Site icon তীরন্দাজ

স্মৃতির ঈশান কোণে দাঁড়িয়ে | দীপেন ভট্টাচার্য | আমার নববর্ষ | তীরন্দাজ নববর্ষ সংখ্যা

Rekha Akter

তীরন্দাজ নববর্ষ সংখ্যা

মানুষের স্মৃতি এমন একটি জিনিস যা রক্ষা করা খুব দুষ্কর। আর স্মৃতি হারিয়ে ফেললে মানুষটি আর সেই মানুষ থাকে না। ছোটবেলার স্মৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা তাই চাই নিজের সত্তাকে হারিয়ে না ফেলার এক প্রয়াস। আমাদের বাড়ির পেছন দিকের বাড়িগুলিতে যাবার জন্য একটা বড় জায়গা ছিল, সেখানে আমরা গোল্লাছুট, কানামাছি, লুকোচুরি খেলতাম।বছর শেষে, চৈত্র মাসের এই সময়টা কালবৈশাখীর সঙ্গে যুক্ত থাকত। সারাদিনের উষ্ণতার পরে হঠাৎ করেই আকাশ কালো করে ঝড় আসত। ‘ওই বুঝি কালবৈশাখী সন্ধ্যা – আকাশ দেয় ঢাকি, ভয় কীরে তোর ভয় কারে, দ্বার খুলে দিস চারধারে…’ রবিঠাকুর যা-ই বলুক না কেন, আমরা কিন্তু ভয় পেতাম। খেলা ছেড়ে দৌড়ে বাসায় ঢুকতাম। সেই ঝড় হয়তো আধঘণ্টা থাকত, তবু এত বছর পরেও সেই ক্ষণকালের দমকা বাতাস, বজ্র-বিদ্যুৎ, বৃষ্টি, মাঝে-মধ্যে শিলাবৃষ্টি মনে হয় এই সেদিনের কথা।

এতদিন ধরে আমি ভেবে এসেছি ঈশান কোণ, অর্থাৎ উত্তর-পুব দিকে থেকে ওই কালবৈশাখীগুলো আসত, কিন্তু দেখলাম কালবৈশাখীর মূল উৎস বায়ু-কোণ, অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম। তাহলে ঈশান কেন মনে এত দাগ কেটে রেখেছে? হয়তো উত্তর-পুব মানে ভোরের সূর্যের আগমনরশ্মি, অথবা বাড়ির তুলসী গাছটির অবস্থান, মা’র পূজার ঘর। এসবই মনকে বাইরের পৃথিবীর শত ঝঞ্ঝার মধ্যেও একটা শান্তিতে ভরিয়ে রাখত।

স্বাধীনতার আগে, ১৯৭১ সালের আগের বছরগুলোর কথা। বছরের প্রথম দিনটিতে নতুন জামা পেতাম। সকালে উঠে বাবা আর মা’র সাথে যেতাম রমনা কালীবাড়ি। আজকের সোহরওয়ার্দি উদ্যানের, তখনকার রেসকোর্সের ঠিক মাঝখানে ছিল মন্দিরটি। ১২০ ফুট উঁচু ছিল তার চূড়া। কালী বিগ্রহটিতে পৌঁছুতে হলে কিছু সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হতো। আমার শিশুমনে মনে হতো একটি পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে ওপরে, মা উঠে যেয়ে ওপর থেকে আমাকে ডাকতেন। নিচে থেকে মাকে দেখে মনে হতো বহু উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছেন, ওখানে কী পৌঁছাতে পারব? মা’র সেই ডাক এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। ওপরে উঠে, প্রণাম সেরে, প্রসাদ নিয়ে, নিচে নামতাম, মনে হতো বছর শুরু হলো।

