মরমীকাব্য
সন্ত জ্ঞানেশ্বর (Jnaneshwar) মহারাষ্ট্রের ভক্তি আন্দোলনের একজন প্রধান সাধক, দার্শনিক ও কবি। তিনি জ্ঞানদেব নামেও পরিচিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব তিনি। মারাঠি ভাষায় তিনিই ভক্তি সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর জীবন, দর্শন, সাধনা ও কবিতা মারাঠি সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর রচিত ‘জ্ঞানেশ্বরী’ (ভগবদ্গীতার মারাঠি টীকা) ও ‘অমৃতানুভব’ তাঁর দার্শনিক গভীরতা ও কাব্যিক প্রতিভার পরিচয় বহন করে।
জ্ঞানেশ্বর আনুমানিক ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের পৈঠান শহরের কাছে আপেগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বিঠ্ঠলপন্ত কুলকার্নি ও মায়ের নাম রুক্মিণীবাঈ। তারা ছিলেন ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ। জ্ঞানেশ্বরের তিন ভাইবোন ছিলেন – নিবৃত্তিনাথ (জ্যেষ্ঠ), সোপানদেব (কনিষ্ঠ) এবং মুক্তাবাঈ (কনিষ্ঠা)। বিঠ্ঠলপন্ত সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু গুরু রামানন্দ স্বামীর নির্দেশে তিনি গার্হস্থ্য জীবনে ফিরে আসেন। এর ফলে সমাজের ব্রাহ্মণরা তাঁদের পরিবারকে একঘরে করে দেয়, কারণ সন্ন্যাসীর পক্ষে আবার গার্হস্থ্যজীবন গ্রহণ করা তৎকালীন সমাজে অশাস্ত্রীয় বলে বিবেচিত হতো। এই সামাজিক বর্জন তাঁদের জীবনকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছিল।
এই প্রতিকূলতার মধ্যেও জ্ঞানেশ্বর এবং তাঁর ভাইবোনেরা আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনে ব্রতী হন। বড় ভাই নিবৃত্তিনাথ ছিলেন জ্ঞানেশ্বরের গুরু। তিনি নাথ সম্প্রদায়ের যোগী ছিলেন। কথিত আছে, ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানেশ্বর মাত্র ২১ বছর বয়সে আলন্দিতে সমাধি গ্রহণ করেন। কিন্তু এই স্বল্প জীবনেই তিনি যে আধ্যাত্মিক ও সাহিত্যিক অবদান রেখে গেছেন, তা অতুলনীয়।
জ্ঞানেশ্বরের দর্শন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার অদ্বৈত বেদান্ত, নাথ যোগ ঐতিহ্য ও ভক্তি মার্গের এক অপূর্ব সমন্বয়। তিনি শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদের অনুসারী ছিলেন, যেখানে ব্রহ্মকে একমাত্র সত্য এবং জগৎকে মায়া বা ভ্রম বলে মনে করা হয়। জ্ঞানেশ্বর বিশ্বাস করতেন যে ব্রহ্ম এবং আত্মার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনি ভক্তি মার্গের মাধ্যমে এই অদ্বৈত সত্যকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাঁর মতে, ভক্তি হলো সেই পথ, যা মানুষকে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতার দিকে নিয়ে যায়। তিনি জ্ঞানেশ্বরী-তে ভগবদ্গীতার শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের কাছে ভক্তিভাবে উপস্থাপন করেন।
তিনি জ্ঞানমার্গের অনুসারী হলেও তাঁর অদ্বৈতবাদ শুষ্ক তাত্ত্বিক ছিল না, বরং ভক্তি ও প্রেম দ্বারা সিক্ত ছিল। তিনি ভক্তি এবং জ্ঞানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব দেখতেন না। তাঁর মতে, ভক্তি হলো জ্ঞানের প্রকাশ এবং জ্ঞান হলো ভক্তির পরিণতি। তিনি মনে করতেন, ব্রহ্মজ্ঞান কেবল তর্কের মাধ্যমে নয়, বরং ভক্তি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লাভ করা যায়। তিনি ভক্তিকে মোক্ষের অন্যতম প্রধান পথ হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ভক্তি জ্ঞানকে পূর্ণতা দান করে।
