গদ্য চিত্রকলা

অনন্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী | জাহিদ মুস্তাফা | গদ্য

কাইয়ুম চৌধুরী

কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক চিত্রকর, সর্বোপরি আমাদের নাগরিক রুচিবোধের নান্দনিক নির্মাতা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রবোদ্ধা, বিদগ্ধ এক পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের বই-পত্রিকাসহ প্রকাশনার অবয়বকে যিনি দৃষ্টিনন্দন করেছেন, যাঁর সৃষ্টিশীল ও নন্দিত হাতের জাদুতে প্রকাশনাশিল্পের নানা শাখা হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন – মানোত্তীর্ণ। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি প্রচ্ছদ, অলংকরণ, অঙ্গসজ্জা ও টাইপোগ্রাফির সময়োপযোগী আধুনিক মানোন্নয়নে নিরলস কর্মসাধনায় ব্যাপৃত থেকেছেন। গ্রাফিকসের এই কাজে কাইয়ুমের যুগান্তকারী প্রচ্ছন্ন প্রভাব তাঁর তিরোধানের একদশক পরেও আমরা প্রত্যক্ষ করছি বাংলার প্রকাশনা শিল্পে, অন্য শিল্পীর কাজের ধরনে, বইপত্রের, প্রকাশনার আঙ্গিকে, যাদের অনেকেই ছিলেন চারুকলায় তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছাত্র-ছাত্রী।

পারিবারিক পটভূমি ও শিল্পশিক্ষায় মানসগঠন

গত শতকের আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় শিক্ষাজীবনে শিক্ষক হিসেবে তাঁকে পেয়েছি, আবার পেশাগত জীবনে অসংখ্যবার তাঁর দ্বারস্থ হয়ে সস্নেহ সান্নিধ্য পেয়েছি। পত্র-পত্রিকার পাতায় লেখালেখির বিষয়ে তাঁর আশীর্বাদ ছিল। তিনি নিজে লিখতেন, সাবলীল মিষ্টি ভাষায় লিখেছেন অসংখ্য ছড়া, কবিতা, স্মৃতিকথা, স্মরণ, ভ্রমণকাহিনী প্রভৃতি।

কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনী শহরের ক্রিশ্চান মিশনারির পাদরি-কুটিরে। শহরের সন্নিকটেই শর্শদি গ্রামে পৈতৃকনিবাস। এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের সন্তান তাঁর বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় বিভাগের পরিদর্শক, পরে সমবায় ব্যাংকের কর্মকর্তা। মা সরফুন্নিসা চৌধুরানী ছিলেন গৃহিনী।

পূর্বসুরিদের জৌলুস তখন তেমন ছিল না, তবে পরিবারের ভেতরে শিক্ষা ও উদার মানসের অবস্থান ছিল। এই পরিবারের সদস্য আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছিলেন ‘নোয়াখালীর ইতিহাস’। পিতার প্রভাব তাঁকে বিশেষ আগ্রহী করেছে সঙ্গীতে ও গ্রন্থপাঠে। বাল্যকালের অর্জন এই দুই নেশা পরবর্তীকালে তাঁর শিল্পীজীবনে বিশেষ ছায়াপাত ঘটিয়েছে।

বাড়িতে ছিল বইপত্রের বিশাল ভাণ্ডার। ডাকযোগে নিয়মিত আসা বাংলা সাময়িকীর সমৃদ্ধ সংগ্রহ ছিল। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মানসী, মর্ম্মবাণী, বনশ্রী তো ছিলই, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শনের পুরনো অনেক সংখ্যাও ছিল পারিবারিক সংগ্রহে। সেকালে রুচিশীলতার প্রতীক কলের গান ও রেকর্ডের সংগ্রহ ছিল বাড়িতে। এরকম পারিবারিক আবহে বালক কাইয়ুম চিত্তবিকাশের সুযোগ পেয়েছিলেন।
পারিবারিক পরিবেশ ছাড়াও পিতার সামাজিক যোগও ছিল ব্যাপ্ত। নোয়াখালী স্কুলে সতীর্থ ও অন্যক্লাসে পড়ুয়া হিসেবে পেয়েছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, গোপাল হালদার, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখকে। কুমিল্লায় শিক্ষিত রুচিবান ধ্রুপদী গায়ক মোহাম্মদ হোসেন খসরু এবং লোকগানের সাধক সুরকার শচিন দেববর্মণের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা হয়েছিল। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে শচিন ছিলেন তাঁর সহপাঠী। চট্টগ্রামের আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সঙ্গে ছিল তাঁদের পারিবারিক যোগাযোগ।