আপনারা জানেন ১৯৭১-এর ২৭শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনি মন্দির প্রাঙ্গনের আশ্রমনিবাসী এবং অন্য আশ্রয়প্রার্থী মিলিয়ে প্রায় এক শ’র মতো মানুষকে হত্যা করে। শুধু এটুকু করে তারা ক্ষান্ত হয়নি, ডাইনামাইট দিয়ে মন্দিরটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই সেখানে মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়নি, যদিও উদ্যানের এক কোনায় বর্তমানে রমনা কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেটি মূল স্থাপত্যের একটি মলিন চিত্র মাত্র। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের, কিংবা তখনকার ঘোড়-দৌড়ের বিভিন্ন ফটোতে ওই মন্দিরটির সূউচ্চ চূড়াটি দেখা যাবে। আমার ছোটোবেলার পহেলা বৈশাখের সাথে এই হারিয়ে যাওয়া মন্দিরটির স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

১৯৬৭ থেকে মনে হয় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। রমনা কালীবাড়ি থেকে তখন আমরা রমনা পার্কে যেতাম। অশ্বত্থতলায়, যাকে আমরা বটমূল বলে জানি, অশোক আর বট নাকি একই গোত্রভুক্ত? তবু এতদিন পরে ভাবতে ইচ্ছে করে – রমনার অশ্বত্থ-তলা বললেও কি আমাদের মনের গ্রহণে বাধত? তখন তো এই ভীড় হতো না, ছায়াময় অশ্বত্থ তলায় শিল্পীদের একদম কাছাকাছি যেয়ে বসা যেত – তাঁরা গাইতেন, ‘ আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও।’ গান যে খুব একটা বুঝতাম এমন নয়, কিন্তু বর্ষশুরুর সকালের স্নিগ্ধতায় ভরে থাকত উদ্যানটি, যেটির একটি কোনায় ছিল শিশুদের জন্য খেলার জায়গা। সেখানে আমাকে মাঝে মধ্যে নিয়ে আসা হতো, বড়রা ভেতরে ঢুকতে পারত না, আমি যেয়ে অচেনা ছোটোদের সাথে খেলতাম, হয়তো ১৯৬৬-এর দিকের কথা সেটা।

এরপরে আমাদের উয়ারির বাসায় ফিরে এলে পরে, বাবার কিছু মক্কেল হালখাতা উপলক্ষে ঢুঁ দিয়ে যেতেন। তাঁরা অনেক সময় মাছ নিয়ে আসতেন – শোল, মাগুর কী কৈ। ওই সময়ে মাছ যে পাওয়া যেত সেটাই ছিল আমার কাছে আশ্চর্যের বিষয়। আমরা খনার বচন আওড়াতাম – চৈত্রে চালিতা, বৈশাখে নালিতা। খরার তীব্রতায় মাছ কচুরিপানার চালিতা থেকে সরু নালায় চলে যায়। তখন থেকে কৈ আমার খুব পছন্দ ছিল, শুধু ইদানীং কালে এসে সেই পছন্দে ভাটা পড়েছে, হয়তো ছোটোবেলার সেই স্বাদটা আর পাই না বলে।

আকাশ নিয়ে আমার আগ্রহ সেই সময় থেকেই, আর বৈশাখ নামের সাথেও তো আকাশের এক গভীর যোগ আছে – পূর্ণিমার চাঁদ এই সময় আকাশের বিশাখা নক্ষত্রমণ্ডলে থাকে বলেই মাসটির নাম বৈশাখ। ভাবলে অবাক লাগে, সময়ের এই সরল হিসাব প্রকৃতি আর মহাকাশকে এমন মেলবন্ধন করে রেখেছে। এখনো চৈত্র সংক্রান্তির পরে সূর্য মীন রাশি পেরিয়ে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে, সেই পথ ধরেই শুরু হয় নতুন বছর। কিন্তু চৈত্র বা বৈশাখের নিদাঘের তীব্রতা এখনকার মতো অগ্নিবাণে জর্জরিত করত না।

