Site icon তীরন্দাজ

সৈয়দ তারিক | ইবনে আরাবির দর্শন ও কবিতা | তীরন্দাজ অনুবাদ

তীরন্দাজ অনুবাদ


মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবি (১১৬৫–১২৪০ খ্রিস্টাব্দ) ইসলামি দর্শন, সুফিবাদ ও মরমিভাবনার এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁকে ‘শায়খুল আকবর’ (মহত্তম শিক্ষক) ও ‘আল-আরিফ বিল্লাহ’ (আল্লাহর জ্ঞানে পূর্ণ ব্যক্তি) বলা হয়। তাঁর দর্শন, সাধনা ও কবিতা সুফি চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব রেখেছে। ইবনে আরাবির রচনাবলি যেমন ‘ফুসুস আল-হিকাম’ (প্রজ্ঞার রত্নসমূহ) এবং ‘আল-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়্যাহ’ (মক্কার উন্মোচনসমূহ) আজও পণ্ডিত ও আধ্যাত্মিক সাধকদের অনুপ্রাণিত করে।
ইবনে আরাবি ১১৬৫ খ্রিস্টাব্দে আন্দালুসিয়ার (বর্তমান স্পেন) মুর্সিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ ইবন আল-আরাবি আল-হাতিমি আত-তাই। তার পরিবার ছিল অভিজাত বংশীয়। পিতা আলি ইবনে আল আরাবি ছিলেন কর্ডোভার প্রধান বিচারপতি। তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বিখ্যাত দাতা হাতেম তায়ী।
তার বাল্যকালেই তাদের পরিবার সেভিল শহরে স্থিত হয়। এই শহরেই তিনি শিক্ষাদীক্ষা লাভ করেন, এখানেই তার ধ্যান-জ্ঞান বিকশিত হয়। সেভিল শহর ছিল মধ্যযুগের সুফিবাদ চর্চার কেন্দ্রস্বরূপ। এ শহরেই অনেক বিখ্যাত সুফির সাক্ষাৎ লাভ করেন তিনি। অনেক বিদুষী নারীর সান্নিধ্যে আসেন, যাদের গভীর প্রভাব তাঁর পরবর্তী জীবনে দেখা যায়।
সেভিলের সব বিখ্যাত শিক্ষকের কাছে আরবি ব্যাকরণ, কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিসের ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র এবং ফিকহশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন তিনি। কৈশোরেই আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। সমকালীন বিখ্যাত সুফিদের সঙ্গে তার সঙ্গ হয়। তরুণ বয়সেই আনুষ্ঠানিকভাবে সুফিবাদকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন তিনি।
আরাবির বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১৯ বছর বয়সে এলহাম তথা দিব্য নির্দেশনায় তিনি সুফিবাদের দিকে এগিয়ে যান। এ সময় তিনি শহরের ভোগবিলাসী পরিবেশ ত্যাগ করে বহুদূরে একটি গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে ‘জিকরুল্লাহ’ বা আল্লাহর জিকির শুরু করেন। তার এই ধ্যান ভাঙে চার দিন পর! সেদিন গুহা থেকে বের হয়ে তিনি বুঝতে পারেন নিজের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন চলে এসেছে। তিনি দিব্যজ্ঞান লাভ করেছেন!
এই ঘটনার পর আল আরাবির জীবনধারা চিরদিনের মতো পাল্টে যায়। তিনি প্রায় চৌদ্দ মাস একটানা নিভৃতে জীবনযাপন করেন। এ সময় তিনি কেবল একজন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করতেন, কথাবার্তা বলতেন। তিনি হচ্ছেন তার দীক্ষাগুরু শেখ ইউসুফ বিন ইউখালফ আল কুমি। টানা চৌদ্দ মাসের নিভৃতযাপন শেষে তিনি নিজের বাসস্থানে ফিরে গেলেও পেশাকর্মে আর যোগ দেননি। অর্থ সম্পদের মোহ ত্যাগ করে তিনি কেবল জিকির আজগারে সময় ব্যয় করতেন।
আরাবির আধ্যাত্মিক গুণের কথা ছড়িয়ে পড়ে পুরো আন্দালুসিয়ায়। দার্শনিক ইবনে রুশদ ছিলেন আরাবির বাবার বন্ধু। আরাবির বাল্যকালে দেখা হয়েছিল দুজনের। আরাবির আধ্যাত্মিক খ্যাতি শুনে ইবনে রুশদ তার সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ বোধ করলেন। দেখা হলো। পরস্পরের এই দেখা হওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। রুশদ ছিলেন আপাদমস্তক যুক্তিবাদী মানুষ, যিনি সকল প্রকার জ্ঞানকে যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করতেন। অন্যদিকে আরাবি তখন আধ্যাত্মিক ঘরানার স্বজ্ঞাবাদী ভাবুক। তবু এই সাক্ষাৎ দুজনের জন্যই তাৎপর্যপূর্ণছিল।
