রাহুযৈবন | সুমন মজুমদার
‘রাহুযৈবন’ বর্তমান সমস্যাসংকুল সময়ের সেই গল্প, যা জীবনকে বাউল ফকিরদের মারফতি চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে কালের ভেলায় চেপে চলেছে অনিশ্চিত গন্তব্যে। এখানে ক্ষমতার লড়াই, আধ্যাত্মিকতা, ভণ্ডামি, বিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতা যেন পরস্পরের মুখোমুখি। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার ছোট্ট জনপদকে ঘিরে এই আখ্যান আবর্তিত হলেও আসলে এ দেশের দুঃখজনক সামগ্রিক চিত্র। নিন্মবর্গের মানুষের এই গল্প আবহমান কাল ধরে চলে আসা চিরায়ত আখ্যান। শুরু হচ্ছে উপন্যাসটি।
পর্ব ২
এরকম কত কে কত টাকা পয়সা চুরি করে, চেয়ে নিয়ে গেল তাতে সত্তরোর্ধ্ব ইলিয়াস ফকিরের কোন বালটা ছেঁড়া গিয়েছে? অমর মানুষের এত টাকা-পয়সা লাগে না; লাগে কেবল ভাব। দেখা গেল যেদিন টাকা গিয়েছে সেদিন ঘরে এক দানা চালও নাই। সকাল থেকে দুপুর, সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি ফকির আর ফকিরি কন্যা লতা না খেয়ে ছিল। অবশ্য এরকম এক দুইদিন না খেয়ে থাকা ইলিয়াস ফকিরের জন্য কঠিন কিছু না। কিন্তু লতার তো ক্ষিদে লাগে। শেষ পর্যন্ত ঘরের আয়নাতে নিজেকে একটু দেখে, চোখে কাঁজল দিয়ে, মাই দুটোকে উঁচিয়ে যে-ই না বেরোতে যাবে, ওমনি কোথা থেকে ফকিরের ট্যাকে টাকা এসে হাজির।
অমর মানুষ ইলিয়াস ফকিরের আখড়াকে এমনিতে ঘর না বলে গোয়াল বলাই শ্রেয়। বাইরের ঝকঝকে তকতকে উঠান আর ফুলগাছের বাহার দেখলে মনে হয় এটা খুব সুন্দর গেরস্থবাড়ি হতে পারতো। একপাশে থাকতে পারতো লাউ কিংবা পুঁই শাকের মাচা অথবা নয়নতারার ঝাড়। তার ঠিক পাশেই হয়ত থাকতো মুরগীর খোপ। ঝাউখেলানো চুলের লতা হতে পারতো তেল জবজবে আঁচড়ানো কেশের ঈষৎ পৃথুলা গিন্নী। কিন্তু সেটা তো হয়নি বরং হয়েছে উল্টো। ইলিয়াস ফকিরের আখড়া মানে লোকে এই এক ঘরকেই বোঝে।
এখানে নিকানো উঠান পেরিয়ে কোন মতে চালা দেওয়া প্রায় অন্ধকার ঘরটাতে আসবাব বলতে কেবল সবে ধন নীলমনি এক চৌকি। তার উপর বিছানো দুই পরতের কাঁথা এমনই কালো আর ময়লা যে কত দিন ধোয়া হয় না কে জানে। বেড়া ঘেঁষে একপাশে টাঙানো দড়িতে ঝোলে ইলিয়াস ফকিরের লুঙ্গি, সাদা চাদরের মতো থান একটা কাপড়। অন্য পাশের বেড়ায় ঝোলানো পুরনো হয়ে আসা ব্লাউজ, জুবুথুবু মলিন ডুরে শাড়ি আর স্যালোয়ার সবিশেষ। এই শাড়ি ব্লাউজগুলো কার তা আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হয় না। তবু কোন নতুন লোক এসে দেখলে অবাক হয়। বলে, ইলিয়াস ফকির না বলে, লতা তার বউ, রক্ষিতা বা শরীর গ্রহীতা– এমন কিছুই না! মেয়িডাকে সে পালিচে নিজির সন্তানের মতো! তালি এরাম কইরি কেউ জুয়ান সোমত্ত মেয়ির সাতে এক ঘরে থাকে!