চৈত্র মাসের শেষে চরক মেলা শুরু হতো। ঢাকায় সেই মেলা হতো কি না জানি না, কিন্তু একবার ওই সময়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। বুধবারে ছোটো হাট, আর শনিবারে বড় হাট বসত। শুকনো নদী পার হয়ে, ধুলো উড়িয়ে পিঠে চালের বস্তা নিয়ে আসত শীর্ণকায় ঘোড়াগুলো। মেলার সঙ্গে নিয়মিত হাট মিশে যেত। চরক গাছ মানে উঁচু কাঠের কাঠামো, তাতে দড়ি বেঁধে মানুষকে তুলে ঘোরানো হয়। খেয়াল আছে দুঃসাহসী ডাকাবুকো কিছু ছেলে পিঠের চামড়ায় লোহার হুড়কো লাগিয়ে উঠে যেত, আর আমার তো এই দৃশ্য দেখার মতো সাহস থাকেনি, চরক ঘোরার আগেই বাড়ির দিকে দৌড়।

এখন বহুদিন নববর্ষে আমার দেশে থাকা হয় না। ২০০৭ সালে ঢাকায় একটা কাজ নিয়ে একবছর ছিলাম, তখন অনেক দিন পরে রমনা বটমূলে গিয়েছিলাম। নিরাপত্তা খুব জোরদার ছিল সেদিন। ছয় বছর আগে, ২০০১ সনের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ওইখানে একটি বোমা হামলা হয়, তাতে উপস্থিত নয়জন প্রাণ হারান। বলতে বাধা নেই মাঝখানে ছ’টি বছর কেটে গেলেও সেদিন যে কিছুটা আতঙ্কিত ছিলাম না এমন নয়। তার পর গিয়েছিলাম মঙ্গল শোভাযাত্রায়। আর এখন বিদেশে বসে গুটিকয়েক মানুষ নিয়ে আমরা প্রতি নববর্ষে ছোটো করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করার চেষ্টা করি।

বাংলা নববর্ষ কিছুটা আন্তর্জাতিকও বটে – একদিকে বাংলা, পাঞ্জাবি, কোঙ্কিনি, তেলেগু, তামিল অন্যদিকে বার্মা, থাই, খেমের, বালি পর্যন্ত বছরের এই সময়ে নববর্ষ পালিত হয়। আবার মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, একে বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে বর্ষবরণের পালনকেও নানাবিধ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এবারও সেটার অন্যাথা হয়নি। কিন্তু সমস্ত বাঙালি জাতি – ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই আনন্দ-উৎসবে যোগ দিতে পারে – এটাই বর্ষবরণের বড় শক্তি। আর শুধু বাঙালি কেন – চাকমাদের বিজু, রাখাইনদের সাংক্রান, মারমাদের সাংগ্রাই, ত্রিপুরিদের বোইসু, মনিপুরীদের চেইরাওবা – তাদের সবারই বর্ষবরণ এই সময়েই হয়; কাজেই সেই অর্থে সারা বাংলাদেশের প্রায় সব জাতিই এতে সমানভাবে অংশগ্রহণ করে। এই ঐতিহ্য আমাদের সবার গর্ব, তা শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, বর্তমানের উৎসব, ভবিষ্যতের আশাবাদ। তাতে অংশ নিয়ে আমরা আনন্দ পাই, আবার নতুন বছরের জন্য সবার মঙ্গলকামনা করি। এর মধ্যেই আমার সেই ছোটোবেলার বৈশাখটা রয়ে গেছে – মা’র ডাক, ঈশান কোণ থেকে আসা বাতাস, কালবৈশাখীর ঝঞ্ঝা, নতুন জামা, রেসকোর্স আর রমনা পার্কের সেই শান্ত সকালের স্নিগ্ধতা – এসবের মধ্যে জমা আছে হারানোর ব্যথা আর মায়াময় স্মৃতি।

Exit mobile version