ইবনে রুশদ আরাবিকে আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে নানা প্রশ্ন করেন, দিব্যজ্ঞানের আগমন সম্পর্কে জানতে চান। তাছাড়া আরাবির নিভৃতে জীবন যাপনের নানা দিক নিয়ে জানার কৌতূহল দেখান তিনি। আরাবির সাথে এই দেখা হবার পর আধ্যাত্মিকতা নিয়ে পুনরায় চিন্তভাবনা শুরু করেছিলেন রুশদ। অন্যদিকে আরাবিও দর্শনের খুঁটিনাটি জানবার সুযোগ পান। আরাবি নিজেও একজন প্রজ্ঞাবান দার্শনিক ছিলেন, তবু রুশদের প্রতি তাঁর ছিল শ্রদ্ধা-সম্মান। আধ্যাত্মিকতার মধ্যে থেকেও কীভাবে দার্শনিকভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করা যায়, আরাবি সেই প্রেরণা রুশদের কাছেই পেয়েছিলেন।
ফাতিমা বিনতে আল-মুসান্না ছিলেন আন্দালুসিয়ার একজন পবিত্রাত্মা নারী, যিনি সুফিপথে উচ্চ মাকাম তথা আধ্যাত্মিক স্তর অর্জন করেছিলেন। ইবনে আরাবি তাঁর লেখা ‘রুহ আল-কুদস’ গ্রন্থে ফাতিমার সাক্ষাৎকার ও তার বাণীগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। ইবনে আরাবি তরুণ বয়সে ফাতিমার সাক্ষাৎ পান এবং তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হন। ফাতিমা তাঁকে আধ্যাত্মিক সত্য ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথে নির্দেশনা দেন। ফাতিমা বলতেন, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য বাহ্যিক ইবাদতের চেয়ে অন্তরের বিশুদ্ধতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইবনে আরাবিকে উপদেশ দিয়েছিলেন : ‘তুমি যদি আল্লাহকে চাও, তবে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাগ্রচিত্তে তাঁর দিকে ধাবিত হও।’ ফাতিমার শিক্ষা ইবনে আরাবির সুফি দর্শন গঠনে ভূমিকা রেখেছিল, বিশেষত ওয়াহদাতুল ওজুদ (সৃষ্টির একত্ব) এর ধারণায়।
ফাতিমা নারীদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতায়নেরও প্রতীক ছিলেন, যাসেই সমাজে বিরল ছিল। তিনি নারীদের আধ্যাত্মিক মর্যাদা সম্পর্কে ইবনে আরাবির দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করেছিলেন। ফাতিমা নারী সাধকদের মধ্যে একজন উজ্জ্বল উদাহরণ, যিনি প্রমাণ করেন যে, আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ নারী-পুরুষ সবার জন্যই উন্মুক্ত। তাঁর জীবনী সুফিবাদে নারীদের অবদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ইবনে আরাবি তাকে ‘আমার আধ্যাত্মিক মা’ বলে সম্মান করতেন।
সফরে সফরে বেশ একটা সময় কাটান ইবনে আরাবি। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিউনিসিয়া, ফেজ, মারাক্কেশ, বাগদাদ, সিরিয়া, কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়াসহ সে সময়কার মোটামুটি সববিখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্রগুলোতে গমন করেন। এরপর হজব্রত পালনের জন্য মক্কায় যান। কাবা শরিফ প্রদক্ষিণের সময় আবার এহলাম তথা গায়েবি নির্দেশ আসে তাঁর কাছে। মক্কায় কিছুকাল অবস্থান করতে বলা হয় তাঁকে। মক্কায় তিনি চার বছর অবস্থান করেন। এ সময় চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। এদের মধ্যে ‘মিশকাত আল আনওয়ার’ বা হাদিস সমগ্র ও ‘রুহ আল কুদুস’ বা আন্দালুসিয়ার সুফিদের জীবনী গুরুত্বপূর্ণ। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, মক্কায় থাকাকালেই ইবনে আরাবি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’ রচনার কাজ শুরু করেন।
