তীরন্দাজ থিয়োঙ্গো সংখ্যা
সম্পাদকীয় নোট
কেনিয়ার বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক, চিন্তাবিদ, লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। গত ২৭ মে ৮৭ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কেনিয়ায় থাকতে সেন্সরের খড়্গ, কারাবাস এবং জোর করে তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। বিগত কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল তিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেতে পারেন। থিয়োঙ্গো আফ্রিকার সেইসব বিরল লেখকদের একজন, যিনি উপনিবেশবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে আফ্রিকার লোকভাষায় সাহিত্যচর্চা করেছেন। লেখালেখি করেছেন তার গোত্রের মাতৃভাষা গিকুউতে। শুধু বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছুনোর জন্য নিজের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন অথবা ইংরেজিতে লিখেছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৩৩। বিশ্ববরেণ্য এই লেখকের প্রয়াণ উপলক্ষ্যে তাঁর নিজের কয়েকটি লেখা এবং তাঁর ওপর রচিত অন্যান্য লেখা নিয়ে তীরন্দাজের এই বিশেষ সংখ্যা।
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো প্রথম বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের দৃষ্টিতে আসেন ‘ডিকোলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ (Decolonising the Mind) বইটির মাধ্যমে। এরই সূত্রে পরবর্তীকালে আফ্রিকা মহাদেশ এবং পৃথিবীর নানা জায়গায় স্থানীয় ভাষায় সাহিত্যচর্চা পুনরুজ্জীবিত হতে দেখা গেছে। অনুবাদ একদিকে যেমন আফ্রিকান সাহিত্যকে ইংরেজির বাইরের পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, তেমনি তা ফিরিয়ে আনছে সাহিত্যকে তার নিজস্ব, প্রায় বিস্মৃত ভাষাভূমিতে। নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো বৈশ্বিকভাবে এই অনুবাদের উপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। এই লেখাটি Decolonising the Mind বইটির পর্যালোচনা।
নগুগি ও ভাষার একনায়কত্ব | রিটন খান
নাইরোবির একটা মিশনারি স্কুলের একটা ছেলে। তাকে পড়ানো হয়েছিল কেমন করে আত্মা খাঁচা হয়ে যায়। জুতোয় পেরেক ঠুকে হাই হিল বানানোর গল্প। তিন দশক পরে সেই ছেলেটি কলম ধরতেই সরকারের টনক নড়ে। তিনি একটা বই লিখে নাম দিলেন Decolonising the Mind। সেই বইতে লিখলেন, ‘তোপের পেছনে ছিল স্কুল।… যে হাত বন্দুক চালাচ্ছে, তারাই মন তৈরি করছে ক্লাসরুমে। নগুগির যুক্তি এমন যে, স্কুল আসলে শুধু বানান শেখায় না, বানায় বন্দি। এইভাবেই বন্দুক আর বই মিলে বানায় বস। মানে, পশ্চিমা সাম্রাজ্য শুধু খনিজ সম্পদ নয়, আত্মার ভূগোলও কিনে নিচ্ছিল। নগুগি দেখালেন, স্কুলের প্রশ্নে থাকে না স্বাধীনতা। যে স্কুলে নগুগি পড়েছিলেন সেখানে ঔপনিবেশিক রূপকথার কালি-কলমে শ্বেতাঙ্গরা ‘উন্নয়ন’ নামের চকচকে উপহারের বিনিময়ে নিয়ে নেয় একটা গোটা জাতির আত্মা। নিজের মাতৃভাষা গিকুয়ুতে যদি কিছু বলো, তা হলে শিক্ষকের হাতের স্কেল পেটায় যেন ভাষাটাকে।
অনেক বছর পরে নগুগি যখন গিকুয়ুতে লেখা শুরু করলেন, তখন সেটা ছিল নিজেরই মানচিত্রে ফিরে আসা, হয়তো আত্মাকে আবার নিজের ভেতরে গলিয়ে নেওয়া।
