকাল হলেই চলে যাব| কেমন?
কিন্তু স্যার, এইখানে তো রাতে কারো ঢোকা নিষেধ| রাতে কারো এখানে থাকার অনুমতি নেই| বহিরাগতদের জন্য বিকেল ছয়টায় গেট বন্ধ করে দেয়ার নিয়ম|
মাথা চুলকে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো প্রায় মুখস্থ বলে যায় বদরুল| তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার হঠাৎ ভীষণ হাসি পেয়ে যায়| দম দেয়া কলের পুতুল দেখতে কেমন? এই মুহূর্তের বদরুলের থেকে কী আলাদা খুব? না সম্ভবত| প্রয়োজনীয় নির্দেশনাটুকু হাসিব ওকে দিয়ে দিয়েছে, আমি জানি| আর হাসিবের কথার চেয়ে বড় আইন বদরুলের কাছে নেই, সে-ও বদরুলের এতক্ষণের ব্যবহারে স্পষ্ট| তবু লোকটা তার নিত্যকার অভ্যাসবশে খানিকটা গাঁইগুই করে, দম দেয়া পুতুলের মতো বলে যায় মুখস্থ বুলি| তার মুখের ওপর চোখ রেখে আমি অন্য কিছু ভাবি| অনেক অনেক বছর আগের কথা ভাবি| এই বাড়িটা সেদিনও কি এমনই ছিল? এমনই শান্ত, নিঝুম? শতবছর আগের এই জনপদ, এই আকাশ, এই সন্ধ্যার ছায়া ছায়া অন্ধকার, বৈশাখী ঝড়ো হাওয়া, এমনই ছিল সব? না কি আরো শান্ত, আরো নিঝুম, আরো ঢের বেশি প্রাণ বিবশ করা, মন উতল করা ছিল এইসব জল-হাওয়া, ঘর গেরস্থালি? এই অজপাড়াগাঁ এখন অনেক অগ্রসর, পথঘাট উন্নত, বিজলি বাতিতে আলোকিত, জনজীবনে লেগেছে সভ্যতার স্বাস্থ্যকর হাওয়া| কিন্ত সেই সময়ে, সেই একশ-দেড়শ বছর আগে, কেমন ছিল এই জনপদ? যানবাহন বলতে ছিল গরু বা ঘোড়ার গাড়ি, পালকি, আর ছিল মানুষের আদি ও অকৃত্রিম বাহন পা| ছিল নৌকা | ট্রেনও ছিল বৈ-কি| সে এখান থেকে ঢের দূরে| কয়েক ক্রোশ পথ জল-কাদা মাড়িয়ে, পায়ে হেঁটে, তবে যেতে হতো নিকটস্থ রেলস্টেশনে! চড়াইকোল রেলস্টেশন তখন গাঁয়ের লোকের কাছে ছিল এক বিপুল বিস্ময়| বরং চিরচেনা পদ্মা আর তার বুকে ধোঁয়া তুলে ভেসে যাওয়া স্টিমার ছিল তাদের কাছে সহজ, স্বাভাবিক| রবিবাবু সচরাচর নদীপথেই আসতেন এখানে, এই বাড়িতে| তাঁর প্রিয় বোটে চড়ে, বজরায় এসে নামতেন নদীর ঘাটে, সেখান থেকে আট বেহারার পালকি তাকে নিয়ে আসত এই কাচারি বাড়িতে| কখনো একা আসতেন তিনি, কখনো সপরিবারে| বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কেমন গা ছমছম করে এই ঘনায়মান অন্ধকারে, বৈশাখের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিমাখা সোঁদা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে| সেদিনের সেই সব পাইক-বরকন্দাজ, প্রজা, পালকির সেইসব বেহারার দল, জমিদার রবিবাবু, কোথায় আজ তারা? কোথায় হারিয়ে গেছেন তারা সবাই? বাড়িটা ঠিক দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে নিথর, নীরব! সেদিন কোথায় ছিলাম আমি আর কোথায় ছিল দ্বাররক্ষী বদরুল? ভাবনাটা আনমনা করে দেয় ভীষণ| উদাস করে তোলে| সময়ের স্রোতে তবে এমন করেই ভেসে যায় জীবনের সব রূপ, রস, গন্ধ, আর উতরোল, উত্তাল সব হৃদয়জুড়ে থাকা বোধ! জীবন তবে এমনই এক ঠুনকো ফানুস, সময়ের শরীরে ক্ষণিক বুদবুদ তোলা সামান্য একপলকা হাওয়া!