জ্ঞানেশ্বর সর্বেশ্বরবাদে (Pantheism) বিশ্বাস করতেন। তার ভাবনায়, ঈশ্বর সর্বব্যাপী এবং প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই বিদ্যমান। জগৎ ও ঈশ্বর অভিন্ন।
জ্ঞানেশ্বর তাঁর ‘অমৃতানুভব’-এ চিদ্বিলাসবাদ নামে একটি নতুন দার্শনিক ধারণা প্রবর্তন করেন। তিনি বলেন, বিশ্ব ব্রহ্মের সৃজনশীল খেলা বা লীলা। এই বিশ্ব মায়া নয়, বরং ব্রহ্মের চৈতন্যের প্রকাশ। এই দৃষ্টিভঙ্গি শঙ্করাচার্যের কঠোর মায়াবাদ থেকে কিছুটা ভিন্ন।
জ্ঞানেশ্বর জাতিভেদ প্রথা ও সামাজিক বৈষম্যের তীব্র বিরোধী ছিলেন। তাঁর দর্শনে সকল মানুষ সমান এবং ঈশ্বর সকলের মধ্যেই বিদ্যমান। এই কারণে তিনি সাধারণ মানুষের ভাষায় ধর্মতত্ত্ব প্রচার করতেন। তিনি সকল মানুষের জন্য আধ্যাত্মিক পথ উন্মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, যা ভারতের ভক্তি আন্দোলনের একটি মূল বৈশিষ্ট্য।
গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে তিনি গুরুত্ব দিতেন, কারণ গুরু আধ্যাত্মিক পথের দিশারী। তাঁর নিজের গুরু ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নিবৃত্তিনাথ। জ্ঞান ও ভক্তি দুটো বিষয়ের জন্যই গুরু হলেন অবলম্বন। গুরুর কৃপার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের কথা বলেছেন তিনি।
জ্ঞানেশ্বরের সাধনা ছিল নাথ সম্প্রদায়ের যোগমার্গ এবং ভক্তি মার্গের সমন্বয়। তাঁর গুরু নিবৃত্তিনাথ তাঁকে কুণ্ডলিনী যোগ এবং নাথপন্থী সাধনার দীক্ষা দিয়েছিলেন। জ্ঞানেশ্বর নাথ সম্প্রদায়ের শিক্ষা অনুসারে কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণ ও ষট্চক্র ভেদের সাধনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে।
তিনি আত্ম-উপলব্ধি এবং ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার উপর জোর দিতেন। তিনি মনে করতেন, যোগের মাধ্যমে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং উচ্চতর আধ্যাত্মিক অবস্থা লাভ করা যায়। তিনি প্রাণায়াম এবং অন্যান্য যোগাচার অনুশীলনে পারদর্শী ছিলেন।
ভক্তি আন্দোলনের অন্য সাধকদের মতো জ্ঞানেশ্বরও ঈশ্বরের নাম স্মরণ এবং সম্মিলিত কীর্তনের মাধ্যমে ভক্তি প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দিতেন। এটি সাধারণ মানুষের জন্য আধ্যাত্মিক অনুশীলনকে সহজলভ্য করে তুলেছিল।
জ্ঞানেশ্বর বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে আত্মানুসন্ধান এবং নিজের ভেতরের ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার উপর বেশি জোর দিতেন। সাধারণ মানুষের জন্য আধ্যাত্মিক পথকে তিনি সহজ করে তুলেছিলেন।
তিনি সংস্কৃতের পরিবর্তে মারাঠি ভাষায় ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে জ্ঞানকে সকলের কাছে পৌঁছে দেন।