অকল্যান্ডে ১৯৮৪ সালে নগুগির দেওয়া চারটি বক্তৃতা এই বইয়ের মূল বিষয়আশয়। নগুগি বলেছিলেন, ‘ইংরেজির যে মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা সব জায়গায় হয়েছে একই নিয়মে, স্থানীয় ভাষার অপমানের বিনিময়ে। এ কাহিনি শুধু কেনিয়ার নয়, সবার।’ বহু বছর পর, হঠাৎ করে নগুগির মনে পড়ে যায় বিনাপ্রয়াসে পশ্চিমমুখী দৃষ্টিভঙ্গির মোঝেতে পা গলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেউ বলেইনি, ‘এইটা কি ঠিক?’ বরং সোজা বলা হয়েছে, ‘চুপচাপ ইংরেজ হোন।’ ‘ক্ষমতার ভাষা ছিল ইংরেজি,’ নগুগি বলেন। ‘আর সেই ভাষা ঠিক আমাদের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, যেন রক্তে মিশে যাওয়া ভ্যাকসিন।’ এর ফলে ঔপনিবেশিকতা আসলে ছিল একটা বিকার।
Decolonising the Mind বইটা ছিল একপ্রকার অকপট আত্মপ্রকাশ।, তার চোখে আসল দখল ছিল মগজের ভিতরে, চিন্তার গোপন কোণে। তাঁর সবচেয়ে বড় হতাশা ছিল, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আফ্রিকান লেখকদের এক বিশাল অংশ তাঁদের মাতৃভাষায় লেখেন না। সাহিত্যের নোবেল পাওয়া যায় ইংরেজিতে, কিন্তু ঘরের দরজায় শব্দ বেজে উঠলে ‘কে?’… জিজ্ঞেস করাও হয় ফরাসিতে। এই বোধ থেকেই নগুগি সিদ্ধান্ত নেন, এবার কলম শুধু গিকুয়ু বা সোয়াহিলিতেই চলবে। যেন নিজের ভাষায় লেখা মানে কেবল সাহিত্য নয়, দেশান্তর থেকে ফিরে আসা, আত্মার দখল ফিরে পাওয়া।
অনুবাদকে তিনি দেখতেন সাংস্কৃতিক সেতু হিসেবে। কিন্তু এমন সেতু, যার নীচে গান হারিয়ে যায় না। কারণ, প্রতিটি ভাষারই থাকে নিজস্ব রিদম, ছন্দ-লয়; অমোচনীয় সংগীত। অনুবাদ হয়তো খবরটা পৌঁছায়, কিন্তু উৎসবের ঢাকটা হারিয়ে যায়। আর ভাষাই যদি মরে যায়, তাহলে সেই সুর, সেই ঢাকের শব্দ কল্পনাতেও ফিরে আসে না। এই আক্ষেপ শুধু নাইরোবির নয়, দাবাবাজির ছকে বন্দি আফ্রিকার নয়, এই হাহাকার লন্ডনের বৃষ্টির নিচেও বাজে, আইরিশ পাহাড়ি ঘাসে রোদ্দুরের মতো ছায়া ফেলে। নগুগির যে শূন্যতা, নিজের মাতৃভাষায় লেখালেখির হারিয়ে যাওয়া অহংকারের জন্য আকুতি, তা তার একার নয়। এর প্রতিধ্বনি শোনা যায় আইরিশ কবি নুয়ালা নি ধোমনালের কণ্ঠেও। তবু সমস্যাটা কেবল সাহিত্যের নয়, প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর সমাজজীবনের অভ্যন্তরে ঢুকে গেছে মাতৃভাষাকে অবমূল্যায়নের ছত্রাক। ব্রিটিশরা আদৌ সত্যিই ‘সভ্যতায়নের মিশনে’ বিশ্বাস করত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু বাস্তবে ইংরেজির বিজয়মালা গলায় ঝুলিয়ে, স্থানীয় ভাষাকে সোজা কবরখানায় পাঠিয়ে, ঔপনিবেশিক প্রকল্পকে তারা আরও পোক্ত করে তুলেছিল। উপনিবেশ মানেই যেখানে স্থানীয় ভাষাকে কোণঠাসা করা, সেখানে গজিয়েছে এক নতুন শ্রেণি – রক্তে আদিবাসী কিন্তু রুচিতে ব্রিটিশ বুটপালিশ। তাদের চিন্তা, নৈতিকতা, নকশা, সবই যেন অন্যের কণ্ঠস্বর ধার করে বলা কথামালা। নিজের ভাষা বিস্মৃত, নিজের লোক অচেনা, নিজস্বতা যেন ভুল বানান।
