Site icon তীরন্দাজ

তখনি বৃষ্টি এলো | নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো | মোবাশ্বেরা খানম অনূদিত ছোটগল্প | তীরন্দাজ থিয়োঙ্গো সংখ্যা

নিওক্যাবি বয়ে আনা জ্বালানিকাঠের পাঁজাটা ওর দুর্বল পিঠের ওপর থেকে ফেলে দিল। পাঁজাটা ওর কুঁড়েঘরের দরজার বাইরে শক্ত মেঝের ওপরে জোরে গোঙ্গানোর মতো শব্দ করে পড়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত হাতটা আলতোভাবে পেছনে দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গভীর অস্পষ্ট একটা শ্বাস ফেলে তারপর কাঠের বোঝাটার ওপরে বসে পড়ল ও। বাড়ি ফিরে এসে কী ভালই লাগছে। সারাদিন গাধার মতো হাড়ভাঙা খাটুনি করার পর বাড়ি ফেরার পরে অবসরটা খুব ভালো আর মিষ্টি লাগে।

সারাটা জীবন ও কাজ করেছে। একটা দিনের জন্যও একটু আরাম পায়নি। ও ভেবেছে এটাই ওর হতাশা আর দুঃখগুলোকে কবর দেয়ার সবচেয়ে ভালো উপায়। কিন্তু লাভ হয় নি। জীবনটাকে ওর অর্থহীন মনে হলো। এভাবে বসে থেকে সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগল শরীর আর মনে।

ও জানে যে ওর বয়স হয়ে যাচ্ছে। মাত্র ক’সপ্তাহ আগে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে গিয়ে দেখেছিল আগের সেই ঘন কালো চুলের ঢালে দু’তিনটে ছাই রঙের সুতোর মতো ছুঁয়ে আছে। ও কেঁপে উঠেছিল, তারপর ভেবেছিল আর কখনোই আয়না দেখবে না। এত বয়েস হয়ে গেল, বাচ্চা হলো না! সেটাই চিন্তা! ভাবাই যায় না। ও বাঁজা।

অনেক আগেই ও আবছা আবছা এটা জানতে পারছিল। এই জানাটা ওর কাছে, এই সামাজিক অবস্থায় এর অর্থ, মনের গভীরের ব্যাথা হয়ে বেজেছে। অপূরণীয় এক ক্ষতির বোধ আর হতাশার একটা স্থুল পোকা হাড়ের মজ্জায় মজ্জায় মোচড় দিচ্ছিল আর ধীরে ধীরে কুরে কুরে খাচ্ছিল।

এটা ছিল মানুষের জীবনের সেই বিশ্বাসভঙ্গের হতাশার মতো যা একজন বোধ করে, যখন তার সারা জীবনের স্বপ্ন ও বড় আশাগুলো আর বাস্তবে রূপ নেয় না।
নিওক্যাবির আনেক আশা ছিল। আর সেগুলোর স্থির কেন্দ্র নিবদ্ধ ছিল ‘অনেক গুলো বাচ্চা’য়। শুরু থেকে ওর একটাই ইচ্ছে ছিল, বিয়ে করবে আর বাচ্চা হবে। সব সময় ও নিজেকে দেখতে পেত একজন বয়স্ক মহিলা হিসেবে, ওর পুরুষ মানুষটাকে নিয়ে রাতে একটা জ্বলন্ত আগুনের পাশে বসে আছে, আর বাচ্চারা বড় বড় চোখে মুখ হাঁ করে ওদেরকে ঘিরে বসে কাছে, ওদের লোকেদের গল্প শুনছে। ওর মানুষটাকে ঠিকই পেয়েছে, যেমন স্বামী ও চেয়েছিল… কিন্তু… কিন্তু মুরুঙ্গু ওকে কিছু পাঠান নি। উনি ওর কান্নার উত্তর দেন নি, ওর আশা আকাঙ্ক্ষার উত্তর দেননি। ওর সব চাইতে বড় আশাই তো পূরণ হয়নি।

একটা কামড়ে ধরা ঈর্ষা ওর মাঝে জন্ম নিয়েছে। এই উঁচু ঢালটায় বাস করা সব মহিলার সঙ্গ ও এড়িয়ে গেছে এবং যে কোনো বাচ্চার নিরাময় করা স্পর্শও। এই সব নারী, পুরুষ, শিশু সবাই কি ওর বিরুদ্ধে দল পাকায়নি? ওরা সবাই কি একজন আরেকজনকে চোখ ঠারেনি ওর দিকে আঙুল তুলে? তাই ও যা চেয়েছে তা হলো নিজের পৃথিবীর মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে।

