নারীর স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ | বিজয়ের দিন | আনোয়ারা সৈয়দ হক | স্মৃতিগদ্য
অবরুদ্ধ শহর এখন ঢাকা। প্রতিটি বাড়ি এখন অবরুদ্ধ। রাতের বিছানায় শুয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। মন হু হু করে। ভেতরে অদ্ভুত এক শূন্যতা। মনে হয় মেডিকেল স্কোয়াড্রনে গেলে হয়তো ভালো লাগবে। ছিমছাম পরিবেশে গেলে ভালো লাগবে। শৃঙ্খলা-পরিবেষ্টিত পরিবেশে কাজ করতে, রোগী দেখতে কত যে ভালো লাগবে! ভালো লাগবে বাঙালি অফিসারদের ফিসফাস। তাদের আশায় উদ্দীপিত মুখ। ভালো লাগবে যখন আমাকে বাঙালি এয়ারম্যানের স্ত্রীরা এসে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করবেন, আর কতদিন লাগবে ম্যাডাম দেশটা স্বাধীন হতে? এরকম ভাবে বেঁচে থাকতে আর তো ভালো লাগে না।
বিজয় যখন আসন্ন, অথচ বিজয় আসে না, তখন কারো আর কোনো কিছু ভালো লাগে না। যদি জানা যেত এই যুদ্ধ হলো দশ বছরের যুদ্ধ, তখন হয়ত সব কিছু মনের ভেতরে স্থির হয়ে উঠত। লোকে একটা দীর্ঘ সময়ের জন্যে মনকে বেঁধে নিতে পারত।
আমি রাতের অন্ধকারে জেগে বসে থাকি। আমি ভাবি। আমি মনে মনে স্বীকার করি আমি আমার মেডিকেল স্কোয়াড্রন, তার পরিবেশ, তার গাম্ভীর্য, তার শালীনতা মিস করি। আমি ফ্যামিলি উইংয়ের কর্মচারিদের মিস করি। আমি রওশনকে মিস করি। মমতা, আবেদা, মালেকাকে মিস করি। আমি এমআই রুমে চা দেয় যে-রহিম তাকে মিস করি। আমি স্কোয়াড্রনের গাছপালাগুলোকে পর্যন্ত মিস করি। ভোর পাঁচটার সময় ঘুম থেকে উঠে সংসারের খুটিনাটি সেরে, গোসল সেরে, সৈয়দ হকের জন্যে টেবিল জুড়ে নাস্তা সাজিয়ে – তখনও সে গভীর ঘুমে, ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়ে সকাল ঠিক সাতটায় যখন আমি মেডিকেল স্কোয়াড্রনে রিপোর্ট করতাম, তখনও প্রকৃতি জুড়ে দিন শুরুর কোমল আলোয় বড় সরল এক নিষ্পাপতা বিরাজ করত। কাজ করতে তখন খুব ভালো লাগত। কাজ পাগল মানুষ আমি। কাজ ছাড়া, রোগী ছাড়া, শৃঙ্খলা ছাড়া কীভাবে বাঁচি?
আমি লক্ষ্মীবাজারের বাসার ভেতরে আটকে থেকে অস্থির বোধ করি। একদা আমার একটা সুন্দর সংসার ছিল, সুন্দর একটা স্বপ্ন ছিল, সুন্দর একটা পরিবেশ ছিল, আর এখন কিছু নেই। এখন সব হারিয়ে আরও বড় কিছুর জন্যে প্রস্তুত হতে হচ্ছে। আমি জানিনে সেই বড় কিছু পেতে গেলে আমাদের আর কত অপেক্ষা করতে হবে, আর কত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হবে।
বাচ্চাদের পাগুলো বুকের ভেতরে চেপে ধরে আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। ভাবতে থাকি। ক’দিন আগে যেসব তরুণদের বন্দী শিবিরে দেখে এসেছি তাদের কথা মনে হয়। তাদের বুভুক্ষু চোখগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল, তাদের কেউ কেউ স্থির চোখে আমাকে তাকিয়ে দেখছিল। হয়ত আমাকে ঘৃণা করছিল সেই মুহূর্তে, কারণ তারা ছিল বন্দী। মনে পড়ে সেই মিলিশিয়া ছেলেটির কথা – গা ছমছম করা সেই মিলিশিয়া ক্যাম্প – গ্রিন রোডের অদূরে একটা দোতলা বাসায় সেই
