তীরন্দাজ অনুবাদ
কবি বলেছিলেন
(হালা আলিয়ানের জন্য)
কবি আরো একবার বলেছিলেন
যেমন তাঁকে বলতে হয়, যেমন তিনি বলেন –
অমানবিকতার ইতিহাস,
বিস্মৃত সেই জাতির ইতিহাস,
যাদেরকে সবাই মানুষ ভাবতে ভুলে গিয়েছে।
যারা তৃষ্ণায় কাতর,
যারা রক্তাক্ত হয়,
যারা তাদের সন্তানকে ভালোবাসার
চাদর দিয়ে আগলে রাখে।
কবি বলেছিলেন
যেমন তাঁকে বলতে হয়, যেমন তিনি বলেন –
গাজার শিশুদের কথা
সেই সংবাদ সম্মেলনের কথা
যেখানে শিশুরা উঠে দাঁড়ায়,
নিজেদের ভাষা নয় অথচ সেই বিদেশি ভাষায়
আর্তনাদ করে বলে
“দয়া করে আমাদের বাঁচতে দাও,
দয়া করে আমাদের সামান্য শান্তিটুকু দাও।”
আমি বিস্মিত হই – বললেন কবি,
যেমন তাঁকে বলতে হয়, যেমন তিনি বলেন –
তাদের কথা,
যারা সেই আর্তনাদ শোনে
আর নির্লিপ্ত থাকে,
যাদের হৃদয় ব্যথিত হয় না।
এর পর উপস্থাপক সৌজন্যের সঙ্গে ধন্যবাদ জানালেন,
আর কবি, যেমন তাঁকে বলতে হয়, যেমন তিনি বলেন,
শ্রোতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
এর পর উপস্থাপক নির্ভুল সম্প্রচারভঙ্গিতে বললেন –
“আরও খবর জানতে সঙ্গে থাকুন,
এবং শুনুন এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণের কথা।”
আর ঠিক তখনই ছিল –
সেই চূড়ান্ত মুহূর্তটি,
এক নিঃশ্বাসের স্থবিরতা,
যখন শিশু হত্যার অভিযান
রূপ নেয় ‘আরও খবরে’,
‘ভিন্ন দৃষ্টিকোণ’ থেকে।
সেই মুহূর্ত থেকে
শিশুরা মরতে থাকে –
আবার, আবার,
অবিরত,
চিরকাল।
পৃথিবীর বুকে এক শূন্যতা
(রিফাত আলারির স্মৃতিতে)
তোমাকে যেদিন হত্যা করা হলো
সেদিন এমন অনেক কিছুই করেছি আমি
যা তুমি করতে যদি আজও থাকতে বেঁচে এই পৃথিবীতে।
এই যে জেগে উঠলাম,
কন্যার কপালে চুমু আঁকলাম,
বেরিয়ে পড়লাম কাজে,
ক’জন উৎসুক হৃদয়কে শেখালাম
কবিতা পাঠের ভাষা।
এর পর চোখ বোলালাম খবরের পাতায়
যেখানে আছে তোমার নাম,
আদতে তুমি নেই থাকবে না আর কোনদিন।
অথচ তখনও নির্মমভাবে বিচরণ করছিল তোমার ঘাতকেরা।
হত্যা করা হলো তোমাকে যেদিন
সেদিন বেসামাল ছিলাম আমি।
তবুও রোজকার মতো
বাড়ি ফিরেছিলাম।
কন্যাকে গল্প শুনিয়েছি,
তার জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করেছি।
যে অপরাধে তোমাকে ওরা হত্যা করেছে –
একজনের অপরাধ কবি হওয়ার
একজনের অপরাধ শিক্ষক ও বিশ্বপ্রেমিক হওয়ার
অপরাধ সেইসব হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করবার।
দেখো, এসব অপরাধ তো আমারও হয়েছে!