এই ইতিহাসও আদতে নতুন নয়। এর রসায়ন বহু পুরনো। ১৮৩৫ সালে, রাজনীতিক ও ইতিহাসবিদ টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, যিনি ব্রিটিশ কলিকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে ‘কালচারাল ইনসার্জেন্সি’ নামক এক মৌন যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন – ভারতে সংস্কৃত বা আরবি বই ছাপাতে ব্রিটিশদের এক পয়সাও খরচ করা উচিত নয়। তাঁর কুখ্যাত মেনিফেস্টো ছিল একেবারে স্পষ্ট, সরকারি নোটিশের চেয়েও বেশি পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও বিষাক্ত – ‘আমাদের এমন এক শ্রেণি তৈরি করতে হবে যারা আমাদের এবং আমাদের শাসিত কোটি কোটি মানুষের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে; তারা এমন একদল মানুষ যারা রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হবে, কিন্তু রুচিতে, মতাদর্শে, নীতিতে এবং মস্তিষ্কে হয়ে উঠবে ইংরেজ।’এই ঘোষণাটা শুধু নীতিগত নির্দেশ ছিল না, ছিল সাম্রাজ্যের পদানত মানুষদের মনকে দখল করার নীলনক্শা। ইংরেজি স্কুলের সিলেবাসে টুকে দেওয়া গোপন শ্লোক। এক ভাষাকে খুন করে আরেক ভাষায় ‘সভ্যতা’র জয়ধ্বজা ওড়ানো। এ হচ্ছে সেই গোপন অস্ত্র, যার কোপে দেশ স্বাধীন হলেও মন থাকবে দখলে।
ভাষা ছিল সেই অস্ত্র, যার চাকতি চকচক করত না, তলোয়ারের মতো ঝলসাত না, কিন্তু একবার কেটে গেলে চিন্তাভাবনার গভীরে ক্ষত রেখে যেত। উপনিবেশের এই মৃদু অথচ নির্ভুল অস্ত্র দিয়ে খোদ শোষিতরাই ভাগ হয়ে যেত নিজস্ব শ্রেণিতে। তারা নিজেদের প্রাচীন রীতিনীতি, ভাষা, কথ্য-সংস্কৃতিকে তুলে ফেলে দিয়েছিল। যারা এটা করত, তাদের বলা হতো ‘সভ্য’। আর যারা ফেলে দিতে পারেননি, তারা দাঁড়িয়ে থাকত – অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত ইংরেজি-পড়ুয়া বড়লোকদের দিকে।
মেকলে ওই চিরচরিত বিদ্বেষপত্রের লেখক যিনি ইংরেজি-পড়ুয়া শ্রেণিকে বানাতে চেয়েছিলেন এমন বাহক যারা ‘জনগণের বৃহৎ অংশের কাছে জ্ঞানের বার্তা পৌঁছে দেবে।’ এই কথাগুলো তিনি লিখেছিলেন সেই নন্দিত-নিন্দিত ঘোষণায়, ‘মাইনুট অন ইন্ডিয়ান এডুকেশনে’। সংস্কৃত-আরবি-ভাষা ঘেঁটে মেকলে লিখলেন সেই বিখ্যাত বাণী যা পড়ে মনে হয় ঔপনিবেশিকতা ছিল আসলে এক প্রলম্বিত ভাষাপ্রকল্প। ‘আমি এমন একজনকেও খুঁজে পাইনি যে অস্বীকার করতে পারে, একটি ভাল ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি বইয়ের তাকের বই ভারত ও আরবের সমগ্র সাহিত্যভাণ্ডারের চেয়ে মূল্যবান।’এই উচ্চারণ, নিছক বিতর্ক নয়, আত্মার নিচে ডিনামাইট পুঁতে দেওয়া। মানে, আপনার ভাষাকে ছোট করার মাধ্যমে আপনাকেই ছোট করা। ভাষা দিয়ে ভাষাহীন করাই ছিল তাঁদের শ্রেষ্ঠ শিল্প।
মেকলে, তাঁর সময়ের বহু স্পর্ধিত চিন্তাবিদের মতোই, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশদের ছিল দেওয়ার মতো এক মহার্ঘ উইকিপিডিয়া, আর ‘নেটিভ’দের ছিল শুধু সান ডাস্ট আর কুসংস্কার।’ শেখার তো প্রশ্নই ওঠে না; ওরা হল সেই ‘ইতর’ যাদের ভাষা শুনলে সভ্যতা নাক শিটকায়। স্থানীয় ভাষা এবং সেই ভাষাভাষীরা তাঁর চোখে ছিল ধুলোমাখা জন্তু: রূঢ়, বর্বর, ইতিহাসের প্রাক্কালে আটকে থাকা ‘অন্তর্বর্তীকালের প্রাণী।’ তিনি স্পষ্ট করে লিখেছিলেন, ‘আমরা আরবি ও সংস্কৃত কলেজে যে অর্থ ব্যয় করি তা কেবল সত্যের পক্ষেই ক্ষতিকর নয়, এটা যেন ভ্রান্তির পক্ষে যোদ্ধা গড়ে তোলার পুরস্কার।’ তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, এসব কলেজ যেন ‘অন্ধবিশ্বাসের কারখানা।’