এমনকি ওর ছোটবেলার সঙ্গী এনজেরি, যার বিয়ে হয়ে যাবার পর এই একই ঢালে থাকছে, সে-ও হঠাৎ করে ওর শত্রু হয়ে গেল। নিওক্যাবির ঈর্ষাই ওকে এনজেরির বাড়ি যেতে দেয়নি। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী যখনি ওর বাচ্চা হয়েছে, তাদেরকে দেখতে যায়নি ও। এনজেরির বাচ্চাদের কথা নিওক্যাবি কিছুই জানে না। তাহলেই বুঝতে পারছেন ওর ক্লান্তি তো এই ঘণ্টাখানেকের পরিশ্রমের জন্য নয়, বরং এ হলো সারা জীবনের জমে ওঠা অবসাদ। নিওক্যাবির মনে পড়ল ওর মা যেসব সময় সুর করে গাইতে পছন্দ করত, ছোট ছোট ক’টা পংক্তি :

বাচ্চা ছাড়া কোনো মেয়ে, একটি বাচ্চা,
অবশ্যই তার ক্লান্ত লাগে, অবসাদ,
বাচ্চা ছাড়া এক মেয়ে, নিশ্চয়ই সে একা
ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে একদৃষ্টিতে মাটির ঘরটার দিকে তাকিয়ে রইল, যেখানে ও আর ওর পুরুষ মানুষটা এত বছর ধরে থাকছে। মনে হলো বুঝি মা ওর জন্যেই গান গাইত। হতে পারে ও অভিশপ্ত? হতে পারে ও পরিচ্ছন্ন নয়? কিন্তু ওর স্বামী তো ওকে অনেক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে, কেউই ওকে সারাতে পারেনি।

যে ব্যাথা ওর মনটাকে ভরে রেখেছিল হঠাৎ সেটা ধেয়ে উঠে অন্তরটাকে চেপে ধরল, গলার কাছে উঠে এলো। এগুলো সবই খুব বাস্তব, এই জিনিসটা। ওর গলা চেপে ধরছে, ওকে মেরেই ফেলবে। নামহীন এই জিনিসটা খুব বেশি হয়ে উঠেছে ওর জন্যে। উঠে দাঁড়ালো ও, নিজের কুঁড়েঘরটা থেকে, ঢালটা থেকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে লাগল দূরে, কোথায় যে যাচ্ছে তা যদিও জানে না। ‘নিশি’তে পাওয়া একটি প্রাণীর মতো ও ছুটছিল। ওপরে আকাশে সূর্যের রক্তচোখ, সেও এখন ঢলে পড়ছে তার নিজের বিশ্রামের জায়গায়। কিন্তু এই নারীটি তার বাড়ি ছেড়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। বসতে পারছে না, বিরাম নিতে পারছে না। ওই জিনিসটা ওকে থামতে দেবে না।

ঢালের ওপরে উঠে গেল ও। কিছুই দেখতে পেল না, বোধও করল না। ওর সামনে ফালি ফালি চষা জমি, উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত, ঝোঁপ আর জঙ্গলের সাথে মিশে গেছে নীচে উপত্যকায় নেমে গেছে। মেয়েদের দেখা যাচ্ছে নানারকম বোঝা বয়ে নিয়ে ঢাল বেয়ে বেয়ে বাড়ির দিকে উঠে যেতে। ওদের মধ্যে একজন ছিল এনজেরি। যন্ত্রের মতো অথবা বলা যায় নেহাত প্রবৃত্তির বশে নিওক্যাবি ওদেরকে এড়িয়ে গেল। ও মাঠ পেরিয়ে কোণাকুণি হেঁটে গেল আর একটু পরেই উপত্যকায় পৌঁছে গেল। সমান পেটানো রাস্তাটা এড়িয়ে ঝোঁপের ভেতর দিয়ে ও যাচ্ছিল। কাঁটাগুলো শরীরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল, তবুও ঠেলে যেতে লাগল নীচের বুনোজঙ্গল আর জড়িয়ে ধরা লতাপাতার জঞ্জাল পেরিয়ে। পুরো জায়গাটির বন্যতা আর ফাঁকা শূন্যতা অদ্ভুতভাবে মিশে গিয়েছিল ওর মনের পাগলামিটার সাথে। এমনকি এখনো ও জানে না কোথায় যাচ্ছে ও। একটুক্ষণের মধ্যেই ও নিজেকে দেখতে পেল জঙ্গলের সেই দিকটায় যে দিকটায় আগে কখনো আসেনি ও। কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না, আকাশ মনে হয় বদলে গেছে। হাসি হাসি মেঘগুলোকে আর ও দেখতে পাচ্ছে না, কারণ বন খুবই গভীর হয়ে এসেছে। এই প্রথম ও থমকে দাঁড়ালো, ভয় পেল বনের গভীর রহস্যের মধ্যে ডুবে যাবার। কিন্তু সেই নামহীন বস্তুটি ওকে কেবলি যেতে বলছে, যেতে।