আসল বিষয় হলো, এই ঘরে লতা একাই থাকে। ইলিয়াস ফকির শোয় উঠানে পাটি বিছিয়ে। শুধু ঝড় বৃষ্টি এলেই পাটি ঘরের ভিতর যায়। তো ঘরের ভিতর ওই বিছানার কাঁথার নিচেই রাখা থাকে ফকিরের যাবতীয় ফকিরি সম্পত্তি। কারও জন্য কিছু না করেও ইলিয়াস ফকিরের ঠিকই কিছু ভক্ত আশেকান জুটে গেছে। এই যেমন মালয়েশিয়া থেকে সেবার ফকির বাবার জন্য অনেকগুলো টাকা পাঠালো মহিউদ্দিন শেখ।
দেশে থাকতে মহিউদ্দিন প্রায়ই ইলিয়াস ফকিরকে নিয়ে হাসাহাসি ঠাট্টা মশকরা করতো। দেশ ছাড়ার আগে কী কারণে যেন এক রাতে ফকিরের আখড়ার সামনে দিয়ে ফিরছিল। হঠাৎ দেখলো, আধো অন্ধকারে এক নিম গাছের ডালে বসে আছে আস্ত দুই চোখ ড্যাবড্যাবে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী। মহিউদ্দিনকে দেখে ব্যাঙ্গমা অদ্ভূত শব্দ করে আর ব্যাঙ্গমী উফ উফ করে গলা ফোলায়। ভয়ে মহিউদ্দিন যেই দৌড় দিতে যাবে, অমনি ব্যাঙ্গমা ঠিক দাদীর শোনানো নীলকমলের গল্পের মতোই মানুষের ভাষায় কথা বলে উঠলো। ব্যাঙ্গমা বলে, কী রে মহি, ভয় পালি ক্যান, আমরা কি ভূত না পেত্নি? একেনে ভূত আসপে কিরাম কইরি, ইলিয়াস ফকিরির ক্যারামতি আচে না!
তবু মহিউদ্দিনের ভয় যায় না। আর কয়দিন পরই মালয়েশিয়া যাবে, এখনই যদি অকালে প্রাণ হারায় তাহলে তার বউ বাচ্চাকে দেখবে কে! মহিউদ্দিন ভয়ে ভয়ে ইলিয়াস ফকিরের আখড়ার দিকে তাকায়। মনে হয়, অন্ধকারের মধ্যে ঘরের কাছে টিমটিমে রহস্যময় আলেয়া খেলছে। কৌতুহলী হয়ে দেখতে গেলেই আলেয়া ছুট মারবে সোজা পশ্চিমের পাগারের দিকে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মহিউদ্দিন আলেয়ার পিছন পিছন গেলে অশরীরি ভূত তাকে চুবিয়ে মারবে ওই পাগাড়ের পানিতে।
কিন্তু মহিউদ্দিন তো জানে, ইলিয়াস ফকির তার আখড়ায় উঠতি পোলাপান নিয়ে গাঁজা ভাঙ নেশা পানি করলেও এই জীবনে কারো কোন ক্ষতি করেনি। তাহলে আজ কেন তার সামনে এই ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী দেখা দিল! যদিও ব্যাঙ্গমা আশ্বস্ত করে, ভয়নি রে পাগল। আমরা দুজন ইলিয়াস ফকিরির পুষা। শোন, মালেশিয়া যা, তোর মেলা উন্নতি হবে। সেকেনে গিয়েও তুই ইলিয়াস ফকিররে পাবি।
সেদিন মহিউদ্দিন ঠিক কীভাবে বাসায় এসেছিল মনে নেই। তবে মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে আর ওমুখো হয়নি। তারপর বছর খানেক এমনিতেই কেটে যায়। কিন্তু মহিউদ্দিনের ঘোর ভাঙে কুয়ালালামপুরের কোটা দামানসারায়। মালিকের মালামাল নিয়ে সেবার সুবাং জায়া থেকে কোটা দামানসারায় গেছে। হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দেখে বাস, লরি, গাড়ির আসা যাওয়ার মধ্যে যেন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে ইলিয়াস ফকির। সেই ভাঙা চোয়াল, কাঁচা পাকা দাড়ি, সাদা-কালো বড় উস্কখুস্ক চুল, হাড়জিরজিরে শরীর। প্রথমে মহিউদ্দিন ভেবেছিল চোখে ধান্দা দেখছে। পরে দেখে ইলিয়াস ফকির তার দিকে এগিয়ে আসছে। অবশেষে চুয়াডাঙার আলমডাঙ্গার কোন দূরের বগাদী গ্রামের ইলিয়াস ফকির কুয়ালালামপুরে তার গাড়ির কাছে এসে বললো, কয়েলাম না আমার সাতে দ্যাকা হবে! যা, বাসায় যা। আমার আকড়ায় একখান নতুন ঘর তুইলবো। ট্যাকা পাঠাইস।