এই ঔদ্ধত্য একরকম মনোজৈবিক ছত্রাকের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে, বিভিন্ন ‘অভিষেক প্রকল্পে’। দক্ষিণ এশিয়ায় ছিল ‘সিভিলাইজেশনের (সভ্য করে তোলার) মিশন’, আফ্রিকায় ‘ক্রিশ্চানাইজেশন’ আর আমেরিকায় সোজা, খোলা স্লোগানে বলা হলো ‘নেটিভ আমেরিকানদের’ শিক্ষিত করা। সেই কুখ্যাত নীতিবাক্য, ‘ভারতীয়দের মেরে ফেলো, মানুষকে বাঁচাও।’ অর্থাৎ, ‘মানুষ’ হতে চাইলে আগে তাকে নিজের ‘ইন্ডিয়ান’ অংশটাকে গলাটিপে মারতে হবে। গন্ধ মুছে ফেলতে হবে মাটির, নাম বদলাতে হবে নদীর, কেটে ফেলতে হবে চুল, ছিঁড়ে ফেলতে হবে ভাষা। তাহলে নাকি সে ‘সম্পূর্ণ মানুষ’ – অর্থাৎ, ‘সভ্যতা’র অর্থ ছিল আত্মহত্যার টিউটোরিয়াল।
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো যখন সত্যিকারের ভাষা-প্রলাপে প্রবেশ করলেন, তখন তাঁর হাতে ছিল না কলম, ছিল না মঞ্চের আলো – ছিল কারাগারের ছায়া আর নির্জনতা। সালটা ১৯৭৭। কেনিয়া স্বাধীন হয়েছিল চৌদ্দ বছর আগে, অথচ নগুগির জন্য অপেক্ষা করছিল সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জেলখানা। অপরাধ গিকুয়ু ভাষায় লেখা একটা নাটক এবং তা মঞ্চস্থ করা। স্বাধীনতার পর আফ্রিকার সাহিত্যের প্রথম সারির কণ্ঠ, তাঁকেও পড়তে হলো সেই পুরনো পাঠ্যক্রম –: ‘স্বাধীনতা মানেই ভাষার স্বাধীনতা নয়।’
১৯৮২ সালে তিনি আবার নাট্যদল নিয়ে ফিরতে চাইলেন। কেনিয়ার পুলিশ সেই চেষ্টাও থামিয়ে দিল। এরপর দুই দশকের নির্বাসন। প্রথমে ব্রিটেনে, পরে আমেরিকায়। তাঁর নাটকে ছিল জোমো কেনিয়াত্তার শাসনযন্ত্রের নির্মম ব্যঙ্গচিত্র; যিনি নিজেও গিকুয়ু, তবু তার শাসনের ভাষা ইংরেজি। নাটকে দেখা যায়, ক্ষমতার কুঠুরি কীভাবে জনসাধারণের থেকে আলাদা এক প্রজাতি তৈরি করেছে, যেখানে কৃষকের মুখ ভুলে যায় নেতা, অভিজাত শ্রেণি হয়ে ওঠে জাতির প্রতিনিধি।
কিন্তু এই নাটক তো ইংরেজিতেও লেখা যেত, তাতে শাসকদলের সমালোচনা করলেও আগুন লাগত না। তাহলে এবার এত ভয় কেন? সত্যি বলতে, নগুগির ‘অপরাধ’ ছিল শুধু কথা বলা নয় – ‘কাদের ভাষায়’ কথা বলছেন সেটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইংরেজি ব্যবহার করেননি, কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন গিকুয়ু – যা ছিল শাসকের জন্য অস্বস্তিকর। কারণ, এই ভাষা না পড়ে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা বোঝেন না এই ভাষায় কী বলা হয়েছে, কিন্তু জানে ভাষাটা ‘ওদের’। যারা এখনো মাঠে-ঘাটে কাজ করে, রাত্রে পেট চেপে ঘুমোয়, তারা এই ভাষায় নাটক দেখে। অর্থাৎ, ক্ষমতার ছায়ায় গজিয়ে ওঠা সেই ইংরেজি ভাষাকেন্দ্রিক শ্রেণিকে পাশ কাটিয়ে নগুগি পৌঁছে গিয়েছিলেন আসল ‘দর্শক’-এর কাছে। এখানেই ভাষার বিপ্লব। এখানেই ছিল শাসকদের আতঙ্ক। একসময় যারা উপনিবেশবিরোধী ছিলেন, তাঁরাই হয়ে উঠলেন ভাষার পুলিশ। কারণ তারা বুঝতে পারলেন, কলোনি তো চলে গেছে, কিন্তু ক্ষমতার ছায়ায় এখন তার মুকুট পড়ে আছে ইংরেজি পরিমণ্ডলে। আর সেই মুহূর্তে কেউ যখন বলে, ‘না, আমি আর সেই ভাষায় লিখব না’, তা যেন শাসকের মঞ্চেই আগুন লাগিয়ে দেয়।