জ্ঞানেশ্বরের সাধনা কেবল ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য ছিল না। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিরলস কাজ করেছেন। তাঁর জ্ঞানেশ্বরী এই উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল।
জ্ঞানেশ্বর ২১ বছর বয়সে আলন্দিতে সমাধি গ্রহণ করেন। এটি ছিল তাঁর সাধনার চূড়ান্ত পরিণতি, যেখানে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত করেন।
সন্ত জ্ঞানেশ্বর অসাধারণ কাব্যপ্রতিভার অধিকারী ছিলেব। তিনি মারাঠি ভাষার প্রথম মহান কবি হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁর কবিতা ও সাহিত্যকর্ম ভক্তি, দর্শন এবং কাব্যিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব মিশ্রণ। তাঁর প্রধান রচনাগুলির কথা বলছি।
‘জ্ঞানেশ্বরী’ (Jnaneshwari) মারাঠি ভাষায় লেখা ভগবদ্গীতার ওপর একটি ভাষ্য। তিনি এটি মাত্র ১৬ বছর বয়সে রচনা করেন। জ্ঞানেশ্বরী মারাঠি ভাষায় ভক্তি সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ। এর ভাষা অত্যন্ত সুললিত এবং সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য। মারাঠি সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ এটি। জ্ঞানেশ্বরের দার্শনিক চিন্তাধারার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে এখানে। ‘জ্ঞানেশ্বরী’ কেবল একটি ভাষ্য নয়, এটি একটি কাব্যগ্রন্থ, যেখানে গীতার প্রতিটি শ্লোককে জ্ঞানেশ্বর অত্যন্ত সহজবোধ্য ও কাব্যিক ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি গীতার শ্লোকগুলোর ব্যাখ্যায় কাব্যিক রূপক ব্যবহার করেছেন। যেমন, তিনি ঈশ্বরকে ‘অনন্ত আলোর সমুদ্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা হৃদয় ও কল্পনাকে উদ্দীপিত করে। মারাঠি ভাষায় প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মগুলির মধ্যে অন্যতম এটি।
‘অমৃতানুভব’ (Amrutanubhav) জ্ঞানেশ্বরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক রচনা। এখানে তিনি অদ্বৈত বেদান্তের গভীর তত্ত্বগুলিকে সহজবোধ্য উপমা ও রূপকের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন। জ্ঞানেশ্বরীর চেয়েও গভীর দার্শনিক বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা রয়েছে এখানে।
‘অমৃতানুভব’ ব্রহ্ম, মায়া এবং জীবাত্মার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। এটি তাঁর চিদ্বিলাসবাদের প্রধান দলিল। গ্রন্থটির ভাষা অত্যন্ত গভীর এবং রূপকময়। উদাহরণ : “শিব ও শক্তি একই সত্তা, যেমন সূর্য ও তার আলো। তাদের মধ্যে পার্থক্য কেবল আমাদের অজ্ঞানতার কারণে।”
‘অভঙ্গ’ (Abhangas) হলো মারাঠি একধরনের ভক্তিমূলক গীতিকবিতা। প্রধানত দেবতা বিঠোবার স্তূতিতে গাওয়া হয়। জ্ঞানেশ্বর অসংখ্য অভঙ্গ রচনা করেছেন, যাতে ভক্তি ও প্রেম প্রকাশিত হয়েছে। এই অভঙ্গগুলি মারাঠি ভক্তি সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আজও মহারাষ্ট্রের ভক্তদের দ্বারা গীত হয়। এই কবিতাগুলিতে তিনি ঈশ্বর, গুরু, ভক্তি এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তাঁর অভঙ্গগুলি সহজবোধ্য ভাষা এবং গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতির জন্য পরিচিত।