সেই থেকে ইলিয়াস ফকিরের কেরামতির উপর মহিউদ্দিনের ভক্তি এসেছে। একবার স্বপ্নেও দেখেছে ফকিরকে। অবশেষে দায়িত্ববোধ থেকেই ফকিরের জন্য বউয়ের মাধ্যমে দুই হাজার রিঙ্গিত পাঠিয়েছিল। বউকে বার বার বলেছে, ফকিরের কাছে তার মানত আছে। এই টাকা যেন ফকিরের আখড়াতে অবশ্যই যায়, নয়তো সবার সর্বনাশ হবে।
মহিউদ্দিনের টাকা পেয়ে অবশ্য ইলিয়াস ফকির ভালো মন্দ কিছুই বলেনি। শুধু টাকাটা নিয়ে চৌকির কাঁথার তলায় রেখে দিয়েছে। সেখান থেকে কখনো লতা টাকা সরিয়েছে, কখনো গাঁজা খেতে আসা পোলাপান। ইলিয়াস ফকির সব দেখেছে, সব বুঝেছে, তবু কেউ টাকা নেওয়ার সময় টু শব্দ করেনি। এমন কত টাকাই তো আসছে যাচ্ছে। টাকা আর কী করতে পারছে! যা কিছু ফকিরকে শান্তি দিতে পারছে তা হলো একটু গাঁজার ধোঁয়া আর ভাব চিন্তা। এমনকি গাঁজাটাও তাকে কিনে টানতে হয় না বরং নিরুপদ্রব নেশার আশায় পোলাপানই কোথা থেকে গাঁজা এখানে নিয়ে আসে। আর ফকিরের আখড়ায় এলে ফকিরকে ভাগ না দিয়ে তো ভোগ করা যায় না। শত হলেও ইলিয়াস ফকির অমর মানুষ, এসব গাঁজাটাজায় তার কিছু হবে না।
ইলিয়াস ফকির বুঝতে পারে গত রাতে এই ছেলেপেলের কেউ একজন ঘর থেকে টাকা নিয়েছে। সে নিজে এ বিষয়ে মাথা ঘামাতে চায়নি। কিন্তু লতা সকাল থেকে চিল্লানো শুরু করেছে। খানকি মাগির ছেলিরা, নটি মাগির ছেলিরা, শুয়োরের বাচ্চারা, চুরি করা ট্যাকা তোগের মার গুদির ভিতর ভইরি থুগা! আবার আসিস গ্যাঁজা খাতি, ঝাটা দি পিটেয়ে তোগের এক একটার পুটকি যদি লাল না করি দিয়েছি…
এমন আরও বিচ্ছিরি সব গালি দিয়ে সোমত্ত মেয়েটা চোরকে এমনই শাপশাপান্ত করতে লাগলো যে, চুরির কথা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। অবশ্য লতা যতই চেঁচাক ইলিয়াস ফকির চেষ্টা করেন, সেদিকে মনোযোগ না দিতে। তার চেয়ে সাধু ফকিরদের মতো কাঁধের সাদা কাপড়টা নিয়ে মাটি ঝেড়ে নেন। যথন নিশ্চিত হতে পারেন একটা পিঁপড়ে বা পোকাও সেখানে নেই, তারপর চিমটিতে কিছু মাটি তুলে কপালে ঠেকান। বিড়বিড় করে কী সব বলেন। অবশেষে পাছা পেতে আরাম করে বসেন। পাশেই একটা কদম ডালে কাক কা কা করছে। রোদের তাপে মাটিও গরম হয়ে আছে। ইলিয়াস ফকিরের মনে হয়, আহারে মাটির এই গরমের কষ্ট যদি কোনভাবে দূর করার ক্ষমতা তার থাকতো! কাঠফাটা রোদে তৃষ্ণার্ত মাটিতে ফকিরের জলের ধারা বইয়ে দিতে ইচ্ছা করে। আচ্ছা কাকটাও তো মনে হয় কিছু বলতে চায়।
