যুদ্ধ গদ্য
তেহরান, ১৩ জুন ২০২৫। ওই দিন ‘ওপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে ইরানের রাজধানী তেহরানে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এই হামলায় অনেক প্রাণহানির মধ্যে একটা করুণ বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে। তেহরানের সত্তরখান নামের আবাসিক এলাকায় ইরানের এক তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল কবি পারনিয়া আব্বাসি নিহত হন। তাঁর উজ্জ্বল সৃষ্টিশীল ভবিষ্যৎ মুহূর্তেই নিভে যায়।
শত শত হাজার জায়গায়
আমি শেষ হয়ে যাই
আমি পুড়ি
ম্লান এক নক্ষত্র হয়ে উঠি
আবার তোমার আকাশেই আমি
অদৃশ্য হয়ে যাই।
একটি কবিতার কয়েক পংক্তি, লিখেছেন কবি পারনিয়া আব্বাসি। ওই হামলার ঠিক একদিন পরে, অর্থাৎ ১৪ জুন পারনিয়ার ২৪তম জন্মদিন উদযাপন করার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই পশ্চিম তেহরানের সত্তরখান এলাকায় ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। নিজেদের বাড়িতে পারনিয়া তার বাবা, মা এবং ১৬ বছর বয়সী এক ভাইয়ের সঙ্গে প্রাণ হারান। তার বাবা পারভিজ আব্বাসি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। মা মাসৌমেহ শাহরিয়ারি তিনিও একটা ব্যাংক থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ছোট ভাই পাহরাম আব্বাসি পড়তো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পারনিয়ার সঙ্গে ইরানের কোনো সামরিক প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক ছিল না। তিনি তেহরানের কাজভিন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানেই ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করছিলেন। তার পাঠ্যবিষয় ছিল অনুবাদতত্ত্ব ও অনুবাদ। সেই সঙ্গে তিনি ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতাও করছিলেন। কিছুদিন আগে ঢুকেছিলেন চাকরিতে – একটা ব্যাংকে। ব্যাংকটির নাম মেল্লি। এই চাকরিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছিল। জীবনে তিনি স্থির হতে পেরেছিলেন। এর মাধ্যমেই পেশাগত জীবনে তার স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল।
পারনিয়ার বন্ধুরা জানিয়েছেন, ‘খুব কোমল স্বভাবের নম্র স্নিগ্ধ তরুণী ছিল পারনিয়া। সবসময় একজন বড় কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখতো।’
‘তার সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয় ছিল কবিতা আবৃত্তি। আমি তাকে ঈর্ষা করতাম, কতশত কবিতা যে তার মুখস্থ ছিল।’
পারনিয়ার এই বর্বরোচিত মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর, কিছু ইসরায়েলপন্থী এবং ইরান সরকারের বিরোধীরা মিথ্যা প্রচারণা চালায় যে, পারনিয়া ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান ফেরেদৌন আব্বাসির মেয়ে। আব্বাসির সঙ্গে তাকেও হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু পরে জানা গেল, ফেরেদৌন আব্বাসির সঙ্গে তার কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না।
যে-ভবনে হামলা চালানো হয়, সেই ভবনটি এমনভাবে ধসে গিয়েছিল যে, তাদের সবার মৃতদেহ উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে। সত্তরখানের দশ ইউনিটের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ৪ নম্বর ব্লকে হামলাটি চালানো হয়। ওই হামলায় ভবনটির তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলার অ্যাপার্টমেন্টগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, ওই তলাগুলোর সব বাসিন্দাই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন।
‘সাধারণত মানুষ হয় সাহিত্যে অথবা গণিতে ভালো হয়। একইসঙ্গে এই দুই বিষয়ে পারদর্শী হয় না। কিন্তু পারনিয়া সাহিত্য ও গণিত, দুটো বিষয়ই ভালোবাসত। সাহিত্য ও কবিতা ছিল তাঁর আবেগ। সব সময় তাঁর হাতে আমরা কবিতার বই দেখতাম।’ এই কথাগুলো বলছিলেন তাঁর এক আত্মীয়। নিরাপত্তার কারণে তিনি সাংবাদিকদের কাছে নিজের নাম বলেননি।
সেই আত্মীয় পারনিয়া সম্পর্কে আরও জানান, ‘যেহেতু তার মা বহু বছর ধরে ব্যাংকিং পেশায় ছিলেন, তাই পারনিয়াও ‘সংখ্যা’ পছন্দ করতে শুরু করেন। স্বপ্ন দেখতে থাকেন মায়ের মতোই ব্যাংকে কাজ করবার। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণও হয়েছিল।’
পারনিয়ার আরেক বন্ধু, তার চাকরি পাওয়ার দিনটি সম্পর্কে বলেছেন : ‘সেদিন, তার চোখ দুটো আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝলমল করে উঠেছিল। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল – শেষ পর্যন্ত একটা স্থায়ী চাকরি মিলল। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। পারনিয়া ভ্রমণ করতে ভালোবাসত। সারা পৃথিবী ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত প্রকৃতির সান্নিধ্য।’
একটি নরম বিছানা। তার ওপরে রক্তেভেজা গোলাপি চাদর। চাদরের ওপরে ছড়িয়ে আছে পারনিয়ার রক্তেভেজা চুল। তার মৃত্যুর পর এরকম একটি ছবি ইরানে ভাইরাল হয়। ওই ছবিটা দেখে সবারই মন বিষণ্ন হয়ে পড়ে। বেদনায় শিউরে ওঠেন তারা।
নতুন করে ইসরায়েল জুনে ইরানে যে বোমা নিক্ষেপ করে, পারনিয়া হয়ে ওঠেন সেই আক্রান্ত সাধারণ মানুষের প্রতীক। সংবাদমাধ্যমের খবর, ওই হামলায় ইরানের অনেক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আক্রমণের শুরু থেকে দাবি করছিলেন তারা শুধু ইরানের সামরিক অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই যুদ্ধে ইরানে সাধারণ বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কয়েক শ ছাড়িয়ে গেছে।
জোহরা রাহনাভার্দ, যিনি মীর হোসেন মুসাভির স্ত্রী এবং ইরানের সংস্কারবাদী ‘গ্রিন মুভমেন্টে’র বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, গৃহবন্দী ছিলেন। ১৭ জুন এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানাতে গিয়ে তিনি পারনিয়ার নামোল্লেখ করেন।
পারনিয়ার আরেক বন্ধু বলেছেন, ‘তারা তো দাবি করছিল শুধু পারমাণবিক স্থাপনাতেই হামলা করা হয়েছে; তাহলে আমাদের প্রিয় পারনিয়া কীভাবে হামলার শিকার হলো?’