স্যার, আসেন, তালা খুলে দিয়েছি|
বদরুলের কথায় সম্বিৎ ফেরে হঠাৎ| গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়ি রবিবাবুর কাচারিবাড়ির চৌহদ্দিতে| মনে হয় আমি নই, অন্য কেউ, অন্য আমি প্রবেশ করি রবিবাবুর এই শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া প্রাচীন বাড়িটার রহস্যময় ঘেরাটোপে| আমাকে ঘিরে ধরে অন্যলোকের কোনো অপার্থিব বোধ| আমি ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকি তাতে, ডুবে যেতে থাকি| বদরুল আমাকে চার্জার লাইটের আলোয় পথ দেখিয়ে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাতে চায়| আমি নিরস্ত্র করি তাকে| ফিরে যেতে বলি| মুঠোফোনের আলোয় পথ হাঁটি কোন এক ঘোরে| বামদিকে পড়ে থাকে রবি কবির কাচারিঘর, যেখানে বসে তিনি প্রজাদের দর্শন দিতেন, প্রজাদের দুঃখ-সুখের খবর নিতেন, জমিদারির নানান বিষয় তদারকি করতেন| পায়ে-পায়ে গিয়ে বসি রবির মস্ত দীঘির শানবাঁধানো ঘাটে| অন্ধকারে বসে থাকি চুপচাপ| বৃষ্টি ঝরে টুপটাপ, শিশিরবিন্দু হয়ে ঝরে পড়ে গায়ে| পড়ুক| আহা| সেই কতকাল আগে এমনই কোনো সন্ধ্যায় হয়ত রবিও বসেছিলেন এই সুনসান অন্ধকার ঘাটে, শুনেছিলেন ঝিঁঝিদের ঐকতান, পাতা ঝরার ফিসফাস, হাওয়াদের কানাকানি| কী কথা সেদিন বেজে উঠেছিল কবির হৃদয়-তানপুরায়, কোন সুর? কবি কি সেদিন বিরহে ব্যাকুল হয়ে ভেবেছিলেনে এইসব ছেড়েছুড়ে চলে যাবেন তিনি কোনো একদিন, হারিয়ে যাবেন অনন্ত এক জগতের ছায়াপথে, তারই প্রিয়, অতি প্রিয় এই বকুলতলে এসে চোরের মতো চুপিচুপি তাকে স্মরণ করবে এসে কোনো এক অখ্যাত আগন্তক? ঐ তো দীঘির জলে ভাসছে কবির অতি প্রিয় বোটটি, যাতে সেই বোলপুর থেকে নদী দিয়ে ভেসে এসে উঠতেন এই ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়!