ইলিয়াস ফকির কদমের ডালের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, কী রে কী বুলিস? হ, ছেইলিপিলি ট্যাকা নিয়ি গিছে। বাদ দে, এক ট্যাকা গিছে আরেক ট্যাকা আসপে। দেখিস, কয় দিনির ভিতর আরেকজন ট্যাকা দেবে। তবে কে দেবে তা একন বুইলবো না।
কাকটা ইলিয়াস ফকিরের কথা বোঝে কি না কে জানে, তবে কা কা থামিয়ে যেন মন দিয়ে পাখিটা শোনে। লতা ঘর থেকে বাইরে এসে দেখে, ইলিয়াস ফকির কদম গাছের সঙ্গে বিড়বিড় করছে আর হাসছে। হঠাৎ লতার রাগও যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সে ফকিরের পাশে বসে তার উদাম রোমশ রানের উপর হাত রেখে জিজ্ঞাসা করে, মনে হয় সব বুঝতি পাইরচু না? আমিও তাই আন্দাজ কইরছেলাম।
ফকির নিজের রান থেকে লতার হাতটা একবার সরিয়ে দিয়ে, আবার কাছে টেনে আগের জায়গায় রাখে। মৃদু হেসে বলে, শোন, আইজ রাতি আসর বসপে। ট্যাকা নিয়ি আর দুকখো করিসনি। রাইত হোক, দেকপি ট্যাকা এমনি এমনি আসপে তোর কাচে। তবে সাবধান, সবার কাছে যাবিনি।
লতা গম্ভীর মুখে তাকায় ফকিরের দিকে। বাবা, আমি জানি তুমার কাম-বাসনা নি। তুমার সাগরেদ মহাতাপ, তাকেও একই রকম বানায়িছ। তালি তুমরা লুকি লুকি আমারে কি দেকো? তুমি না বেশরা ফকির। কই, শরা ফকিররাও তো কুনুদিন এমন কইরি বলে শুনিনি।
ইলিয়াস ফকির লতার কথার জবাব দেয় না শুধু মিষ্টি করে হাসে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোর কি কেউ কুনু ক্ষতি করতি পারিছে? না এই ইলিয়াস ফকির থাকতি কেউ তোর কুনু ক্ষতি করতি পারবে! তবে খুব সাবধান, সবার কাছে যাইস নারে মা। কাম বিলানির জিনিস না, কাম শরীলির সাতে মন মিলানির জিনিস। তোকে সবাই চায়, আবার কেউ চায় না।
সেই চার বছর বয়স থেকে লতা আছে ইলিয়াস ফকিরের আখড়ায়। শুনেছে আলমনগর গ্রামে তার বাবা মারা গেছে বহু আগে। সবশেষ মা যখন অন্য ব্যাটার হাত ধরে ঘর ছাড়ে তখন তাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল পৈরুতলার সেই ঝাঁকড়া কুলগাছটার নিচে। সেখান থেকেই ইলিয়াস ফকির তাকে আখড়াতে তুলে এনে আদর যত্নে বড় করে তুলেছে। কিন্তু একটা মেয়ে মানুষ বড় হয়ে ওঠার পেছনে তো অনেক অনেক গোপন কথা থানের পর থান জমা হতে থাকে। তা বাপ হোক আর ভাই, মা ছাড়া অন্য কেউ তো টের পায় না। লতা এই উঠতি বয়সের কথাগুলো বলার জন্যও কাউকে পায়নি। কালে কালে নিজেকে অমর দাবি করা থুরথুরে বেশরা ফকির ইলিয়াস শুধু এমন ভাবের কথা আউড়েছে। রাগে লতা এক দফা থুথু ফেলতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করে নেয়। কারণ ইলিয়াস ফকির মাটিতে থুথু ফেলা পছন্দ করেন না। তিনি বলেন, এতে নাকি মাটি কষ্ট পায়, অপবিত্র হয়। মাটি হলো মা। মায়ের মুখে সন্তান কখনো এভাবে থুথু ফেলতে পারবে!
লতা কিছু না বলে রাগে উঠে পড়ে। যাওয়ার আগে মুখ ঝামটা মেরে ইলিয়াস ফকিরকে বলে, এই বাবা শোনো, তুমি মরবা না? ইদ্রিস হা হা করে হেসে বলে, না রে, আমি কুনুদিন মইরবো না। আল্লা যে আমারে বানায়িছে অমর।
(চলবে)
Leave feedback about this