পরে তিনি দামেস্কে গিয়ে স্থিত হন। এখানেই তিনি তাঁর অর্জিত আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা সম্পন্ন করেন ‘ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’। ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে এখানেই লোকান্তরিত হন তিনি। তাঁর মাজার শরিফও এখানেই অবস্থিত।
ইবনে আরাবির রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো : ‘আল ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’ (দ্য মাক্কান ইলুমিনেশন) : এটিকে ইবনে আরাবির শ্রেষ্ঠ রচনা ধরা হয়। ‘ফুসাস আল হিকাম’ (দ্য রিংটোন অব উইজডম) : এটিকে অনেক সময় ইবনে আরাবির জীবন ও দর্শনের সারসংক্ষেপ বলা হয়ে থাকে। ‘দিওয়ান’ : আল আরাবীর কবিতাসমগ্র। ‘রুহ আল কুদস’ (হোলি স্পিরিট ইন দ্য কাউন্সেলিং অব দ্য সোল) : আন্দালুসিয়ায় থাকাকালে নিজের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে লিখেছেন এই বই। বইটি সেকালের সুফিদের জীবনী-নির্ভর রচনা। ‘মাসাহিদ আল আশরার’ (কনটেমপ্লেশন অব দ্য হোলি) : নিজের জীবনের মোট ৬টি দৈবঘটনা এবং আদেশ নিয়ে লিখেছেন এই বই। ‘মিশকাত আল আনওয়ার’ (হাদিস সংকলন) : ১০১টি গুরুত্বপূর্ণ হাদিসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ‘তারজুমান আল আশওয়াক’ (দ্য ইন্টারপ্রেটার অব ডিজায়ারস) : স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও ভাগ্য বিষয়ক আলোচনা। ‘আইয়াম আল শা’ন’ (দ্য বুক অব গড’স টাইম) : সময়ের উৎপত্তি ও প্রবাহ নিয়ে দার্শনিক আলোচনা। ‘উনকা মুঘরিব’ : সুফিবাদের সংজ্ঞা ও বিস্তারিত।
ইবনে আরাবির দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ তথা অস্তিত্বের একত্ব। এই একত্ব বোধ অনুসারে সমগ্র সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর প্রকাশ মাত্র। তিনি বিশ্বাস করতেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই; সবকিছুই তাঁরই প্রতিচ্ছবি। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা নন কিংবা বিশ্বসংসার তার থেকে আলাদা নয়। বরং, সমগ্র মহাবিশ্ব তাঁর মাঝেই নিমগ্ন আছে। কিন্তু তাঁর এই গভীর চিন্তা সমকালীন অনেকেই ধরতে পারেনি। ফলে তাঁকে ‘সর্বেশ্বরবাদী’ উপাধি দেয় অনেকে এই যুক্তিতে যে, তিনি সর্বত্র সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি বিরাজমান বলেছেন হেতু তিনি সবকিছুকেই সৃষ্টিকর্তা বিবেচনা করেন! ভারতীয় অদ্বৈতবাদ কিংবা গ্রিক দর্শনের সঙ্গে সাদৃশ্য পেয়ে তাঁর মতবাদকে ভ্রান্ত ভাবেন কেউ, কেউ বলেন কুফরি।
অথচ এই দর্শনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানুষ যেন আল্লাহকে উপলব্ধি করতে পারে আপন সত্তায়। মানুষ যেন তার অন্তর্নিহিত শক্তি আর সম্ভাবনাকে বুঝতে পারে। যিনি সঠিকভাবে নিজের সত্তা উপলব্ধি করে আত্মক্ষমতা উন্মোচন করতে পারবেন, তিনি ‘ইনসান আল কামিল’ বা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবেন। এই দর্শনে অত্যন্ত আশাপ্রদভাবে মানুষের জন্য পরিপূর্ণ রূপে বিকশিত হয়ে ওঠার প্রণোদনা রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা যেমন তাঁর সৃষ্টির মাঝে বিরাজমান, তেমনই তাঁর মাঝেই সকল সৃষ্টি নিহিত আছে। একজন যথযথ পূর্ণাঙ্গ মানুষও তার কাজের মাঝেই বিদ্যমান। অধ্যবসায় আর সাধনার মাধ্যমেই কেবল মানুষ পূর্ণতা লাভ করতে পারে। আর যিনি পূর্ণতা লাভ করেন, তিনি সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারেন। ‘যে নিজেকে জেনেছে, সে তার রবকে জেনেছে’ – এই আপ্তবাক্যটি আরাবির দর্শনের মূলতত্ত্ব।
ইবনে আরাবি শুধু দার্শনিকই নন, একজন গুরুত্বপূর্ণ কবিও। তাঁর কবিতায় প্রেম, আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর সাথে মিলনের আকুতি প্রকাশ পায়। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতাংশ :

আমি হৃদয়ের এমন অবস্থায় আছি,
যে অবস্থায় আমার কোনো মুখ নেই অথবা হাত নেই।
আমি ভালোবাসি, কিন্তু আমার কোনো প্রাণ নেই,
কেননা আমার অস্তিত্ব এখন আমার প্রেমিকেরই অস্তিত্ব।

তাঁর ভাবধারায় ধর্মের সারমর্ম হলো প্রেম : ঈশ্বর তথা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা আর একই সাথে তা সকল সৃষ্টির প্রতিও ভালোবাসা। তাঁর এই দর্শন তাঁর কবিতায় চমৎকারভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। তাঁর কবিতাগুলোতে প্রেমকে আল্লাহর দিকে যাত্রার মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। তিনি প্রেমিক ও প্রেমিকার রূপক ব্যবহার করে বোঝান যে, প্রকৃত প্রেম হলো আল্লাহর সাথে মিলনের সাধনা। এ কারণেই তিনি প্রত্যয় নিয়ে বলতে পারেন :

আমি প্রেমধর্মে বিশ্বাসী;
প্রেমের কাফেলা যে-পথে চলে
সেই পথেই আমার বিশ্বাস,
আমার ঈমান।

১.

তোমার চোখ দিয়ে নয় –
তোমার মাধ্যমে আমি নিজেকে দেখি,
আমার চোখ দিয়েই তুমি আমাকে দেখো,
নিজেকেও।

হে প্রিয়তম,
আমি তোমাকে বারবার ডেকেছি,
কিন্তু তুমি শোনোনি।

আমি নিজেকে তোমার সামনে উপস্থিত করেছি বহুবার,
কিন্তু তুমি দেখোনি।

আমি সুবাস হয়েছি,
তবু তুমি আমার গন্ধ পাওনি।

আমি স্বাদসমৃদ্ধ খাদ্যে রূপ নিয়েছি,
তুমি আমায় আস্বাদ করোনি।

তুমি যে বস্তু ছুঁয়ে দেখো,
তার মধ্য দিয়ে কেন আমাকে স্পর্শ করোনি?

সুগন্ধি বায়ুর ভিতর দিয়ে
আমাকে কেন অনুভব করোনি?

তুমি কেন আমাকে দেখো না?
কেন শোনো না?
কেন? কেন? কেন?

২.

ওগো বিস্ময়! অগ্নিশিখার মাঝে একটি উদ্যান!
আমার হৃদয় ধারণ করতে পারে যে-কোনো রূপ :
হরিণের জন্য তৃণভূমি, সন্ন্যাসীদের জন্য আশ্রম,
মূর্তির জন্য পবিত্র ভূমি, তাওয়াফকারী হাজিদের জন্য কাবা,
তাওরাতের পাতা, কুরআনের আয়াতসমূহ।

আমি প্রেমধর্মে বিশ্বাসী;
প্রেমের কাফেলা যে পথে চলে,
সে-পথেই আমার বিশ্বাস, আমার ঈমান।

৩.