‘হরিপাঠ’ (Haripath) জ্ঞানেশ্বরের রচিত ২২টি অভঙ্গের একটি সংকলন, যা প্রতিদিন ঈশ্বরের নাম জপের গুরুত্বের উপর জোর দেয়। এটি হলো ভগবান বিষ্ণুর প্রতি ভক্তিমূলক গানের সংকলন, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভক্তির জোয়ার সৃষ্টি করে। উদাহরণ : “হরি নামে মুখ রাখো, মন রাখো হরির পায়ে। সকল দুঃখ দূর হবে, মুক্তি পাবে শান্তি মাঝে।” তাঁর কবিতার ভাষা সহজ, কিন্তু গভীর অর্থবহ। তিনি প্রকৃতি, মানুষের জীবন ও ঈশ্বরের মহিমাকে রূপকের মাধ্যমে বর্ণনা করতেন। তাঁর কবিতা মারাঠি সাহিত্যে ভক্তি আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
জ্ঞানেশ্বর মারাঠি ভাষা ও সাহিত্যের পথিকৃৎ। তিনি সংস্কৃতের জটিল দার্শনিক শাস্ত্রকে সাধারণ মানুষের ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁর ‘জ্ঞানেশ্বরী’ এবং ‘অমৃতানুভব’ মহারাষ্ট্রের ওয়ারকারি সম্প্রদায়ের মূল গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।
কিন্তু জ্ঞানেশ্বরের কবিতাগুলি কেবল আধ্যাত্মিক নয়, সাহিত্যিক গুণেও সমৃদ্ধ। তাঁর ভাষা সহজ, সরল এবং সাধারণ মানুষের বোধগম্য। তিনি উপমা, রূপক এবং অলঙ্কারের নিপুণ ব্যবহার করে তাঁর রচনাগুলিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন। তাঁর কবিতাগুলি আজও মারাঠি ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাঁর কবিতা ও দর্শন পরবর্তী সাধকদের, যেমন নামদেব, একনাথ এবং তুকারামের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
জ্ঞানেশ্বর যেমন ছিলেন একজন অসাধারণ আধ্যাত্মিক নেতা ও দার্শনিক, তেমনই ছিলেন একজন নন্দিত কবি। তাঁর জীবন, দর্শন, সাধনা ও কবিতার মাধ্যমে মারাঠি সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক জীবনে এক অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে জ্ঞান ও ভক্তি পরস্পরবিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক।
তাঁর সামাজিক সংস্কারের চেতনা এবং সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে একজন যুগপুরুষে পরিণত করেছে। তার জীবন ও সাধনা আমাদের শেখায় যে প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা কেবল ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য নয়, সমাজের কল্যাণের জন্যও কাজ করে। তিনি ভারতের ভক্তি আন্দোলনের একটি প্রধান স্তম্ভ। তাঁর শিক্ষা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
নদীর স্রোতে হরির নাম, পাহাড়ে তাঁর ধ্যানের মগ্নতা,
গাছের পাতায় তাঁর মহিমা, আকাশে তাঁর চিরন্তন বিন্যাস।
জীবন যেন তাঁরই গান, প্রতিটি নিঃশ্বাসে তাঁরই ছায়া,
জ্ঞানদেব বলে, হৃদয় খুলে দেখো তাঁর নিবিড় মায়া।
জ্ঞানেশ্বরের কিছু কবিতা
১
নয়ন ভরে দেখলাম তার রূপ,
সখী, এতেই পেয়েছি পরম সুখ।
সেই তো আমার সুন্দর বিঠ্ঠল,
সেই তো আমার সুন্দর বিঠ্ঠল।
২
যেমন কাছের বস্তুকে দেখা যায় স্পষ্ট করে,
তেমনি আত্মরূপকে জানতে হয় অন্তরে।
আত্মাকে চিনে সংসারের পথ সহজ করো,
এটাই তো প্রকৃত জ্ঞান।
৩
হরি নামে ডাকো, হরি নামে ডাকো,
পুণ্যের হিসাব কে আর রাখে?