বদলিজনিত চাকরির সুবাদে পিতা বারবার ঠাঁই বদল করেছেন, সেই সুবাদে কাইয়ুম চৌধুরী বাংলার অনেক এলাকা ঘুরেছেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার হাতেখড়ি শিশুকালে, মক্তবে। এরপর চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে কিছুদিন পড়ে কুমিল্লায়, সেখান থেকে যান নড়াইলে। চিত্রা নদীপারের শান্ত স্নিগ্ধ শহরে কাটে তাঁর বাল্যকালের তিনটি বছর। সেখান থেকে সন্দ্বীপ এসে প্রথমে সন্দ্বীপ হাইস্কুলে, পরে কারগিল হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। ততদিনে স্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠেছেন, মনে দানা বাঁধছে নানা স্মৃতি। প্রত্যন্ত বাংলার লোকায়ত জীবনের যে সমন্বিত সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ যে তখনকার সমাজেকার্যকর ছিল এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ তিনি পেয়েছিলেন স্কুলের মৌলবি স্যারের কাছ থেকে। বাড়িতে যিনি নিয়োজিত হয়েছিলেন কাইয়ুমের আরবি শেখা ও নামাজ সবকের জন্য। স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেই মৌলবি স্যার গাইলেন অতুল প্রসাদের গান – ‘সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে।’

সন্দ্বীপের পর নোয়াখালী সদরে কিছুদিন কাটিয়ে ঠাঁই বদল করে ফেনী হাইস্কুলে ভর্তি হন কাইয়ুম, এরপর যান ফরিদপুর। সেখান থেকে ময়মনসিংহে এসে সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে যখন ম্যাট্রিক পাস করেন তখন ১৯৪৯ সাল, ব্রিটিশ শাসকরা বিদায় নিয়েছেন, ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে!

স্কুল জীবনেই আঁকা-আঁকিতে ঝোঁক দেখা দিয়েছিল কাইয়ুম চৌধুরীর। জেনেছেন, ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিনের বাড়ি ময়মনসিংহে। তিনি এসেছেন শুনে বাবা কাইয়ুমকে সঙ্গে নিয়ে আকুয়ায় জয়নুলের বাড়ি এলেন। জয়নুল তখন পুকুরে নেমেছেন গোছলের জন্য। সব শুনে আবেদিন স্যার বাবাকে বললেন, ‘ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউটে কাইয়ুমকে ভর্তি করে দিন।’

চিত্রবিদ্যালাভ

পুরনো ঢাকার জনসন রোডে ন্যাশনাল হাসপাতালের অপরিসর দু’কামরার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচে ১৯৪৯ সালে ভর্তি হন কাইয়ুম চৌধুরী। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন রশীদ চৌধুরী, মূর্তজা বশীর, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ শিল্পীকে। শিক্ষক হিসেবে তাঁরা পেলেন কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষক জয়নুল আবেদিন, স্কলার আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ ও হাবিবুর রহমানকে। শফিকুল আমীন ও খাজা শফিক পরে আর্ট স্কুলে যোগ দেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শুরু হয় তাঁর শিল্পের অনুশীলন। কলকাতার ওই একাডেমি থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিল্পীরা যে পদ্ধতিতে চিত্রবিদ্যা শিখেছেন, এখানেও সেই পদ্ধতি ও মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে তাঁরা বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নি।

১৯৫১ সালে ঢাকার লিটন হলে আয়োজিত আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রথম প্রদর্শনীতে অনেক ছবি বিক্রি হয়। জলরঙে আঁকা জিঞ্জিরাতে দুপুরবেলা ঘাটে ‘বাঁধা নৌকা’ শীর্ষক কাইয়ুম চৌধুরীর একটি কাজ
বিক্রি হয়। ওটাই তাঁর আঁকা চিত্রকর্মের প্রথম বিক্রি।১৯৫৪ সালে সাফল্যের সঙ্গে তাঁর শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হয়।