গিকুয়ুতে লেখা মানে স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ: ‘স্বাধীনতা হোক পুরোপুরি শুধু পতাকায় নয়, বাক্যে। শুধু প্রশাসনে নয়, ভাষায়।’ এই ভাষা বিপজ্জনক, কারণ সে খট করে কথা বলে। অনুবাদে দেরি লাগে না। সে হজম করিয়ে দেয় না শোষণ, সে খোঁচা মারে সরাসরি। সোজা কথা, এই ভাষা উপনিবেশবিরোধী চেতনার শেষ গোপন আস্তানা।
নগুগির কলম যখন এগিয়ে আসে ১৯৯৩ সালের Moving the Centre: The Struggle For Cultural Freedoms-এ, তখন তাঁর ভাষা আর ‘অভিজ্ঞ’ নয়; পরিণত হয়েছে অস্ত্রের মতো জ্বলজ্বলে এক সতর্কীকরণ বার্তায়। তিনি লিখলেন, ‘যে আফ্রিকীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ঔপনিবেশিকদের কাছ থেকে পতাকা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল, তারা জন্ম থেকেই ছিল সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক গর্ভে।’ অর্থাৎ, পতাকা বদলেছে, কিন্তু কাঁধে চেপে বসে থাকা হাতটা বদলায়নি। যতই তারা রাষ্ট্রপতির পদে বসুক, ভাষাটা থাকে লন্ডনের; দৃষ্টিভঙ্গিটা থাকে ইউরোপের কোনো মধ্যবিত্ত বসার ঘরের, যেখানে কফির কাপে চিনির বদলে ঢালা হয় উন্নয়নের স্লোগান। তাঁদের ইতিহাসবোধ, জাতীয়তা, ভাষা – সবই যেন ফ্রান্সের দর্জির তৈরি স্যুট, যা একবার গায়ে চড়ালে আর খোলা যায় না। নগুগি বলেন, এই শ্রেণি সবকিছু দেখত সেই চশমায়, যা চোখে পরিয়ে দিয়েছিল ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থা নামক এক সাংস্কৃতিক অপারেটিং সিস্টেম। এই সতর্কতা নতুন কিছু ছিল না; এর ভবিষ্যদ্বাণী আগেই করে গিয়েছিলেন ফ্রান্ৎস ফ্যানন। নগুগির প্রথম বই বেরোনোর তিন বছর আগেই ফ্যানন মারা যান, কিন্তু তাঁর লেখা যেন ছিল আফ্রিকার ভবিষ্যতের এক জ্যোতিষপত্র।
ফ্যানন বলেছিলেন, স্বাধীনতার পরে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্ষমতা নেয়, তারা ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে ওঠে উপনিবেশিক ব্যবস্থার দেশীয় এজেন্ট। তারা সাহস করে না কাঠামো বদলাতে, বরং সেই পুরনো কাঠামোর ওপর একটা নতুন জাতীয়তার চাদর চাপিয়ে দেয়। ক্লায়েন্টেলিজ়ম আর সম্পদের কেন্দ্রীকরণ – এসব দিয়ে তারা ঔপনিবেশিক ফাটলগুলো আরও বড়ো করে তোলে, যেন দেশের নাম বদলালেই ইতিহাস মুছে যাযয়। ফ্যাননের ভাষায়, ‘এই শ্রেণির দৃষ্টিতে তাদের ‘মিশন’ জাতিকে রূপান্তরিত করা নয়; বরং একেবারে সোজাসাপ্টা ভাষায় তারা হয়ে ওঠে জাতি এবং নগ্ন ছদ্মবেশী পুঁজিবাদের মাঝের সেতুবন্ধন – যা আজ ‘নব্য-উপনিবেশবাদ’ নামের মুখোশ পরে আছে। অর্থাৎ, শাসকের চেহারা বদলেছে, ভাষা পাল্টেছে, গান বাজে নতুন, কিন্তু স্ক্রিপ্টটা সেই পুরোনো। যা আগে ছিল ব্রিটিশ কোম্পানির রেজিস্ট্রি করা, এখন তা স্থানীয় পুঁজিপতিদের নামে নথিভুক্ত হলো। ব্যানার বদলেছে, অথচ মঞ্চের নিচে এখনও বসে আছে সেই দর্শক যারা নাটকে অভিনয় করে না, শুধু করতালি দেয়।