বন্দীখানা, যেখান থেকে রাতের বেলা তরুণীদের করুণ চিৎকার শোনা যেত। সব একটা একটা করে মনে পড়ে আর আমি অস্থির হয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করি। মা কোথায় এক কোণে পড়ে থাকেন, ভাইবোনেরা কোথায় ছত্রখান হয়ে শুয়ে বসে থাকে লক্ষ্মীবাজারের এই সরাইখানায় তার কোনো হদিস থাকে না। স্বার্থপরের মতো শুধু যেন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি আমি।
২
চৌদ্দ তারিখের রাতে হঠাৎ রব উঠল বিহারীরা বাড়ি বাড়ি ঢুকে মানুষ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আতংকিত গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল পাড়ায়। লক্ষ্মীবাজারের বাড়ি একেবারে খোলামেলা, কোনো নিরাপত্তা নেই। পাড়ার অন্যান্য বাড়ির অবস্থাও অবশ্য আমার এই শ্বশুরবাড়িটির মতোই।
লক্ষ্মীবাজার এলাকার বাড়িগুলো তখনকার দিনে খুব পুরনো ধরনের ছিল। এসব বসতবাড়ি তৈরি করেছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা। ভারত ভাগ হয়ে গেলে দলে দলে তাঁরা এদেশ থেকে চলে যান। কেউ কেউ বাড়ি বিক্রি করে, কেউবা বাড়ি পাল্টাপাল্টি করে ভারতে চলে যান। অনেকে আবার বাড়ি ভাড়া দিয়েও চলে যান। হয়ত আশা ছিল তাঁদের যে দু’দিন পরেই আবার ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু সেই আসা আর তাঁদের হয় না।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লক্ষ্মীবাজারে হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ ছিলেন বলে মনে হয় না। যে দু’চার ঘর ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই চলে গিয়েছিলেন সীমান্তের ওপারে। এখন সীমান্তের এপারেই যেসব মুসলমান আছেন তাদের জান নিয়েই টানাটানি। হিন্দু তো কোন ছার। ধর্ম যে আদতেই কোনো রক্ষাকবচ নয়, মার্চের পর থেকেই তা হাড়ে হাড়ে আমরা বুঝেছি, এবার এই সময়ে আরও একবার তা বোঝা গেল। সন্ধ্যে যত ঘনিয়ে উঠতে লাগল, আতংক ততই ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারপাশে। আমার দেবর সৈয়দ আমজাদ হোসেন রাজা বললেন, চলেন, আমরা প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিই। এখন এছাড়া বাঁচার আর কোনো পথ নেই। উনি যদি আমাদের মারেন তো সেটা হবে নিয়তির লিখন, খণ্ডানো যাবে না।
দেবরের কথা শুনে সমুদ্রে কুটো আঁকড়ে ধরার মতো আমরা দল বেঁধে চললাম প্রিন্সিপাল ফাতমি সাহেবের কোয়ার্টারে। কলেজের সীমানার ভেতরেই বাড়ি। বাড়িটা দোতলা এবং খুব পুরনো আমলের। বাড়ির গা থেকে হলুদ রং প্রায় উঠেই গেছে। প্রিন্সিপাল সাহেবের বাড়ি যেতে হবে এখন, এই মুহূর্তেই – একথা শুনে সকলের ভেতরে চঞ্চলতা দেখা দিল।
আজ প্রায় একসপ্তাহ লক্ষ্মীবাজারে এসেছি, ঠিকমতো খাওয়া না, নাওয়া না, ঘুমনো না। দেবরের স্ত্রীর ওপরে চাপ পড়ছে প্রচণ্ড। সে তরুণী মেয়ে। তবু সকলের জন্যে ভাত তরকারির ব্যবস্থা করেছে। তরকারি হচ্ছে প্রতিদিন একই রকমের। সকালে ফুলকপির ভাজি আর ডাল, রাতে ফুলকপির ডাঁটার ঝোল আর ডাল। দু’দিন ধরে এই খাবার খাওয়ার পরে ভীষণ সৌখিন আমার মা বললেন, এই তরকারি আমি খেতে পারব না, মঞ্জু, তুই অন্য ব্যবস্থা কর!
