অনুবাদ গদ্য

ওত্তলাকে কাফকার চিঠি | মাসুদুজ্জামান অনূদিত | তীরন্দাজ কাফকা

জীবনের শেষ দিনগুলোতে ফ্রানৎস কাফকা থাকতেন বার্লিনে। সেখানে সর্বশেষ প্রেমিকা ডোরা ডায়মন্টের সঙ্গে ছোট্ট একটা ফ্লাটে বসবাস করছিলেন। এই সময় মেয়ে ভেরাকে নিয়ে ছোট বোন ওত্তলা প্রাহা থেকে ভাইকে দেখতে আসে। কয়েকদিন কাটিয়ে ফিরে যায় প্রাহায়। জানাশোনা ও ভাব হয়ে যায় ভাইয়ের প্রেমিকা ডোরার সঙ্গে।
দুই বোনের মধ্যে ওত্তলার সঙ্গেই কাফকার ছিল সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা। ওত্তলা বার্লিন থেকে ফিরে যাওয়ার পর কাফকা এই চিঠিটা ওত্তলাকে লেখেন। এর আগেই ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে একটা মস্ত গিফট্প্যাক কাফকাকে পাঠিয়েছিলেন ওত্তলা। তাতে বাবা-মায়ের দেওয়া অনেক জিনিসপত্র ছিল। ছিল তার নিজের পাঠানো উপহারও। কাফকা তারও আগে ভেরাকে উপহার দিয়েছিলেন বেশকিছু পুতুল। চিঠিতে যে পরিচালকের কথা আছে, তিনি ছিলেন কাফকার বস। তাকে জানিয়ে রাখতে চাইছিলেন যে কাফকা ছুটিতে থাকতে চান কিছুদিন।
এই চিঠিটি সেই সময়েই লেখা। চিঠিটা বোনকে লেখা কাফকার সর্বশেষ চিঠির আগের চিঠি। অর্থাৎ এর পর মাত্র একটা চিঠি কাফকা বোনকে লিখতে পেরেছিলেন।
এ মাসের ৩ তারিখ ছিল কাফকার জন্মদিন। সে উপলক্ষ্যে চিঠিটি প্রকাশিত হলো।


প্রাপক : ওত্তলা ও জোসেফ ডেভিড (ওত্তলার স্বামী)

[বার্লিন-স্টেগ্লিৎজ, মধ্য ডিসেম্বর ১৯২৩]

প্রিয় ওত্তলা,
দেখ, আমিও দেরিতে উত্তর দেই আর পরিচালককে লেখার মতো কোনও সাফল্য আমি পাইনি। কাজটা তোর অসাধারণ ছিল; অনেক, অনেক ধন্যবাদ তোকে। তুই যেভাবে বর্ণনা করে লিখেছিস, সেটা এত সহজে করেছিস যে, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। তুই নিশ্চিত যে আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস না? আসলে এটা তোদের পাঠানো অসাধারণ একটা প্যাকেজের চাইতে আরও অসাধারণ কিছু। ওজনে পনেরো কেজির কম হবে না, এটা ভেবেই আমি অনেকটা ভীত হয়ে পড়েছি। যা-ই হোক, আমি এজন্য বাবাকে ধন্যবাদ জানাতে সাহস পাচ্ছি না। আর তোকে লেখা এই চিঠির মাধ্যমে মাকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই। কিন্তু পনেরো কেজি আমার কাছে অনেক বেশি মনে হয় রে, এমনকি আমার চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি। কী আছে ওই প্যাকেজে? তোর পরিবারের পক্ষ থেকেও কিছু পাঠিয়েছিস নাকি? স্মৃতি হাতড়ে আমি তোর ভালোবাসার চিহ্নগুলো খুঁজছি। তুই তো অদেয় কিছুই অবশিষ্ট রাখিসনি। অবশ্যই, মাঝে মাঝে সকালে, বাবা যখন তোকে দেখতে আসতেন, তোর ঘরে সব ধরনের জিনিসপত্রই থাকত; কিন্তু এর কোনো কিছুই আমাকে পাঠানোর যোগ্য না। অদ্ভুত হচ্ছে, থালাবাসন এবং টেবিলক্লথগুলো ডি-কে (ডোরা – কাফকার প্রেমিকা) মুগ্ধ করেছিল। সে বলেছিল, এগুলো পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। এরকমই কিছু।