আজকের দিনে উপনিবেশবাদের যে প্রতিধ্বনি এখনো শ্রুতিগোচর হয়, তা আর রাজনীতির ছায়ায় নয়, বরং মানসিক ছাঁচে তৈরি। অনেক প্রাক্তন উপনিবেশ এখনো যেন নিত্যনতুন ‘ভদ্র’ হবার খোঁজে পশ্চিমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে; ঠিক যেন শিক্ষকের মুখে প্রশংসা শোনার আশায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্র। নিজের পরিচয়ের বৈধতা যেন এখনো খোঁজে সেই মেকলীয় ফ্রেমে; যেখানে উন্নয়ন মানে ‘পশ্চিমমুখী গতি’, সংস্কৃতি মানে ‘ইউরোপের অনুকরণ’ আর ভাষা মানে ‘ইংরেজির নির্ভরযোগ্যতা’। মেকলে ও তাঁর সহচররা পশ্চিমা মূল্যবোধকে দাঁড় করিয়েছিলেন এক ‘সোনার মানদণ্ড’ হিসেবে – একটি আদর্শ স্কেল, যা দিয়ে পুরো দুনিয়াকে মাপা যাবে, একটাই স্কোরকার্ডে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল ‘ভাষানীতির পাঠক্রম’ – শিক্ষার মোড়কে এক অদৃশ্য অথচ অত্যন্ত কার্যকর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। আজও আফ্রিকার বহু দেশের নামী স্কুলে সাহিত্যপাঠ শুরু হয় ইংরেজি সাহিত্য দিয়ে। শেক্সপিয়ার দিয়ে শুরু হয় সেমিস্টার, ব্রন্টেকে দিয়ে পরীক্ষা। কারণ, ইংরেজি সাহিত্য এখনো পাঠ্যক্রমে হাজির ‘আদর্শ’ হিসেবে। সাহিত্য মানে যেন এসবই, বাকিগুলো শুধু আঞ্চলিক ‘সাহিত্যচর্চা’।
আর আফ্রিকান সাহিত্য? পাঠ্যসূচিতে থাকে একেকটা টিক চিহ্নের মতো। ক্লাস শেষ হওয়ার আগে ‘পরিশিষ্ট পড়ে নিই’ ধরনের অনুশীলনে। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা নিঃশব্দে ঘটছে তা হলো আফ্রিকার মৌখিক সাহিত্যের ঐতিহ্য, একসময় যা ছিল জীবনের স্পন্দন, মানুষের গল্পের দিকনির্দেশক, সেটা পাঠ্যসূচিতে ক্রমেই হারিয়ে গেছে। মুখে বলা গল্প বা মৌখিক গল্পের রীতি এখন এক প্রাগৈতিহাসিক জিনিস; নোটবই না হলে সেটা সাহিত্যও নয়। এই ভাবনার ভেতরেই লুকিয়ে আছে উপনিবেশের সেই সুনিপুণ উত্তরাধিকার, যেখানে ভাষার মূলে থাকে আধিপত্য, আর চুপ করে থাকা গল্পেরা হারিয়ে যায় ‘পড়ার যোগ্যতা’ না থাকার অপরাধে। এই দীর্ঘমেয়াদি মানসিক দখলদারির চক্র ভাঙার জন্য আজ এক নতুন ঢেউ উঠছে – আলো নিভিয়ে নয়, চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন ছোঁড়ার ঢেউ। পোস্টকলোনিয়াল এশীয় প্রেক্ষাপটে কাজ করা সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিকরা আজকাল আর ‘ওদের সঙ্গে তাল মেলানো’র গরিমা নিয়ে ব্যস্ত নন, বরং তাঁরা বলিষ্ঠ আন্তএশীয় পঠনের (inter-Asian studies) পক্ষে জোর সওয়াল করছেন। তাদের কথা, এশিয়ার মধ্যে নিজস্ব বোঝাপড়া, বিনিময়, আর পর্যালোচনার এমন এক পরিসর তৈরি করতে হবে যা পশ্চিমের ছায়া হয়ে চলবে না। তাঁরা খতিয়ে দেখছেন সেই সূক্ষ্ম, প্রায় অদৃশ্য উপায়গুলো, যেভাবে ঔপনিবেশিক সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ আজও ঘটে চলেছে; সাহিত্য অনুবাদের কথাই ধরুন, শক্তিশালী ভাষা থেকে দুর্বল ভাষার দিকে অনুবাদ হয় ‘প্রচারে’, উল্টোটা হয় ‘প্রয়োজনে’। এই প্রতিবাদ-আন্দোলনের মূলে আছে এক অটল বিশ্বাস: যতদিন পশ্চিম মানদণ্ড হয়ে থাকবে, ততদিন মুক্তি নামের কোনো ঘোষণাই পূর্ণ হবে না। উপনিবেশমুক্তির অনুষ্ঠান থাকবে, কিন্ত তা হবে নিষ্প্রাণ।