হাওয়ারা উতল হয়ে বয় হঠাৎ, কানে কানে কী যেন গভীর গোপন কথা কয়, হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে, কী এক বিরহব্যথায় টনটন করে ওঠে| আকাশ কাঁদে, বাড়িটাও| আমার চোখ বেয়ে জল নামে অজান্তে কখন| অন্ধকারে, গরমের এই সময়টাতে সাপ-খোপের উৎপাত হয় খুব, বদরুল সাবধান করে দিয়েছে| ইদানীং এদিকে রাসেলস ভাইপারের উৎপাত ভয়ানক বেড়েছে, পইপই করে বলেছে বদরুল, তবু মুঠোফোনের আলোটা জ্বালতে আমার ইচ্ছে করে না একদম| মনে হয় এখানে ধ্যানমগ্ন আছেন কোনো প্রেমিক হৃদয়, বিরহ বিধুর সুরে নৈঃশব্দ্য যাকে ডুবিয়ে রেখেছে আশ্লেষে| সামান্য আলো, ক্ষীণতম শব্দও ভেঙে দেবে তার ধ্যান, মগ্নতা| বাতাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়, করুণ সুরে কী যেন বলতে চায়, আমি গুনগুনিয়ে উঠি, তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে, টুকরো করে কাছি, ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে আছি…
হঠাৎ শিরশির করে ওঠে শরীর| মনে হয়, আমি একা নই, এখানে অন্য কেউ আছেন, কেউ একজন বসে আছেন আমার পাশে, প্রবল কৌতুকে, অতুল স্নেহে যিনি দেখছেন আমার পাগলামি! কে তিনি? রবিবাবু? জমিদার শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? কবি? দূর! আমার বিকারগ্রস্ত মন কত কী যে অলীক ভাবনায় অধীর হয়! বৃষ্টির ঝাপটায় ভেজা শরীরে শীত-শীত লাগে, হাওয়ারা অশান্ত হয়ে কী যেন বলতে চায়, ছড়িয়ে দিতে চায় কী এক গোপন বার্তা| আমি উঠি, এগিয়ে যাই ঠাকুরবাড়ির দরদালানের দিকে| বদরুল দরজা খুলে রেখে গেছে আগেই| ভূতগ্রস্তের মতো আমি ঢুকে পড়ি ভেতরে| ইতিহাস কথা বলে ওঠে হঠাৎ| মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে আমি এ ঘর থেকে ও ঘরে যাই, ছবি দেখি, রবির দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত জিনিসগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি| আহা| এগুলোতে স্পর্শ লেগে আছে রবিবাবুর| সেগুলো ছুঁয়ে যেন রবিকেই ছুঁই আমি, কবিকেই স্পর্শ করি সহসা| ঐ তো কবির ব্যবহৃত সেই আট বেহারার পালকি! আমি স্পষ্ট দেখতে পাই জমিদার রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন তাতে, আটবেহারা তাকে নিয়ে ছুটছে আর সুর তুলছে, হুহুমনা হুহুমনা… পালকি চলার ছন্দে রবি দুলছেন মৃদু, মনে মনে ভাবছেন সোনার তরী, বলাকা বা মানসীর বিখ্যাত কোনো পঙ্ক্তি! রবির ব্যবহৃত খাট পড়ে আছে, জীর্ণ শরীরে, টেবিলটা জুড়ে আছে ঘরের এক কোণে, আমি কল্পদৃষ্টিতে দেখতে পাই খাটে আধশোয়া রবীন্দ্রনাথ কোনো এক বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন গভীর মনোযোগে, তার গৌরবর্ণ কপালে গ্রীষ্মের ভীষণ গরমে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চিকচিক করছে মুক্তোদানার মতো| পাশে পাখা করছে কোনো বেয়ারা| দেখতে পাই টেবিলে বসে গভীর ধ্যানে কবি করে চলেছেন গীতাঞ্জলির সঞ্চয়িতার ইংরেজি অনুবাদ, প্রসন্ন হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে তার শ্মশ্রুমণ্ডিত গম্ভীর মুখ| মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমি সারা বাড়ি ঘুরি| অন্ধকার গা সওয়া হয়ে গেলে নিভিয়ে দেই মুঠোফোনের আলো| সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসি দোতলায়| সব ঘর ঘুরে অবশেষে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, হাওয়ারা দারুণ ফূর্তিতে বয়ে যায়, টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেক দূরের দৃশ্য চোখে ভাসে, অন্ধকারে ঝাপসা সব, অস্পষ্ট| আমি তিনতলার সিঁড়ির দিকে এগোই| তিনতলার সিঁড়ির সামনে লোহার শেকল, রড দিয়ে আগলে রাখা| কাঠের সিঁড়ি, দর্শনার্থীর চাপে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে এমন সাবধানতা| তিনতলায় ওঠা নিষেধ| বদরুল পইপই করে বারণ করে দিয়েছে| সাবধানে শেকল পেরিয়ে সামনে এগোতেই শব্দ ওঠে ক্যাঁচক্যাঁচ| রাতের নিস্তব্ধতাকে খুন করতে চায় গলা টিপে| সন্তর্পণে সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠি, ঘুরে দেখি, তারপর সোজা ছাদে| দূরে পদ্মা হাতছানি দিয়ে ডাকে| এই পদ্মার বুকে বোট নিয়ে ভেসে বেড়াতেন রবি, কাটাতেন নিমগ্ন সময়| ধ্যানস্থ হতেন লেখায়| অন্ধকারে দূরের পদ্মার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ওখানে এখনো বোটে চড়ে ভাসছেন রবি, রচনা করে চলেছেন নতুন কোনো সোনার তরী| মনে হয় পদ্মা হাতছানি দিয়ে ডাকে, বলে আয়, আয়, আয়…
নদী বয়ে যায়, সময় বয়ে যায়, সময়ের স্রোতে কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে আমরা হারিয়ে যাই কোন অতল মহাসমুদ্রে, অনন্ত কোন সায়রে… শুধু স্মৃতি থেকে যায়, থেকে যায় কথার ডালি| ঠাকুরবাড়ির শতাব্দীপ্রাচীন এই কাঠামোর ছাদে দাঁড়িয়ে নতুন করে অনুভব করি এই অমোঘ বার্তা| ছাদের এককোণে লাগোয়া লোহার সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসি নিচে, বাড়ির পেছন দিকটায়। ঘাসে, কাদায় একাকার| বদরুলের সাবধানবাণী মনে পড়ে| সাপখোপের উৎপাত আছে এদিকটায়| দিনে দর্শনার্থীর ভীড় থাকে, তাছাড়া দিনের আলোয় তারা বের হয় না বড় একটা, রাতেই যত ভয়| সাবধানে পা ফেলি অন্ধকারে| পিছল পথ| কাদামাটি পেরিয়ে পাকা পথে উঠে ধীরে ধীরে এগোই| আম কাঁঠালের গাছের নিচে থমকে দাঁড়াই| মনে হয়, খানিক বাদেই দেখতে পাব গম্ভীর পদক্ষেপে পেছনে দুহাত বেঁধে, সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে আনমনে হাঁটছেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ| পরনে ঢিলে আলখাল্লা, মাথা ভর্তি বাবড়ি চুল কাঁধ ছুঁয়ে নেমে গেছে নিচে| গুনগুন করে কবি তার মৃদুগলায় গাইছেন, আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা বন্ধু হে আমার…
স্যার, আপনি এখানে? আমি আপনাকে সারাবাড়ি খুঁজে সারা! খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম আপনাকে না পেয়ে!
বদরুলের কথায় চমকে তাকাই| বদরুল তার চার্জার লাইট জ্বেলে সামনে এগোয়, বলে, চলেন স্যার, রাতের খাবার তৈরি| দেশি মুরগির ঝোল আর পিয়েলি মাছের চচ্চরি| এত রাতে বেশি কিছু যোগাড় করতে পারলাম না আর|
আমি নীরবে বদরুলের পেছনে এগোই| আজ রাতটা এই বাড়ির অন্ধকারে কাটাব আমি, জমিদার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, বিশ্বজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, ভাবতেই অপার্থিব এক বোধ আচ্ছন্ন করে তোলে আমায়, বিভ্রমে ডুবিয়ে দেয়| আমি পথ হাঁটি কোনো এক মায়ার ঘোরে, মোহের হাত ধরে|
Leave feedback about this