তিনি বলেন, ‘বেসামরিক নাগরিক হিসেবে নারীই সবার আগে যুদ্ধের শিকার হয়। এই যুদ্ধে তরুণ কবি ও অনুবাদক পারনিয়া আব্বাসি থেকে শুরু করে আরও অনেক নারী ও শিশু ইসরায়েলি আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছেন।’
জানা গেছে, শাহিদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক বিজ্ঞানী আবদুলহামিদ মিনৌশেরকে লক্ষ করে ইসরায়েল পারনিয়ারা যে ভবনে থাকতেন, সেই ভবনে হামলা চালায়। যদিও ওই বিজ্ঞানী ছিলেন হামলার প্রধান লক্ষ্য, কিন্তু তার ওপর হামলা চালাতে গিয়ে পারনিয়াসহ এলাকার অন্য বাড়িগুলোও ধ্বংস করা হয়। এই যুদ্ধে ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা আর এতে প্রায় ছয় জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন।
অথচ পারনিয়া বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন কবি। তাঁর ‘বিলীন হয়ে যাওয়া নক্ষত্র’ নামের কবিতাটির সম্পূর্ণ অনুবাদ এখানে তুলে ধরছি।
আমরা দুজন দুজনের জন্যই কাঁদছি
তোমার জন্য
এবং আমার জন্যও
তুমি আমার কান্নার নক্ষত্রকে
আকাশে উড়িয়ে দিলে
সেই তো তোমার পৃথিবী
সেখানেই আছে স্বাধীনতার যত আলো
আর আমার পৃথিবী
সেখানে ছায়াদের খেলা
অন্য কোথাও
তুমি আর আমি যেন শেষ হয়ে যাচ্ছি
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কবিতাও সেখানে
নীরব হয়ে যায়
অন্য কোথাও
তুমিই শুরু করো
জীবনের ফিসফাস থেকে বেরিয়ে এসে কাঁদো
শত শত হাজার জায়গায়
আমি শেষ হয়ে যাই
আমি পুড়ি
ম্লান এক নক্ষত্র হয়ে উঠি
আবার তোমার আকাশেই আমি
অদৃশ্য হয়ে যাই।
এই হচ্ছেন কবি পারনিয়া। পারনিয়া ইসরায়েলের হামলায় নিহত একমাত্র তরুণী ছিলেন না। কিন্তু তিনি ভবিষ্যতের উজ্জ্বল প্রাণবন্ত এক কবির যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, সেটাই তার মৃত্যুর পর আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ইরানি কবিতার ভুবনে পারনিয়া নতুন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তীব্র আবেগ আর অনুভূতির প্রকাশ হিসেবে পড়া হতো তাঁর কবিতা। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটির নাম ‘বিলীন হয়ে যাওয়া নক্ষত্র’। কবিতাটি ছাপা হয়েছিল জেন জি কবিদের নিয়ে প্রকাশিত সাময়িকপত্র ‘ভাজন-ই-দনিয়া’তে। একটু আগেই যে কবিতাটির অনুবাদ তুলে ধরেছি।
‘আমি যা কিছু দেখি, যা কিছু আমার বেলায় ঘটে, তার সবই আমি কবিতায় তুলে ধরতে পারি। আমার আবেগ আমি কবিতাতেই প্রকাশ করি।’ একটা সাক্ষাৎকারে পারনিয়া বলেছিলেন কথাগুলো।
প্রাণবন্ত জীবনের কথা আর আবেগের চমকপ্রদ সম্মিলনে নির্মিত তাঁর কবিতা।
তাঁর লেখা কবিতার মতো, যে-কবিতার কথা এই লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি; সব শেষ হয়ে গেল, পুড়ে গেল এবং মৃত নক্ষত্রের মতো আকাশে লীন হয়ে গেল। এই মৃত্যু মানবজাতিকে অপরাধী করে গেল।
কবিতার অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান
সূত্র : বিদেশি পত্রিকা
Leave feedback about this