তীরন্দাজ অনুবাদ
গাজায় ট্যাঙ্গো
আমি ভাবছিলাম আমাদের
প্রতিজ্ঞাগুলো নিয়ে।
আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম
ট্যাঙ্গো নাচতে শেখার।
চুমু খেতে এক
অচেনা সেনা চকে।
হাজারো ভয়ংকর চোখের সামনে
এইসব রীতিনীতি আলতো খেলিয়ে,
ভেবেছি এ গাজা যেন বুয়েনোস আইরেস,
আর উড়ে যেতে
কার্লোস গার্ডেলের সুরে
এমন একটা জীবন বাঁচতে
কেউ যা কখনো বাঁচেনি
নাচতে এমন নাচ
কেউ যা কখনো দেখেনি।
গাজার কেন্দ্রে
আমাদের দেখা হয়েছিল
গাজার কেন্দ্র
আমরা ছেড়ে চলে গেলাম
কখনোই প্রতিজ্ঞা করিনি
আমাদের প্রতিজ্ঞা রাখার।
এ ক্ষতের জানালার বাইরে
এ ক্ষতের জানালার বাইরে
পাহাড়ি গ্রামের ওপরে
আমাদের বাড়ি সেখানে
যা আমি কখনোই জানতাম না
আমি দেখেছিলাম
বুড়ো জলপাই গাছ
আর সেই ফ্লেমিঙ্গোকে স্বাধীনতা বলা হয়
এ ক্ষতের জানালার বাইরে
আমি পুরনো দিনের গান গাই
আমাদের রক্তাক্ত গ্রামের জন্য,
তারা ফিরে আসার চেষ্টা করছে
সেই শেবাবের জন্য যারা আহত হবে
অথবা খুন হবে তাদের স্বপ্নের সীমানায়
তাদের ছিঁড়ে যাওয়া ঘুড়ি, জ্বলন্ত টায়ার
আর ঘরে তৈরি মুখোশ নিয়েই।
এ ক্ষতের জানালার বাইরে
আমি আমার যুদ্ধে ছেঁড়া নিজের জন্য গাই
গাজোয়ারি অন্ধকারে আবদ্ধ থাকি
আমার শোয়ার ঘরে আরও দুঃসংবাদের অপেক্ষায়
যন্ত্রণায় বিপরীতে গান গাই
এখনও খুঁজি সেই ফ্লেমিঙ্গোদের।
এ জানালারও জানালার বাইরে
চামেলির মিষ্টি গন্ধ পাই
ঢেকে দিতে চেষ্টা করি দুর্গন্ধ সব
টায়ারের, কাঁদানে গ্যাসের আর
তাজা রক্তের
এ ক্ষতের জানালার বাইরে
আমি ফিসফিস করে আমার দাদু-ঠাকুমার নাম
শ্বাসে ধরে রাখি
যতক্ষণ না তারা ঘরে শ্বাস নিতে পারে
আর দেখে সেই ফ্লেমিঙ্গোরা নাচে
কারণ ক্ষতটি নিরাময় হয়েছে।
নগ্ন কবিতা
খেয়ে ফেলুন
কাছের পাখিগুলোর
ভুক্তাবশেষ,
অপরিচিত লোকের
রক্ত পান করুন,
লেবুগাছ লাগান,
আপনার গন্ধ পালটিয়ে দিন,
একটি প্রেতকে
বিদায় জানান, কোনও
সুফির বন্ধু হন,
একাই ভ্রমণ করুন
কোনও এক পরিত্যক্ত স্টেশন,
আপনার চাবি
আঁকড়ে রাখুন,¬¬
কিন্তু নিজেকে
জোর করবেন না
কখনো লিখতে একটি
নগ্ন কবিতা।
“কখন তুমি ফিরে আসবে…”
“বিক্ষিপ্ত মেঘগুলো প্রতারণা করে, এ
শহর ঘুমিয়ে পড়েছে, পায়রারা আমার
হৃদয়ে বসতি গড়ে, ফিরবে কখন তুমি,
যুদ্ধে বিরতি আজ, সাধুরাও নেমে এল
স্বর্গ থেকে, কখন ফিরবে তুমি, বাচ্চারা
ফিরে গেছে পঠনপাঠনে, গ্রীষ্ম তার ঝোলা
গুছিয়েছে, কখন আসবে ফিরে তুমি, কফি
তো নিজেই ভরে পাত্রে আমার, কখন
ফিরবে তুমি, বধির প্রতিজ্ঞাগুলি কথা বলে