নগুগির দৃষ্টিতে এই আত্মবৈধতার অন্বেষণ এখনও চলছে। আমরা যেন ‘আমরাই ‘, সেটা ওরা বলুক’ ধরনের মানসিক প্রশান্তি নিয়ে আছি। আর ফ্যাননের সেই বিখ্যাত ‘পরিবর্তন রেখা’ – পশ্চিম থেকে আসা সংস্কৃতি, বাণিজ্য, নীতি ইত্যাদি খুঁটিনাটি টানছে স্বাধীন রাষ্ট্রের নড়বড়ে কাঠামোকে। সরকারগুলো, বিশেষ করে উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো, আজও অনেকাংশে কাজ করছে পশ্চিমা কর্পোরেটের স্বার্থ আর দেশীয় লুটপাটের মধ্যে মধ্যস্থকারী হিসেবে। তারা নিরপেক্ষ নয়, সুবিধাভোগী মধ্যস্থতাকারী। এর সবই প্রমাণ করে, যুদ্ধশেষে সবচেয়ে স্থায়ী হিসেবে যা টিকে যায় তা কামানের আওয়াজ নয়, মনস্তাত্ত্বিক দখল। এই দখল ঘটা করে ঢাক বাজিয়ে আসেনি, কিন্তু নিঃশব্দে মাথায় চেপে বসেছে। আর এর বিরুদ্ধে কাঁধে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ চালাতে হয় না; চালাতে হয় ভাষা দিয়ে, প্রশ্নের খোঁচায়, আর নিজের চোখে নিজের মানদণ্ড দাঁড় করিয়ে। এটাই হলো আজকের উপনিবেশবিরোধী যুদ্ধের মেরুদণ্ড। আবেগ নয়, আত্মবোধের শাণিত আত্মরক্ষাই মূল কথা।
আফ্রিকা এবং তার বাইরেও এখন একধরনের সাহিত্যিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে – শব্দ দিয়ে, ছন্দ দিয়ে, আর নিজের মাতৃভাষা ফিরিয়ে এনে। বহু আন্দোলন এখন স্থানীয় ভাষায় সাহিত্যচর্চার পুনর্জাগরণের পক্ষে সোচ্চার, যেন বইগুলো আবার খুঁজে পায় তাদের জন্মভূমির মাটি, তাদের লোকগানের সুর, তাদের লিপিহীন ইতিহাসের পুনর্জন্ম। এই আন্দোলনের দুই ধারে চলছে দুটি পথ, একদিকে অনুবাদপ্রকল্প, যারা আফ্রিকান লেখকদের লেখা খুলে দিতে চায় বহির্বিশ্বের পাঠকের কাছে। অন্যদিকে আবার সেই অনুবাদই যেন এক বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে নিচের ভাষায়, যেন সাহিত্য তার মূল ঘরে ফিরে এসে বলে, ‘আমি এখনও এখানে আছি।’ এই চেষ্টার এক অনবদ্য উদাহরণ Jalada Africa – এক প্যান-আফ্রিকান প্রকাশনা প্ল্যাটফর্ম, যারা ইংরেজি ও বিভিন্ন আফ্রিকান ভাষার লেখকদের কাজ অনুবাদ করে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটি কেবল অনুবাদ নয়, এটি এক ভাষাভিত্তিক বিদ্রোহ, যেখানে ‘বহু ভাষা’ মানে বিশৃঙ্খলা নয়, বরং আত্মপরিচয়ের বহুবচন।
একইভাবে, সেনেগালের Céytu প্রকল্পও অনুবাদকে অস্ত্র করেছে; ফরাসি-ভাষার সংস্কার করতে চাওয়া ভদ্রলোকদের মুখের উপর ছুঁড়ে মারার জন্য। সেনেগালের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কথা বলেন ওলোফ ভাষায়, যার মৌখিক ঐতিহ্য অজস্র, কিন্তু লিখিত সাহিত্য অপ্রতুল। Céytu বলছে এই খরা কাটাতে হবে গল্প দিয়ে, আর সেটা ওলোফে বললেই কেবল গাছটায় ফুল ফোটানো যাবে। তবে সব লেখক এই পথে হাঁটছেন না। সালমান রুশদির মতো অনেক খ্যাতিমান লেখক যুক্তি দেন – ইংরেজির বিপুল পাঠকসংখ্যার কাছে পৌঁছানোটা প্রতীকী রাজনৈতিক বার্তার চেয়েও কার্যকর। তাঁদের মতে, লেখকের ভাষা হলো সেই যানে চেপে চলা যা পাঠকের মগজে পৌঁছায় আর গন্তব্য যদি জরুরি হয়, তবে যানের কথা ভেবে লাভ নেই। ফলে, অনেক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আফ্রিকান লেখক, এশীয় লেখক, যারা ইংরেজিতে তাঁদের খ্যাতি গড়েছেন, নগুগির মতো নিজের ভাষায় ফিরতে চাননি—তাঁরা হয়তো মনে করেছেন, রণক্ষেত্রে দাঁড়ানোটা জরুরি, কোন ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবুও প্রশ্নটা থেকেই যায় – কে নির্ধারণ করবে ভাষার গুরুত্ব? যিনি লেখেন তিনি, না কি যিনি পড়েন, তিনি? এবং শেষমেশ, কোথায় পাঠকের হৃদয়? মূল শব্দে, না মূল সুরে?