মুখ্য দুই শিল্প ও শিল্প অস্তিত্ব

কাইয়ুমের সৃজনীসত্তা বহুমাত্রিক হলেও প্রধান দুটি সত্তা প্রধান হয়ে উঠেছিল। একটি সৃষ্টিশীল গ্রাফিকসের কাজ, অন্যটি চিত্রকলায় তাঁর সতত সৃজনী অন্বেষা। এ দুটির একটির সঙ্গে আরেকটির মেলবন্ধন ঘটেছে এমনভাবে যাতে দুই মাধ্যমেই তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় এবং স্বকীয়তার নানা বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিক প্রকাশ এবং ক্রমবিকাশ দেখতে পাওয়া যায়।

কাইয়ুম চৌধুরীর গ্রাফিকস্

বাংলা টাইপোগ্রাফির বৈচিত্র্য এবংনান্দনিক কাজে তাঁর অবদান অসামান্য। চিত্রকলা থেকে বই ও পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার সবক্ষেত্রে তাঁর অংকনে সেই স্বকীয় অংকনরীতির প্রকাশ দেখে দেখে শৈশব থেকে আমরা পরিণত বয়সে এসে পৌঁছেছি। আজকের শিশু থেকে বৃদ্ধরাও যারা পাঠক, তারা তাঁর গ্রাফিক্সের সৃজনশীলতার ভেতরে কোন না কোনভাবে মুগ্ধতার অবগাহনে আবদ্ধ।

পাঠাভ্যাস

ছোটবেলাতেই বইয়ের সঙ্গে একধরনের আত্মীয়তা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর। বাবার ছিল বইপাঠের অভ্যাস। নানারকম বই সংগ্রহ করতেন তিনি। বাস্তবানুগ অঙ্কনে প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজন শিল্পীর আঁকাপ্রচ্ছদ তাঁকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে, তিনি তাঁর আঁকা কপি করতেন আর এর ডেকোরেটিভ অলঙ্করণ করতেন সমর দে। এঁদের কাজ দেখে কাইয়ুম এতটাই বিমুগ্ধ ছিলেন যে, সময় পেলেই এসব কপি করতেন। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনে নিজেরও একটা সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন। সহপাঠী বন্ধুরা সেসব বই ধার নিতেন। বইগুলো ফেরত পাওয়ার সময় দেখতেন পাঠকের অযত্ন অবহেলায় বইয়ের প্রচ্ছদ ছেঁড়া। এতে তিনি ভীষণ ব্যথিত হতেন। মনোকষ্ট দূর করতে সেইসব বইয়ের মলাটের অনুকরণে নিজেই এঁকে ফেলতেন প্রচ্ছদ। এ ভাবেই তাঁর আঁকাআঁকির অভ্যাস রপ্ত হয়। কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত বইগুলোতে সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদ দেখে তাঁর মন ভরে যেত। সত্যজিৎ রায়ের অসাধারণ প্রচ্ছদচিত্রের অভিজ্ঞতা কাইয়ুম চৌধুরীর চিন্তাভাবনাকে অনেক বদলে দিয়েছে। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণের প্রতি তাঁর এই ভালোবাসার মাধ্যমেই ছবি আঁকার জগতে কাইয়ুমের পদার্পণ ঘটে।