এই চিঠির সঙ্গে পরিচালককে লেখা আবেদনপত্রের খসড়া সংযুক্ত করে পাঠাচ্ছি। পেপাকে (ওত্তলার স্বামী) দয়া করে এটি অনুবাদ করতে বলিস। কিন্তু তার আগে অবশ্যই ভালো করে চিঠিটা পড়ে নিস। চিঠিতে পরিচালককে সব জরুরি কথা বলা আছে। আর অনুবাদ করবি সেই টোনে, যেভাবে আমি লিখেছি। উদাহরণস্বরূপ ধর, আমার ফিলিস্তিন যাওয়া সম্পর্কে কিছু বলবি না অথবা আমি যে বার্লিনে আছি, সে সম্পর্কে কিছুই বলবি না। আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবো যদি আমাকে চিঠিতে এসব কথা তাকে বলতে না হয়। আবেদনপত্র কী পরিচালককে ব্যক্তিগতভাবে সম্বোধন করে লেখা উচিত, নাকি ইনস্টিটিউটকে (কাফকার কর্মস্থল)? যদি ইনস্টিটিউটকে লিখতে হয়, সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে। তবে পরিচালককে লেখাই যথেষ্ট হতে পারে। অফিসিয়াল এই চিঠির পাশাপাশি, আমি কি পরিচালককে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ দিয়ে নোট পাঠাব (লিখতে হবে জার্মান ভাষায়)? এটা অবশ্য নির্ভর করবে পরিচালক সম্পর্কে তোর ধারণা কী, তার উপর।

ওত্তলা

এ মাসে তোর এত ভালো লাগছে কেন? স্পষ্টতই তুই পুতুলগুলো অনেক লাভে বিক্রি করে দিয়েছিস। কিন্তু অন্যদিকে ভেরা (ওত্তলার কন্যা) তোকে লিখতে পারে, অনুমান করছি, কোনো পুতুলের পেটে কান রেখে পুতুলের পেট থেকে বেরুনো কথা শুনতে চাইবে হয়তো। যা-ই হোক, যদি পুতুলটি এমন কিছু না করে, তাহলে ভেরার বার্লিন সম্পর্কিত ধারণা চূড়ান্তভাবে প্রভাবিত হবে। কত টাকা পেয়েছিস সেটা আর বলিস না। যে কদিন আমি তোর ওখানে ছিলাম (তোর মনে আছে, একটা হিব্রু প্রবাদের উল্লেখ করে আমি তোর মুটিয়ে যাওয়া নিয়ে বলেছিলাম); আমি যত্ত কাগজ নিয়ে লেখালেখি করেছি, সেই কাগজগুলো তুই-ই আমাকে দিতি, কলমটাও দিয়েছিলি, এইসব; কেউ যদি খুব ব্যয়বহুল উপায়ে বার্লিন ভ্রমণ করতে না চায়, তাহলে আমার অতিথি হয়ে আসতে পারে। শুভকামনা। আর আমার জন্য তোরা দুজন নিজেদের ক্ষতি করিস না। ডাক্তার কায়সারের কথাও ভাবিস না, তার সঙ্গে টাকাপয়সা আছে।
এফ.

এই চিঠির সঙ্গে ডোরা ডায়মন্টের একটা ছোট্ট নোট ছিল। ডোরা তার কথাগুলো লিখেছিলেন, কাফকার চিঠির শেষ দুই প্যারার মাঝখানের সামান্য ফাঁকা জায়গায়! ডোরা লিখেছিলেন :
আমি খুব সংক্ষেপেই দু-একটি কথা লিখছি, ভাই। খুব কাজের কথা হবে না যদিও। ভেরার বার্লিন সম্পর্কে কী ধারণা হলো, সেটা জানার জন্য আমি মুখিয়ে আছি (এই চিঠি লেখার অল্প কিছুদিন আগেই মা ওত্তলার সঙ্গে ভেরা কাফকার বার্লিনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। বলা প্রয়োজন, কাফকা ও ডোরা বার্লিনে একসঙ্গে থাকতেন। – অনুবাদক)।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field