নিজের হাতে আমি আমার ছোট মেয়েকে কবরে শুইয়ে দিলাম,
কারণ সে ছিল আমারই মাংসপিণ্ডের অংশ,
এই বিচ্ছেদের নিয়ম মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি আমি—
এখন আমার হাত খালি, কিছুই নেই তাতে।

আমরা বাঁধা পড়ে আছি বর্তমান মুহূর্তে,
যা এসেছে গতকালের মধ্য হতে
আর এগিয়ে যাচ্ছে আগামীকালের দিকে।

আমার এই শরীর খাঁটি রূপার মতো,
আর আমার অন্তর্জগৎ খাঁটি সোনার মতো।
আমি বাঁকা হয়ে গেছি এক ধনুকের মতো,
আমার প্রকৃত গঠন, আমার পাঁজরের মতোই।

আমার প্রভু বলেন,
তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন দুঃখ ও ক্ষতির মাঝে।
তাহলে, আমি কীভাবে আশা করতে পারি
বিশ্রামের কোনো স্থান এখানে –
এই দেহে, এই অবস্থায়?

৪.

আমি বিস্মিত তাঁর নির্মিত গৃহ দেখে –
তিনি গড়েছেন তা যত্নসহকারে,
এক মহৎ আত্মাকে সেখানে রেখেছেন, তারপর তাকে ফেলেছেন এক পরীক্ষায়।
তিনি সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছেন সেই গৃহটিকে –
যেন তিনি একে কখনো নির্মাণই করেননি।

কে একে আবার গড়বে আমার জন্য?
কে একে চিরস্থায়ী করতে পারে?
তিনি তো জানতেন ঠিক কী নির্মাণ করছেন –
যদি আমি জানতে পারতাম যা তিনি জানেন!

প্রথমেই তিনি কেন গড়লেন না এমন এক গৃহ
যা কখনোই লুপ্ত হয়ে যাবে না?
এই ঘর করেনি তো এরকম কিছু যাতে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
তবে কেনই-বা গড়লেন তিনি একে,
আর কেনই-বা ধ্বংস করলেন?

বিচারের হাত আমাদের সাথে খেলা করল,
তার সাথেও – তারপর একসময়
আবার গড়ল তাকে, তুলে ধরল ঊর্ধ্বে।

আত্মা ফিরে এলো গৃহে,
সিংহাসনে বসলো মহারাজের মতো,
তার অধিবাসীদের দিল অমরত্ব,
সেই গৃহকে আশীর্বাদ করল অমরাবতী দিয়ে, এক চিরন্তন উদ্যান দিয়ে,
তাকে করল বেহেশতের অধিবাসী, আশ্রয়প্রাপ্ত।

৫.

যখন সে চোখের চাহনিতে হত্যা করে,
তার উচ্চারণ আবার জীবন ফিরিয়ে আনে –
যেন এইভাবে জীবন দিয়ে সে হজরত ইসা।

তার পায়ের মসৃণ অবয়ব তাওরাতের মতো দীপ্তিময়,
আর আমি তাকে অনুসরণ করি,
তাঁর পদচিহ্নে চলি, যেন আমি মুসা।

সে এক নারী বিশপ,
রোমের কন্যাদের একজন, অলংকারবিহীন;
তবে তাতে জ্যোতির্ময় সৌন্দর্যই চোখে পড়ে।

সে বুনো – কেউ তার বন্ধু হতে পারে না; নির্জনতার কক্ষে বসিয়েছে সে স্মৃতির সমাধি।

সে বিভ্রান্ত করেছে আমাদের ধর্মজ্ঞানীদের সবাইকে,
দাউদের গীতসংহিতার পাঠকগণকে,
ইহুদি বিদ্বান ও খ্রিস্টান যাজকদের।

যদি সে ইশারায় গসপেল দাবি করে,
তবে আমাদের দেখা যাবে যাজক, পিতৃপুরুষ আর ডিকন হিসেবে।

যেদিন তারা পথে যাত্রা করেছিল,
সেইদিন আমি প্রস্তুত করেছিলাম ধৈর্যের সৈন্যদল –
বাহিনীর পর বাহিনী।

৬.