বইয়ের প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার কাজের মধ্য দিয়ে ছাত্রজীবনেই কাইয়ুম চৌধুরীর আয়-রোজগারের সূচনা। ১৯৫২সালে শিল্পী আমিনুল ইসলামের মাধ্যমে ‘প্রভাতী’ নামে কিশোরগঞ্জ থেকে প্রকাশিত শিশু-কিশোরদের একটি পত্রিকার প্রচ্ছদ আঁকার মধ্য দিয়ে তাঁর গ্রাফিকস কাজের সূচনা। সম্মানী পান পনেরো টাকা। আরমানিটোলায় ওয়ার্সি বুক সেন্টার নামে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। তারাআর্টের নানা উপকরণ আমদানি করত। বইপত্র বিক্রি এবং নিজেরাও বই প্রকাশ করত। আমিনুলের মাধ্যমে এদের প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার কাজ পেলেন কাইয়ুম চৌধুরী। সেই থেকে বইয়ের নিয়মিতভাবে প্রচ্ছদ আঁকার জগৎ খুলে যায় তাঁর সামনে। তিনি ষাট বছর ধরে হাজার হাজার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, যাঁকে যেমন এঁকে দিয়েছেন, তিনি তা মেনে নিয়েছেন। তাঁদের একটাই চাওয়া ছিল, বইটির নাম যেন তাঁর হস্তাক্ষরে হয়। এভাবেই কাইয়ুমের স্বকীয় ও দৃষ্টিনন্দন অসাধারণ টাইপোগ্রাফি তৈরি হয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় এটি ‘কাইয়ুমটাইপ’।
অনেকগুলো পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড তাঁর করা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – দৈনিক প্রথম আলো, প্রথম আলোর শিল্প ও সাহিত্য, অন্যআলো, সচিত্র সন্ধানী, সাপ্তাহিক একতা, মাসিক টাপুরটুপুর, বাংলা একাডেমির ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র উত্তরাধিকার, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পত্রিকা মাসিক কালি ও কলম, ত্রৈমাসিক শিল্প ও শিল্পী, লিটলম্যাগাজিন নান্দীপাঠ প্রভৃতি।

পত্র-পত্রিকায় তাঁর কাজের সূত্রপাত ইংরেজি দৈনিক অবজারভার দিয়ে, তারপর একে একে দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক সন্ধানী, দৈনিক জনকণ্ঠ এবং সর্বশেষ দৈনিক প্রথম আলোর গ্রাফিকস কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবজারভারে কাজ করার সময় কবি আবদুল গণি হাজারীর সান্নিধ্য পান। সে সময় কবি জসীম উদ্দীনের ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদের জন্য কাইয়ুম জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ঘোষিত শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পীর পুরস্কার পান। স্বাধীনতার পর আরও অনেক বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য তিনি বারবার পুরস্কৃত হয়ে নন্দিত গ্রাফিকস কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন।

দেশের মানসম্মত প্রকাশনাকে আন্তর্জাতিক মানে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অতুলনীয়। দীর্ঘ ষোল বছর দৈনিক প্রথম আলোর সাময়িকীসহ নানা পাতার পর পাতা তাঁর অসংখ্য অংকন আর নকশায় নন্দিত হয়েছে। একইভাবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মাসিক কালি ও কলমের এগারো বছরে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বহু গল্প-উপন্যাস-কবিতার অক্ষরবিন্যাসসহ সচিত্রকরণ করেছেন। নিজের অঙ্কনরীতি ঠিক রেখে সচিত্রকরণ যে কত বিচিত্র ও নান্দনিক হতে পারে,এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি তাঁর আঁকা বই ও পত্র-পত্রিকার পাতায়।
তাঁর সচিত্রকরণের দুটি বৈশিষ্ট্য প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, গল্প-উপন্যাস-রম্যলেখা-ভ্রমণ-প্রবন্ধ যা-ই তিনি সচিত্রকরণ করতেন, বিষয়বস্তুকে মেনেঅঙ্কনে জোর দিতেন। সচিত্রকরণের মাধ্যমে পাঠকের পাঠের প্রাকপ্রস্তুতির কাজটি সারতেন শিল্পী, যাতে পাঠক সহজেই বিষয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন। আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাঁর – এ কাজে তিনি প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন, তবে বিমূর্তায়নের দিকে যাননি। গ্রাফিক চিত্রকর হিসেবে এখানেই অনন্য কাইয়ুম চৌধুরী।

কালি ও কলমের পাতায় নবীন-প্রবীণ কবির কবিতার ভেতরকার বাণীমাধুর্যের সাথে কাইয়ুমের অঙ্কিত চিত্রমালার মিলন পাঠকের জন্য দারুণ উপভোগ্য ছিল। তেমনি গল্প-উপন্যাসের স্বাদু-বর্ণনা ও ঘটনার নাটকীয়তার সচিত্রকরণে লেখা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে।
১৯৭৫ সালে প্রচ্ছদ-শিল্পে রুচির পালাবদল এবং উৎকর্ষের অভূতপূর্ব মাত্রা যোগ করার ক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরীর দীর্ঘদিনের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তাঁকে বিশেষ স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। এ উপলক্ষে তাঁর নির্বাচিত বিভিন্ন প্রচ্ছদ নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজনও হয়। প্রদর্শনী সম্পর্কে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘কাইয়ুম চৌধুরীর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের প্রচ্ছদশিল্পে স্পন্দিত হলো অভিনবত্ব। প্রচ্ছদে প্রকৃত আধুনিকতা দেখা দিল প্রবলভাবে। প্রায় তাঁর একক প্রচেষ্টায় এদেশের গ্রন্থাবলির অঙ্গসজ্জায় ঘটে গেল রুচির ঋতুবদল।’