মায়ের কথা শুনে আমি অসহায়ের মতো চুপ করে থাকলাম। আমার কি ইচ্ছে নয় মাকে আমি সামান্য একটু ভালো খাবার খাওয়াই? আমার ভাইবোনেরা পর্যন্ত এই খাবার দু’বেলাই মুখ বুজে প্রতিদিন খাচ্ছে, কোনো প্রতিবাদ নেই। আমার বাবা আমাদের যশোরের বাজার ইজারা নেন প্রায় প্রতিবছর। বাজারের ভেতরেই আমাদের বসবাস বলা চলে। যে কোনো ভালো মাছ বা মাংস বাজারে এলে বাবা কিনে নিয়ে আসেন। ঝুড়ি ভর্তি করে ফলমূল শাকসবজি আসে। বাবার এগারোটা ছেলেমেয়ে। সকলেরই খিদে দানবের মতো। যেমন চেহারা তেমনই তাদের খিদে। তারা পর্যন্ত এই সংকটের সময়ে চুপ করে যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে, অথচ আমার মা করছেন প্রতিবাদ!
পরে বুঝেছি, আসলে মা নিজের খাওয়ার অজুহাতে তাঁর ছেলেমেয়েদের পাতে মাছ-মাংস তুলে দিতে চেয়েছিলেন। সেই সংকটের সময়েও আমার হাতে কিছু টাকা থাকা সত্ত্বেও আমি মায়ের সে ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি। জানি মুক্তিযুদ্ধের সময় সামান্য এই খাওয়া নিয়ে কত মানুষ ব্যঙ্গবিদ্রূপ করবেন, কিন্তু জীবনের বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে, সামান্য সাধ আহ্লাদও মানুষের মৃত্যুর সময় পর্যন্ত বজায় থাকে!
প্রিন্সিপাল সাহেবের বাড়ি আশ্রয় নিতে হবে শুনে মা বেঁকে বসলেন। বললেন, শেষে কি বাঘের ঘরে আমাদের নিয়ে চললি? কিন্তু সে মুহূর্তে এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। এলোমেলো চুল ও কাপড়ে, বিধ্বস্ত শরীর ও মনে আমরা সকলে চললাম প্রিন্সিপাল সাহেবের বাড়িতে। নয়নের কাঁধে তুলে দিলাম ঝিনুককে। সে মামার কাঁধে চড়ে জুলজুল করে তাকিয়ে আমাদের কাণ্ডবান্ড দেখতে লাগল। দ্বিতীয়কে আমার কোলে তুলে নিলাম।
লক্ষ্মীবাজারের বাড়ি তালাবন্ধ করে সকলে চলল প্রিন্সিপালের বাড়ির দিকে। এক মিনিটের পথ। বাড়ির গেট খোলা ছিল, সেই খোলা গেট দিয়ে কাফেলার মতো একে একে আমরা ঢুকলাম। ভেতরটা একেবারে অন্ধকার। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়তে লাগল। মনে মনে ভাবলাম, হায় আল্লাহ, ঠিক জায়গায় এসে পড়লাম তো। নদীর কূলে এসে নৌকো ডুবল না তো।
কে একজন অন্ধকারে আদেশের সুরে বলল, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠেন।
সে কথা শুনে অন্ধকারে সিঁড়ি হাতড়ে হাতড়ে ওপরে উঠলাম। আমার পেছনেই মা, তাঁর পেছনে আর সকলে। সিঁড়ির অদূরে খুব মৃদু একটা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছিল। সিঁড়ির একেবারে ওপরের ধাপে উঠে একটা খোলা দরজা দেখা গেল। একজন বলল, ঘরে গিয়ে বসেন।
ঢুকলাম সেই ঘরে। একে একে আমরা সকলেই।
তখন মৃদু হ্যারিকেনের আলোয় যে দৃশ্য দেখলাম তা বলার নয়। ঘরভর্তি মানুষ। যারা মাটিতে জায়গা পেয়েছে তারা বসেছে, বাকি সকলে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। এর ভেতরে কোথায় আমরা বসবো বা দাঁড়াবো? মনে হলো পাড়ার যত বাঙালি পরিবার আছে সকলে এসে জড়ো হয়েছে প্রিন্সিপাল সাহেবের সিটিং রুমে। সিটিং রুম থেকে সব আসবাবপত্র সরানো হয়েছে যাতে মানুষজন এসে অপেক্ষা করতে পারে। ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের মা বাবার কোলে। সালোয়ার কামিজপরা একজন তরুণী দেয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের প্রবেশ পথের দিকে। তার দৃষ্টি নির্বিকার। যেন এ ক’মাসে সে জীবন সম্পর্কে এক দার্শনিক অভিজ্ঞতায় সিক্ত হয়েছে। বাইরের পরিবেশ তাকে যেন আর প্রভাবিত করতে পারছে না।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার – এতগুলো মানুষ সেই ঘরে হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়ে যেন জমায়েত হয়ে আছে, এতগুলো বাচ্চাকাচ্চা, অথচ কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। বাচ্চারাও কি তাহলে বিপদ আঁচ করতে পারে? নিজের অস্তিত্ব রক্ষার বোধ কি জন্ম থেকেই মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকে? শুধু কি মানুষ? পশুর ভেতরেও কি এই বোধ লুকিয়ে থাকে না?