সে যখন বিদ্যুৎ দেখল পূর্বদিকে, তার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল পূর্বের প্রতি,
তবে যদি পশ্চিমে বিদ্যুৎ চমকাতো, সে পশ্চিমকেই ভালোবাসত।

আমার আকাঙ্ক্ষা কেবল সেই বিদ্যুৎ ও তার দীপ্তির প্রতি,
নয় কোনো স্থান বা ভূমির প্রতি।

পূর্বের বাতাস আমার কাছে বয়ান করল একটি বংশানুক্রমিক হাদিস –
উন্মাদনা থেকে,
আমার প্রেম থেকে,
আমার যন্ত্রণা থেকে,
আমার দুঃখ থেকে,
উল্লাস থেকে,
আমার প্রজ্ঞা থেকে,
আমার আকুলতা থেকে,
আমার উত্তাপ থেকে,
আমার অশ্রু থেকে,
আমার চোখের পাতা থেকে,
আগুন থেকে,
আমার হৃদয় থেকে:

‘যাকে তুমি ভালোবাসো, সে তোমার পাঁজরের ভিতরেই;
শ্বাসের দোলায় সে দুলে চলে এদিক-সেদিক।’

আমি পূর্বের বাতাসকে বললাম :
‘তাকে এক বার্তা দাও –
বল, সে-ই আমার হৃদয়ের আগুন প্রজ্বলনের কারণ।

যদি আগুন নিভে যায়, তবে তা চিরন্তন মিলনের প্রতীক,
আর যদি তা জ্বলে ওঠে, তবে প্রেমিকের কোনো দোষ নেই!’

৭.

এগিয়ে যাও সেই প্রিয়জনদের নিবাসের দিকে,
যারা প্রতিজ্ঞা করেছিল ভালোবাসার –
তাদের গৃহের উপর অবিরাম বৃষ্টিধারা বর্ষিত হোক!

শ্বাস নাও সেই বাতাসে,
যা আসে তাদের ভূমির দিক থেকে –
আশায় থাকো, যেন সেই মৃদুমন্দ হাওয়া তোমাকে বলে দেয়, তারা কোথায়।

আমি জানি, তারা তাঁবু ফেলেছিল ইদামের বন-গাছে,
যেখানে জন্মায় আরার, শিহ, আর কাতাম উদ্ভিদ।

৮.

বিস্ময়ে দেখি আমি মহাসাগর তটবিহীন,
আর দেখি এমন একটি বেলাভূমি যার পাশে কোনো সমুদ্র নেই;
আমি দেখি এমন এক প্রভাত, যার নেই কোনো অন্ধকার,
আর এমন এক রাত্রি, যার কোনো ভোর নেই।

আমি দেখি এমন এক গোলক, যার নেই কোনো অবস্থান –
না মূর্খ জানে তা, না বিদ্বান বুঝতে পারে;
আমি দেখি এক নীল গম্বুজ, পৃথিবীর উপরে ওঠানো,
যা ঘুরে চলে কেন্দ্রবিন্দুর চারপাশে – নাম তারবাধ্যবাধকতা।

আমি দেখি এক ধনবান পৃথিবী, যার উপর নেই কোনো গম্বুজ,
এবং যার কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই –
এ এক গূঢ় রহস্য, আড়ালে রাখা…

৯.

মেয়েটি বলল :
আমি বিস্মিত হই সেই প্রেম দেখে
যা গর্বভরে হাঁটে
বাগানের প্রস্ফুটিত হতে থাকা
পুষ্পসমূহের মাঝ দিয়ে।

আমি বললাম :
তুমি যা দেখছো তাতে বিস্মিত হয়ো না।

তুমি তো আসলে নিজেকেই দেখছো
এক পুরুষের আয়নায়।

১০.

আসেন যখন প্রিয়তম
কোন চোখে দেখি আমি তাকে?
তারই চোখে : আমার দৃষ্টি দিয়ে নয় কক্ষনো,
কারণ দেখে না তাকে তিনি ছাড়া আর কোনো কেউ।

Exit mobile version