তবু এখনও আমি জীবিত আছি
কারণ, আমি সেই প্রান্তে থাকি
যেখান থেকে বোমা উড়ে যায়
আর তুমি আছো বিপরীত প্রান্তে,
যেখানে বোমা এসে নামে।
তাই এখনও জীবিত আমি।
আমি ছাত্রদের শেখাই
কবিতা কীভাবে সৃষ্টি হয়।
অতি সাধারণ বিষয়গুলো একই বন্ধনে মিলেমিশে
কবিতা হয়ে ওঠে;
সৃষ্টি হয় অসম্ভবের অস্তিত্ব
এক নতুন অভূতপূর্ব বাস্তব।
হত্যা করা হলো তোমাকে যেদিন
সেদিন আমি আমার কন্যাকে বুকে জড়িয়ে
একটি গল্প শোনাতে চেয়েছিলাম।
তবে শোনাতে চাইনি যে
তোমার সন্তানেরা কীভাবে
শূন্যতায় জর্জরিত হবে চিরকাল,
শোনাতে চাইনি ওকে
আমদের দেখা হয়নি আজও
আর হবে না দেখা কোনদিন।
বলো, এই কবিতার কোথায় কিংবা
এই পৃথিবীর কোথায় ‘গণহত্যা’
শব্দটি বসবে?
‘যদি আমার মৃত্যুও হয়,
হে কবি, তুমি লিখেছিলে
‘তা যেন আশার আলো দেখায়,
তা যেন গল্প হয়ে রয়।’
আমি কবিতাটি লিখেছি
তাতে কিছু আসে যায় না, জানি।
তোমার শূন্যতা এই পৃথিবীতে
এক বিরাট ফাঁক রেখে গেছে।
ভীষণ বাস্তব ও প্রকট।
আমরা যারা পড়ে থাকি পিছে
শব্দের ভার কাঁধে নিয়ে –
কবির অনুপস্থিতির শূন্যতায়
চলো লিখে ফেলি কিছু কবিতা।
সুর মনে রাখার কৌশল
(লুবনা আলিয়ানের স্মৃতিতে)
বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখার তাড়না
এক ধরনের প্রবল আসক্তি।
বেহালা, যার আছে
চারটি তার
উঁচু থেকে নিম্নে ই এ ডি
এবং জি।
তারা তৈরি হয়
ভেড়ার অন্ত্র, নাইলন
কিংবা ইস্পাত থেকে।
কোনো নীরবতম এক দিনে
গাজায় এক কিশোরী দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিল,
‘আমি বেহালা ভালোবাসি’
আরও তীব্রভাবে বলেছিল
‘একদিন আমি বেহালা বাজিয়ে
বিশ্ব জয় করব।
হ্যাঁ, এটাই আমার স্বপ্ন।’
তার সুর-রচনায় ছিল মুগ্ধতা,
সুরের প্রতিটি ছোঁয়ায় একনিষ্ঠতা।
ভিয়োলা, চেলোর চারটি তার
সি জি ডি এ – মনে রাখার কৌশল
Cats Go Down Alleys
কিন্তু ওই বেহালার তারগুলো
জি ডি এ আর ই মনে রাখতে
Good Dogs Always Eat.
কোনো এক কাকডাকা ভোরে
সেই কিশোরী, লুবনা আলিয়ান শহিদ হন
তার আত্মীয়ার বাড়ি
আল নুসাইরাতে,
যে-শহরকে ইজরায়েলি বাহিনী
আখ্যা দিয়েছিল
‘নিরাপদ অঞ্চল’ বলে।
দক্ষিণ গাজার সেই স্থানে
লুবনারা এসেছিল নিরাপদ আশ্রয় পেতে।
কিন্তু এক সকালে
তাদের আশ্রয়স্থলে বোমা ফেলে
গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
পুরো পরিবারকে
মুছে ফেলা হয়
নাগরিক নিবন্ধনের খাতা থেকে
গাজার অন্য সব নাগরিককে
যেভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল।
যেন বাদ্যের তার মনে রাখার সেই মন্ত্র
Cats Go Down Alleys
এবং Good Dogs Always Eat
যেন বাদ্যযন্ত্রের সেই উপাদান
ভেড়ার অন্ত্র, নাইলন, ইস্পাত –
আর হত্যার বিপরীতে নীরবতা।
অ্যান্থনি আলেহান্দ্রিনি : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। আমেরিকার কিংসবোরা কমিউনিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এবং নিউইয়র্কে দি সিটি ইউনিভার্সিটিতেও ক্লাস নেন। আলেসান্দ্রিনি ফ্রাঞ্জ ফানোর ওপর বই লিখেছেন। বিভিন্ন জার্নাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত তার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বেশ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদক হিসেবেও কাজ করছেন।


Leave feedback about this