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে একজন মহিলা একদিন আমাকে বলেছিলেন, মনিপুরি পাড়ায় একবার তাঁর বাসায় ডাকাতি হয়েছিল। ডাকাতেরা ছোরা হাতে বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। ঘরের আলোয় ছোরা ঝকঝক করে জ্বলছিল। আর মহিলার পোষা দু’টো কুকুর, যারা সারাদিনমান অচেনা লোক দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে দৌড়ে যেত, সেই কুকুর দু’টো রাতের বেলা ডাকাতদের হাতে ঝকঝকে ছোরা দেখে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল, মুখে একটা শব্দ পর্যন্ত করেনি।
সেদিন রাতেও কেউ টু শব্দ করেনি। একবার শুধু একজন মহিলা বলে উঠলেন, আল্লাহ, এভাবে বাঁচার চেয়ে আমাদের মেরে ফেল।
ভাগ্যক্রমে শীতকাল থাকাতে এতগুলো মানুষ সেদিন পড়ে থাকতে পেরেছিল একটা ঘরের মধ্যে। তবে একবারের জন্যে হলেও কলেজের প্রিন্সিপাল বা তাঁর স্ত্রী এসে কোনো আশ্বাস দেননি মানুষদের। হয়ত সেরকম কোনো আশ্বাস দেবার ক্ষমতা বা সাহস তাঁদের তখন ছিল না। পরে দেশ স্বাধীন হলে শুনেছি, প্রিন্সিপাল সাহেব তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে করাচিতে চলে যেতে পেরেছিলেন নির্বিঘ্নে।
কীভাবে যে সেই রাতটা কাটিয়েছিলাম, এখন আর স্পষ্ট মনে নেই। দুঃখের স্মৃতি, কষ্টের স্মৃতি মানুষের মনে বেশিদিন স্থায়ী হয় না। মন এত কষ্ট ধরে রাখতে পারে না। স্মৃতিও মাঝে মাঝে বাস্তবতা এবং অবাস্তবতার ভেতরে দোল খায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এগুলো কি সত্যিই কোনোদিন ঘটেছিল? এরকম রাত কি সত্যিই কোনোদিন এসেছিল?
পাঁচ বছরের ঝিনুককে ওর মামার কোলে দিয়ে রাখার জন্যেও ভীষণ এক অপরাধবোধ এসে মনে জমা হয়। ওর মামা অন্ধকারে কোথায় কোথায় ঘুরছিল মেয়ে কাঁধে করে, একবারের জন্যেও কেন আমি মেয়েটাকে নিজের কোলে রাখিনি এই কথা মনে হয়। যদি মরে যেত সে, তাহলে হয়ত আমার চোখের আড়ালেই মরে যেত!