আমার কানেতে, ফিরবে কখন তুমি,
বারান্দা ছেড়েছে আজ কোঁচকানো দেহ,
কখন আসবে ফিরে, বাড়ি নিয়ে বইগুলো
ছেড়ে গেছে তাক, কখন ফিরবে তুমি,
দুপুরের কবিতারা টুকরো কাচের মতো
ভেঙে যায়, কখন আসবে তুমি ফিরে।”
সে জানলার বাইরে তাকায়
সে মেয়েটি জানলার বাইরে তাকায়
কালো ধোঁয়া ঢেকেছে শহর
ধ্বস্ত বাড়ির অবশেষ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে
প্রশ্ন তার এতকিছু করে কী-বা হল,
এইসব থেমে যাবে কবে
যখন বোমারু বিমান ভেঙে পড়ে
যখন ন্যায়বিচার রুখে দেয় বাধাহীন পথ
যখন সমুদ্র আমাদের সবাইকে ঘিরে রাখে
বিস্ফোরণ থেমে এলে ক্রমে
তারপরে সে তার ছেলের মৃতদেহ কোল থেকে
কেড়ে নিয়ে নিয়ে যাওয়া দেখে কুঁকড়ে যায়।
ভালোবাসা কোনও ফাটা দেয়ালের ছবি নয়
ভালোবাসা কোনও ফাটা দেয়ালের ছবি নয়,
নয় সে পুরনো গান তোমার বুকেই বেঁচে থাকা,
নয় সে শারদ আলো রাতে ঘরে ফেরার আগেই
মরে যাওয়া, সে এমন রঙ নয় যা তোমার
গাত্রবর্ণে মেলে, এটা নয় পশুদের প্রতি
অসীম মমতা, ভারী কোনও ভাষা নয়, ভালোবাসা
নয় কোনও অকাজের পছন্দের নাম, ভালোবাসা
সে জায়গায় বাস করা নয় যেখানকার লোক
নও তুমি, ভালোবাসা কোনও কারণের জন্য
অন্য কিছু ত্যাগ করা নয়, ভালোবাসা প্রতিরোধ
বা ভাঙার নয়, এটা কোনও ঋতু নয় বয়ে
যাবে বলে, স্মৃতি যা বিবর্ণ হয়ে যাবে, নয়
শেষ আলিঙ্গন, এমন স্বপ্ন নয় যেটা তুমি
কখনো চাওনি, হৃদয়ের শূন্যতা নয় ভালোবাসা।
নিজেকেই খুঁজে পাই
নিজেকেই খুঁজে পাই জীবনের সেই সন্ধিক্ষণে
যখন বলতে হবে স্পষ্ট করে, যে আমার নেই
কবির প্রতিভা কোনো, এমনকি প্রস্তাবিত নয়
রূপান্তর-অস্তিত্বের দাবি। জন্মের মুহূর্ত থেকে
এই রাজ্যে প্রবেশ করেছি সুনির্দিষ্ট পরিচয় ছাড়া
কবিতার পঙক্তিগুলো দেখিয়েছে পথের নিশানা।
শব্দেরা ঢলে পড়ে হাত আমার রক্তাক্ত হয়, কোন এক
চার মাথা মোড়ে যেখানে কবিই ছিলাম— এখন তো
ফুল বিক্রি করি, বিকোতে পারিনি তবু একটাও কবিতা
কখনো।
সকালের সূর্য যেন ভাঙা জানালায় ছেঁকে আসে
আবেগের সংঘর্ষে শ্লোকগুলি জড়িয়ে রয়েছে।
রাফা ও গাজা পুরোপুরি ধ্বংসের পরে প্রকাশিত তিনটি কবিতা
১
হৃদয়ে রক্ত ঝরে
তার জন্য
যা সে দেখতে পায় আর যা দৃশ্যমান নয়।
[প্রকাশ ২০ মার্চ ২০২৫]
২
বিদায়ী শীতের জলে, ডোবাই আমার হৃদয়,
হাজার হাজার বার, যাতে এটি ভুলে যায়
খালি উঠোন এবং ছাউনিবিহীন শিবিরের
ঠান্ডা শরীরের অনুভূতি।
[প্রকাশ ১৮ মার্চ ২০২৫]
৩
মৃতদের কবিতা লিখো না;