চিত্রকর কাইয়ুম

দীর্ঘ ষাট বছরের নিরন্তর চিত্রসাধনায় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন দেশের শীর্ষশিল্পীদের একজন। আবহমান বাংলাকে ধারণ করে, বাংলার সংগ্রাম-সংস্কৃতি ও জীবন-যাপনকে উপজীব্য করে দারুণ ছন্দে কবিতার মতো ছবি আঁকতেন তিনি। বাংলারপ্রকৃতিরঅপূর্ব সৌন্দর্য এবং এই ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের তিনি চিত্রপটে তুলে এনেছেন নিজস্ব অঙ্কনশৈলীতে। লোকশিল্পের রঙ ও রেখাকে সমকালীন আধুনিকতায় বিন্যস্ত করে নিজের একটা চিত্রভাষা তিনি নির্মাণ করেছিলেন। নানা জায়গায় ঘুরে বাংলার প্রকৃতি ও তার বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটে কাইয়ুমের।

তাঁর মানসগঠনে প্রকৃতির ভূমিকা অসামান্য। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, প্রকৃতি আমার প্রথম শিক্ষক। তাঁর আঁকায়, রেখায়, লেখায় সব ক্ষেত্রে বাংলার নদীমেখলা প্রকৃতি ও মানুষের মনোরম ছবি ফুটে উঠেছে। নড়াইলের চিত্রা নদীর প্রভাব যেমন শিল্পী এসএম সুলতানকে মরমি শিল্পীতে পরিণত করেছে, তেমনি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সৃজনজীবনে এর কলতান আমরা পেয়ে যাই। আশির দশকে তাঁর আঁকা ‘আমার গ্রাম’ সিরিজে যে নদীমেখলা রূপ দেখি তার সাথে পদ্মা-ব্রম্মপুত্র-চিত্রার সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

চারুকলায় শিক্ষকতা করার সুযোগ লাভ এবং চিত্রকলায় তাঁর নিবেদিত হবার পেছনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অসাধারণ অবদান তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন। কাইয়ুমের গ্রাফিকসের কাজ বেশ পছন্দ করতেন জয়নুল। দৈনিক অবজারভার পত্রিকার রবিবাসরীয় পাতায় আঁকা ছবি দেখে জয়নুল তাঁকে বলেছিলেন, ‘এই যে নৌকার গলুইয়ে চোখের ফর্ম ব্যবহার করেছ, এ নিয়ে পেইন্টিংয়ে তুমি কম্পোজিশন তৈরি করতে পারো।’ কথাটি তাঁর মনে একেবারে গেঁথে যায়। সেদিন থেকে সেই কম্পোজিশনে কাইয়ুম রাত জেগে পেইন্টিং আঁকা শুরু করলেন। ১৯৬১ সালে এই সিরিজের কয়েকটি চিত্রকর্ম তিনি জমা দিয়েছিলেন পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে আবেদিন সাহেবের মাধ্যমে খবর এলো তিনি তাঁর পেইন্টিংয়ের জন্য প্রথম পুরস্কার অর্জন করেছেন। এই সিরিজের কয়েকটি কাজ বিক্রিও হয়েছিল।

যাঁদের শিল্পচেতনায় আলোকিত হয়েছেন তিনি তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন এ দেশের আধুনিক চারুশিল্পের পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী কামরুল হাসান, ওপার বাংলার শিল্পী যামিনী রায়, পাশ্চাত্যের মাস্টার শিল্পী রেমব্রাঁ, ফ্রান্সিসকো গোইয়া, পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ প্রমুখ।

[পরবর্তী পর্বে লেখাটি শেষ হবে]

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field