পরদিন সকালে একে একে সকলে আবার যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিল। আমরাও ফিরে এলাম নিজেদের বাড়িতে। অথচ গত রাতে আমাদের অজান্তেই ঘটে গেল সেই নারকীয় যজ্ঞ, যার বিন্দুবিসর্গ তখন আমরা টের পাইনি। নিহত হলেন আমাদের দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবিরা। দেশের মনি-মুক্তোগুলো যেন হারিয়ে গেল দেশ স্বাধীন ও মুক্ত হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে।
তখন আমার যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। পরে বই পড়ে জেনেছি, কোনো কোনো যুদ্ধে শত্রুপক্ষ হেরে যাবার মুহূর্তে নির্বিশেষে নারকীয় এক ‘জ্বালাও-পোড়াও-হত্যা করো’ নীতি গ্রহণ করে। হয়ত আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিমান মানুষও সেটা জানতেন না। যদি জানতেন তাহলে তাঁরা হয়ত আরও সতর্কতা অবলম্বন করতেন।
৩
পনেরোর সকাল থেকে বাতাসে বাতাসে এক বার্তা ভেসে এল – দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি! কয়েক ঘণ্টা? এদিকে শুনতে পাচ্ছি মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসে গেছে। কোনদিকে যাবো? শঙ্কা ও আশা যেন যুগপৎ মনের ভেতরে আলপনা কাটতে লাগল। একবার কালো রঙের আলপনা, আরেকবার লাল রঙের। লোকমুখে শুনতে পেলাম গভর্নর মালিক নাকি পদে ইস্তফা দিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাঁর মন্ত্রী পরিষদসহ আশ্রয় নিয়েছেন। এর আগে তিনি যখন গভর্নর হাউসে ছিলেন তখন আমাদের চোখের সামনে মিগ ফাইটার বিমানগুলো গভর্নর হাউস আক্রমণ করেছিল। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। কত ছেলেমেয়ে অভিভাবকের নিষেধ না মেনে ছাদে দাঁড়িয়ে সেই আক্রমণ প্রত্যক্ষ করতে করতে হাততালি দিয়েছিল। অথচ ওই একই দিনে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। ওই একই দিনে আমরা প্রাণভয়ে বিহারী প্রিন্সিপালের করুণার দ্বারস্থ হই। যেন প্রতি মুহূর্তে ইতিহাস ভিন্নতর ঘটনার সমাবেশ লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছিল কালের পাতায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি হোটেল ইন্টারকনকে ‘নিরপেক্ষ জোন’-এ পরিণত করার জন্যেই সেদিন গভর্নর মালিক ও তাঁর মন্ত্রী পরিষদের লোকেরা প্রাণে বেঁচেছিলেন। নতুবা চৌদ্দই ডিসেম্বর তাঁদেরও আমাদের দেশের নিহত বুদ্ধিজীবীদের ভাগ্যই মেনে নিতে হত।
আমাদের অলক্ষ্যেই সেদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠান। কিন্তু ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস অনেক চেষ্টা করেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সেদিন সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি। পরে লোকমুখে শুনেছিলাম তিনি নাকি পূর্বপাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যায় এই বেদনায় মদ খেয়ে বেঁহুশ হয়ে পড়েছিলেন। ‘ইসলাম খতরে মে হ্যায়’ যে দেশের রাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা ছিল, তার দৃষ্টিতে সেই ইসলামই যখন সত্যিকার অর্থে খতরে মে, তখন তার সাড়া পাওয়া গেল না। ফলে ভারত সরকারের কাছে যখন নিয়াজীর শর্তসাপেক্ষে আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছোলো, ভারত সরকার তখন এ প্রস্তাব নাকচ করে দিল সঙ্গে সঙ্গে। বলল, নিয়াজীকে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করতে হবে অথবা শেষ পরিণতির জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। ভারত সরকারের এই প্রস্তাব নিয়াজীর কাছে পৌঁছোলো। এবং সেই সঙ্গে এই নির্দেশও দেয়া হলো যে সেদিন সকাল ন’টার ভেতরেই জানাতে হবে নিয়াজি বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করছেন কি না।
অন্যায়ভাবে একটি দেশের মানুষকে অত্যাচার করলে, নিপীড়ন করলে, হত্যা করলে, ধর্ষণ করলে, অগ্নিসংযোগ করলে, অপমান করলে এরকম পরিণতি হওয়াই স্বাভাবিক। যে-ইসলামের বুলি মুখে ধরে পাকিস্তানি সৈন্যরা এদেশ আক্রমণ করেছিল সেই ধর্মই বুমেরাং হয়ে তাদের বুকে গিয়ে পড়ল। কারণ প্রকৃত ধর্ম, প্রকৃত ইসলাম কখনোই নিরীহ মানুষদের হত্যা করার গ্রিন সিগন্যাল দেয় না।
আমরা সকলে সকাল থেকে ঘর-বার করছি। ঘর-বার মানে প্রকৃত অর্থেই ঘর-বার। তবে বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছি না। ঘর এবং উঠোন করছি। বাংলাদেশ রেডিও বন্ধ, কোলকাতা রেডিও সর্বক্ষণ চলছে। এবং কিছুক্ষণ পরপরই নিয়াজিকে বলা হচ্ছে আত্মসমর্পণ করতে।
বাতাসে লিফলেট উড়ছে আত্মসমর্পণের নির্দেশ জারি করে। কিন্তু নিয়াজি আত্মসমর্পণ করছেন না। আকাশে মিগ বিমান আর দেখা যাচ্ছে না, যার অর্থ যুদ্ধ এক প্রকারের শেষ। কিন্তু তবু নিয়াজি আত্মসর্পণ করছেন না।
লোকে প্রচার করতে লাগল যদি নিয়াজি আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে ঢাকার ওপর প্রচণ্ড বেগে আবার আক্রমণ শুরু হবে। তখন নগরবাসীও আর বেঁচে থাকতে পারবে না। এ কথা শুনে মানুষজনের নাভিশ্বাস উঠে গেল। শেষে কি মিত্রশক্তির হাতে আমাদের প্রাণ যাবে? সেজন্যে কি আল্লাহ এতদিন আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন?