জঙ্গলে যেতে হবে না মিছিমিছি,
সুখেই আসেন ঘরে নারায়ণ।
৪
জ্ঞানদেব বলেন, আত্মাই তো ঈশ্বর,
সকল প্রাণের মাঝে সে সদা বিরাজমান।
৫
জগতটাই আমার ঘর,
যার বুদ্ধি এমন স্থির
তার আর কোনো ভয় থাকে না,
সে-ই তো পরব্রহ্ম হয়ে ওঠে।
৬
কাম, ক্রোধ, মদ, মাৎসর্য –
এগুলোই তো সকল সংসারের সার।
সেখানে যখন তোমাকে দেখি দুচোখ ভরে,
তোমারই বিচিত্র রূপ ধরা পড়ে।
৭
চোখ বুজে দেখি, হরি বিঠ্ঠল (দেবতা)।
তাঁর রূপ পবিত্র, সকলের জন্য।
তাঁর নাম গাই মুখে, বিঠ্ঠল।
তাঁর ভাব পবিত্র, সকলের জন্য।
৮
হরির নাম জপো মন, রাখো হৃদয় তাঁর পায়ে,
দুঃখ-দারিদ্র্য দূর হবে, শান্তি পাবে তুষ্ট হয়ে।
জগৎ মায়ার বন্ধন, ছিন্ন হবে নামের জোরে,
জ্ঞানদেব বলে, হরির কৃপায় মুক্তি মেলে ঘরে ঘরে।
৯
শিব আর শক্তি একই রূপ, যেমন সূর্য আর তার আলো
দুই নয়, একই সত্তা – তবু মায়ার পর্দায় ঢাকা মনে জাগে বিভ্রম।
চন্দ্র যেমন পানিতে ফেলে প্রতিচ্ছবি, তেমনি জীব ব্রহ্মের ছায়া;
জ্ঞানদেব বলে, জ্ঞানের আলোয় মিলিয়ে যায় মায়া।
১০
হৃদয়ে হরির নাম জাগে, মন মগ্ন তাঁর ভাবে,
আনন্দের স্রোতে ভেসে যায়, দুঃখ হারিয়ে যায় তাঁর নামে।
তাঁর কৃপার অমৃতধারা পান করে জীবন হয় পূর্ণ,
জ্ঞানদেব বলে, ভক্তির পথে চলে হৃদয় হয় দিব্য শুদ্ধ।
১১
মনের মন্দিরে হরি বসে আছেন, প্রেমের দীপ জ্বালো তুমি,
জ্ঞানের নৌকায় চড়ে পৌঁছে যাও তাঁর কাছে।
নামের মালা গাঁথো হৃদয়ে, দুঃখ-কষ্ট হবে দূর,
জ্ঞানদেব বলে, হরির কৃপায় জীবন হয় পবিত্র ও পূর্ণ।
১২
নদীর স্রোতে হরির নাম, পাহাড়ে তাঁর ধ্যানের মগ্নতা,
গাছের পাতায় তাঁর মহিমা, আকাশে তাঁর চিরন্তন বিন্যাস।
জীবন যেন তাঁরই গান, প্রতিটি নিঃশ্বাসে তাঁরই ছায়া,
জ্ঞানদেব বলে, হৃদয় খুলে দেখো তাঁর নিবিড় মায়া।
১৩
আত্মা ব্রহ্মেরই প্রতিচ্ছবি, মায়ার পর্দায় ঢাকা পড়ে থাকে,
জ্ঞানের তলোয়ার ধরো হাতে, ছিন্ন করো অজ্ঞানতা।
হৃদয়ে জ্বালো আলোর দীপ, দেখো তাঁর চিরন্তন রূপ,
জ্ঞানদেব বলে, ব্রহ্মে মিলে যাও, হয়ে থেকো না মায়ায় কূপ।