এই বলে হিমশীতল দেহগুলি
একসারে অপেক্ষা করছে চলে যাবে বলে,
বসন্তের কবিতার মতো, নামহীন।
[প্রকাশ ১৪ মার্চ ২০২৫]
মোহাম্মদ মৌসা মোয়ে মুসা নামে পরিচিত। সম্ভবত আরবি ভাষার ভবিষ্যতের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল কবি। জন্ম গাজায় ১৯৯৪ সালে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। মাহমুদ দার্ভিশ ও আরবিতে অনূদিত রুশ উপন্যাস পড়ে শৈশবে সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। ২০১৪ সালে প্রথম কবিতা লেখেন এবং ২০১৫ সালে ৩২ জন তরুণ কবিকে নিয়ে ‘গাজা পোয়েট সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। স্পোকেন ওয়ার্ড কালচার গাজায় আনতে সচেষ্ট গাজা পোয়েট সোসাইটি। ডিসেম্বর ২৩-এ ইজারায়েলি বিমান হানায় মোয়ে মুসার পরিবারের সকলে নিহত হয়েছেন। কবিতা সংকলন ‘স্লটেড উন্ডস’ ‘ফ্লেমিংগো’।
কণিষ্ক ভট্টাচার্য (১৯৭৬)। সাহিত্যিক, ভারতীয় বাঙালি। জন্ম কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ। পড়াশোনা হেয়ার স্কুল। যাদবপুর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিষয় তুলনামূলক সাহিত্য, চলচ্চিত্রবিদ্যা ও বঙ্গভাষা ও সাহিত্য। পেশা শিক্ষকতা। গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিন দশক লেখালিখি করছেন। নিজস্ব লেখালিখি ছাড়াও অনুবাদ করেছেন আঁতোয়া দ্য সাঁত একজুপেরির দ্য লিটল প্রিন্স । অনুবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয় মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত বর্তিকা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম কার্ট ভনেগাট জুনিয়র অনুবাদ করেন। ২০১৭ সালে টগবগ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় হ্যারিসন বার্জেরন এবং টুবি ওর নট টুবি। আফ্রো আমেরিকান সাহিত্যিক ক্যাথলিন কলিন্স তিনি প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় দ্য স্কেপগোট চাইল্ড-এর অনুবাদ হাড়িকাঠের মেয়েটা। মিশরের কবি আহমদ আল শাহাওয়ের কবিতা আনুবাদ করেছেন, যা ‘বিস্ময় কলম কবিতার হৃদস্পন্দন’ সংকলনে সংকলিত। ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয় নাজওয়ান দারভিশ, হিন্দ জুদাহ্, রিফাত আল আরির, মোহাম্মদ মৌসা, মোসাব আবু তোহা ও নাদিন আলাওলসহ আটজন অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর বয়সী সাম্প্রতিক ফিলাস্তিনি কবির কবিতার অনুবাদ সংকলন ‘অলিভের রক্ত’।