ঘরে ঘরে সূরা ইয়াসিন পড়া শুরু হয়ে গেল। সুরা ইয়াসিন তো যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই মানুষ পড়ছে। কিন্তু এই সময় প্রত্যেকের মুখে সূরা ইয়াসিন। প্রতি মুহূর্তে যেন কোটি কোটি সূরা ইয়াসিন পড়া হয়ে যাচ্ছে। একেকজন দশবার, বিশবার, পঞ্চাশবার, সত্তরবার, একশোবার, দু’শ বার করে সূরা ইয়াসিন পড়ছে। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে সবাই, ঠোঁটের দুপাশে ফেনা জমে গেছে। কেউ বিড়বিড় করে পড়ছে। কেউ জোরে জোরে পড়ছে। কেউ কাঁদছে আর পড়ছে। কান্না তো আর এখন কান্না নয়, বিলাপে পরিণত হয়েছে।… ‘প্রজ্ঞাময় কোরআনের কসম, নিশ্চয় আপনি প্রেরিত রসূলগণের একজন, সরল পথে প্রতিষ্ঠিত কোরআন পরাক্রমশালী পরম দয়ালু আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ, যাতে আপনি এমন এক জাতিকে সতর্ক করে দিতে পারেন যাদের পূর্বপুরুষগণকেও সতর্ক করা হয়নি, ফলে তারা গাফেল, তাদের অধিকাংশের জন্য শাস্তির বিষয় অবধারিত হয়েছে’… ‘আপনি কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পারেন, যারা উপদেশ অনুসরণ করে এবং দয়াময় আল্লাহকে না দেখে ভয় করে।’ সকলে শুধু সূরা ইয়াসিন পড়ছে আর মনে মনে বলছে, আল্লাহ, নিয়াজীর সুমতি দাও, সুমতি দাও!
শুধু ঘর-বার, আর ঘর-বার। ছেলে ক্ষুধার্ত, মেয়েকে স্নান করানো হয়নি দু’দিন, কোনোদিকে আমার খেয়াল নেই। এভাবে দিন গেল। নিয়াজি আত্মসমর্পণ তখনও করেননি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, চারদিকে থমথমে নীরবতা, বিবিসি খুললাম, বিবিসিতে সেদিন বিশেষ অধিবেশন খোলা হয়েছে বাংলদেশের সমূহ পরিস্থিতির কারণে। সেদিন যেন কাকতালীয়ভাবেই সৈয়দ হকের খবর পাঠ শুরু হলো, খবর মাঝপথ পর্যন্ত হয়েছে, হঠাৎ পাঁচ সেকেন্ডের বিরতি, তার পরেই সৈয়দ হকের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আমরা এই মুহূর্তে জানতে পারলাম পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছেন।’ যেন দৈববাণী উচ্চারিত হলো তাঁর কণ্ঠে। যেন বাংলার এক মগ্নপ্রাণ সন্তানের কণ্ঠে খবরটি উচ্চারিত হবার জন্যেই – তাঁরই কণ্ঠে বিশ্বের সকল বাঙালিকে ইতিহাসের পরম সুখবরটি জানাবার জন্যেই – বিধাতা তাঁকে বিলেতে নিয়ে যান।
ঘরের ভেতরে উল্লাসে ফেটে পড়ল মানুষ। দেবর, ননদেরা, ভাইবোন সকলে নৃত্য শুরু করল। বাইরে মানুষের হর্ষধ্বনি। ছাদের ওপরে মানুষেরা সব উঠে গেল। গলা ফাটিয়ে এ-ওকে ‘জয় বাংলা’ বলে সম্বোধন করতে লাগল।
জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা।
বাংলার জয়। হাজার বছরের পরাধীন বাঙালির সর্বপ্রথম জয়।
হাজার বছরের পরাধীন বাঙালিকে সঠিক পথে চালনা করার নেতৃত্বের হয়।