যদি আমরা সত্যিই বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ‘কল্পিত সম্প্রদায়ে’র (Imagined Communities) সেই অন্তর্দৃষ্টি মেনে নিই, যেখানে ভাষা কেবল কথোপকথনের মাধ্যম নয়, বরং তা অতীতের স্মৃতিচারণ, ভবিষ্যতের রূপরেখা এবং একসাথে থাকার কল্পনার ছাঁচ তৈরি করে; অবধারিতভাবেই তাহলে আমাদের দাঁড়াতে হয় এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি : উপনিবেশ-পরবর্তী সমাজগুলোতে মাতৃভাষার অবনমন কি এই ছিন্নভিন্ন ইতিহাসের মৌলিক কাঠামোগত অপরাধ? ভাষা ছিল সেই সূক্ষ্ম অস্ত্র, যা না কাঁদাত, না রক্ত ঝরাত। তবে দীর্ঘমেয়াদে জাতির চেতনায় এমন পেরেক ঠুকত, যা চোখে পড়ত না, কিন্তু শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে দিত। এটা ছিল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বহু ‘divide-and-rule’ কৌশলের এক পাতা, যার অন্য পাতায় ছিল জাতি, গোত্র, বর্ণভিত্তিক ভেদাভেদ। ইউরোপীয় জাতিবিজ্ঞানীরা সাদা কোট পরে ঠিক করে দিয়েছিলেন কে কিসের ‘উপর’ ‘কতটা সভ্য’; কারা হবে ‘উপযুক্ত মিত্র’। আর এসব নিয়েই তারা বানিয়েছিল এমন এক সামাজিক ককটেল, যার প্রভাবে বহু দেশে স্বাধীনতার বহু দশক পরেও রক্তপাত থামেনি। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণকৌশলের কোনোটাই একক, বিচ্ছিন্ন ছিল না। বরং, তারা ছিল একসঙ্গে বোনা দুঃস্বপ্নের গদি – একটার সুতো আরেকটার ভরসায় গাঁথা। শাসনের এই পরস্পর-নির্ভর কাঠামো ছিল এতটাই নিখুঁত যে তা চোখে পড়ে না – শুধু ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে সমাজ, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয়। নগুগির কথাতেই সেটা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে : ‘একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে, তাদের আত্মপরিচয় গঠনের যন্ত্রগুলো নিজেদের হাতে নিয়ে নেওয়া।’ এটা শুধু বই না পড়ার সমস্যা নয়, এটা ‘আমি কে’ সেই প্রশ্নে এক নীরব ব্যাঘাত।
সবচেয়ে গভীর ট্র্যাজেডি লুকিয়ে আছে এখানেই। আজ সেই শাসনদণ্ড রয়েছে তাদের হাতে, যারা একদিন এর বিরুদ্ধেই অস্ত্র তুলেছিলেন। ইতিহাসের নির্মম রসিকতাটা এমন – শত্রুকে তাড়িয়ে দিয়ে আমরা তাঁর গলা রেখে দিয়েছি, কণ্ঠস্বর রেখে দিয়েছি, ভাষা রেখে দিয়েছি। শুধু মুখটা পাল্টেছি। এটাই নগুগির সবচেয়ে তীক্ষ্ণ, সবচেয়ে যন্ত্রণায় মোড়ানো বার্তা – আজকের শাসকের গলায় সেই পুরনো স্বর। শুধু গায়ের চামড়ার রঙ পাল্টেছে, বাকিটা একই। স্বাধীনতা এলো, কিন্তু গলা সেই ঔপনিবেশিক কণ্ঠেই হাঁকে : ‘হয় ইংরেজিতে কথা বলো, অথবা চুপ থাকো (Speak English, or stay silent)। সত্যি, ছায়াও একধরনের শাসন; আমরা শত্রুকে তাড়িয়েছি কিন্তু তার ছায়া বুকেই পুষে রাখছি।