জয় বাংলাদেশের। জয় বাঙালির।
জয় শেখ মুজিবুর রহমান। জয় বাংলার নয়নমণির।
অনেকদিন বাদে সৈয়দ হকের মুখে শুনেছিলাম সেই বিশেষ খবরটি পড়ার নেপথ্য কাহিনি। বিবিসির সেই বিশেষ সম্প্রচারে সেদিন যখন তিনি খবর পড়ছেন, তার ভেতরে বেশিরভাগ খবর বাংলাদেশের, টানটান উত্তেজনা নিয়ে বিশ্বের বাঙালিরা যখন বিবিসির বাংলা খবর শুনছেন, তখন সেই খবর পাঠের মাঝপথে নিঃশব্দে কিন্তু দ্রুতপায়ে বিবিসির এশিয়ান বিভাগের প্রধান মার্ক ডড স্টুডিওতে ঢুকলেন। হাতে তাঁর টাইপ করা একটি পাতা।
বিবিসির কোনো বিভাগীয় প্রধানের এভাবে স্টুডিওতে আসার কথাই নয়।
তাঁকে স্টুডিওতে ঢুকতে দেখে খবর পড়তে পড়তেই সৈয়দ হক সচেতন হয়ে উঠলেন। পরম বিশেষ কোনো খবর না হলে তিনি তো আসবেন না! মার্ক ডড তাঁর হাতের কাগজটা ঠেলে দিলেন সৈয়দ হকের সামনে। ইশারা করলেন, আর সব খবর থামিয়ে এই খবরটা তাৎক্ষণিকভাবে বাংলায় অনুবাদ করে পাঠ করতে।
পাঁচ সেকেন্ডের বিরতি। সৈয়দ হক দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন সেই কাগজে। তারপর খবরটি পড়লেন। ইথারে সেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বচরাচরে। ছড়িয়ে গেল বাংলাদেশেও।
মুক্তি! মুক্তি। উল্লাসে ফেটে পড়ল বাঙালি। পরবর্তী জীবনে সৈয়দ হক বলেছেন, রেডিওতে তিনি যত খবর পড়েছেন, তার ভেতরে সবচেয়ে মূল্যবান খবরটি হলো সেদিনের সেই খবর। আজও সৈয়দ হকের কণ্ঠে প্রচারিত সেই খবরটির রেকর্ড বিবিসি থেকে বাংলাদেশের বিজয় দিবসে বাজানো হয়।
ক’জন মানুষের এরকম সৌভাগ্য হয়?
আত্মসমর্পণের সেই খবর শুনে আমরা সবাই যখন উল্লসিত, আমার মেয়ে বিদিতা মানে ঝিনুক তখন তার রুক্ষ চুল, গোসল না করা চেহারা, গায়ে ময়লা জামাকাপড় নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বড় বড় চোখ করে বলল, বিজয় কবে হবে মা?
মেয়েকে কাছে টেনে তার মুখ চুম্বন করে বললাম, বিজয় তো এসে গেছে, বাবা! বিজয় এসে গেছে।
আনোয়ারা সৈয়দ হক
বাংলা সাহিত্যের একটি অগ্রগণ্য নাম। উপন্যাস, ছোটগল্প, নারীবিষয়ক প্রবন্ধ, শিশুতোষ রচনা, সাহিত্যের সব শাখাতেই তাঁর প্রতিভাদীপ্ত উপস্থাপনা মননশীল পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আনোয়ারা সৈয়দ হকের জন্ম যশোহরে। বাবা গোলাম রফিউদ্দিন চৌধুরী, মা আসিয়া খাতুন চৌধুরী। মানবজীবন, বিশেষ করে বাঙালিসমাজে নারীজীবনের বেদনা ও বঞ্চনা, স্বপ্ন ও অভিজ্ঞতাকে শেকড়ে রেখে আনোয়ারা সৈয়দ হক দীর্ঘদিন থেকে লিখে চলেছেন। তিনি ঘোষিত নারীবাদী না হয়েও নারীকে রেখেছেন তাঁর সকল রচনার কেন্দ্রে। এখন পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ষাটের কাছাকাছি।
সূত্র : অবরুদ্ধ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৮