বনের ভেতরে একটা লম্বা পাথর ছিল। এটি দেখলে মনে হতো যেন পথিকদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। নিওক্যাবি ওটার ওপরে বসল। একটু একটু করে বোধশক্তি ফিরে পাচ্ছিল। কিন্তু এখনো ও বিভ্রান্ত আর শারীরিকভাবে খুবই ক্লান্ত। সময় বুঝতে পারছিল না, কতক্ষণ হেঁটেছে তাও না। জোরে নয় ফিসফিসিয়ে একটি কণ্ঠ কথা বলে উঠল,
‘…এই মেয়েলোক এখানে থাকলে তো তুমি মরে যাবে, একা নারীরা যেমন ভূতে পেলে মরে…।’
কিন্তু ও তো মরতে চায় না। এক্ষুনি তো নয়ই। ও উঠে দাঁড়ালো, নিজেকে টেনে নিয়ে গেল। এখনো হতাশার পরিত্যক্ত ঘন মেঘ ওকে চেপে ধরে আছে। তবু শেষ পর্যন্ত নিজেকে খোলা জায়গায় টেনে আনতে পারল। খোলা? তা নয় পুরো জায়গাটাই একঘেঁয়ে ফাঁকা লাগছে। সূর্যটা আগে-আগেই ডুবে গেছে, আর নিষ্প্রভ ধূসর ছায়া পৃথিবীকে ছেয়ে ফেলেছে। ঠান্ডা শীতল একটি বাতাস বইতে শুরু করেছে আর যত জঞ্জাল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আকাশের মুখে বলিরেখা, আর রাগী মেঘ জমছে। তারপর বিদ্যুচ্চমক, কান ফাটানো বাজ আছড়ে পড়ল। আকাশ কাঁপছে, তার পায়ের নীচে মাটি থর থর করছে। আর কোনো আগাম বার্তা না দিয়েই বৃষ্টি নেমে এলো।

প্রথমে ও এতই অবাক আর হতবাক হয়ে গিয়েছিল যে, নড়তেই পারছিল না। প্রথম বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা ওর শরীরে পড়তে একটি শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল। হ্যাঁ, প্রথম নরম ফোটাগুলো একটি আরামের বোধ তৈরি করল। ওর মনে হলো ওর শীতল হৃদয়টাকে এই ঠান্ডা বৃষ্টির কাছে মেলে ধরতে পারে। ও কাঁদতে চাইল, বা চিৎকার করে বলতে চাইল, ‘এসো, এসো, বৃষ্টি এসো, আমাকে ধুয়ে দাও, ভিজিয়ে একেবারে শীতল মৃত্যুর কাছে নিয়ে যাও।’

মনে হলো যেন বৃষ্টি ওর নীরব কান্না শুনতে পেয়েছে। আরো জোরে তার ধারা ঢেলে দিতে লাগল। ওর সেই নরম ছোঁয়া মিলিয়ে গেছে। এখন বৃষ্টি ক্রমশ রাগী হয়ে উঠে ওকে মারতে লাগল। এটা খুব ভয়ের ছিল। ও যদি ভিজতে ভিজতে মরে যেতে না চায় তাহলে ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে হবে। এখন ও যতটা শক্তি ধরতে পারে সব জড়ো করে ছুটতে লাগল। ভয়ে শ্বাস টেনে নিতে লাগল, যেন এই একটি জায়গাতেই ওর জীবনটা আটকে আছে এভাবে যুদ্ধ করতে লাগল – লড়াই করতে লাগল নিজেকে বৃষ্টির ঠান্ডা ক্রোধ থেকে মুক্ত করতে। কিন্তু লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারল না ও। একজন ক্লান্ত নারীর পক্ষে বৃষ্টিটা খুব বেশিই জোরালো ছিল। তাই ও যখন উঁচুতে উঠছে, ঠিক করল হাঁটবে, বৃষ্টির কাছে নিজেকে ছেড়ে দেবে।

আর তখনি ও শুনতে পেল কোমল কিন্তু মরিয়া একটি মানুষের কান্না। ওর মেয়েলি প্রকৃতি বলল এটা একটা বাচ্চার কান্না। ও থেমে বাঁয়ে তাকালো। বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে তাই কান্নাটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ঢালের ঠিক নীচেই একটা ছোট্ট ঝোঁপালো জায়গা থেকে শব্দটা আসছে। ঠিক যখন ও গন্তব্যের এতো কাছে চলে এসেছে তখন আবার নীচে যাওয়া নিওক্যাবির জন্য খুবই যন্ত্রণার ছিল। এটা একটা পরীক্ষার মুহূর্ত। এসব মুহূর্ত খুব কমই আমাদেরকে দেওয়া হয় আমাদের মনুষ্যত্বের প্রমাণ দেয়ার জন্য। এসব মুহূর্ত দুর্লভ। এটা আসে, যদি না নেয়া হয় চিরকালের জন্য অনুতপ্ত করে রেখে চলে যায়।

বাস্তবিকই যখন শক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছে, যখন নাকের ঠিক নীচে গন্তব্যটি এসে গেছে তখন পুরোনো সেই ঈর্ষা ফিরে এলো, আরো তীক্ষ্মভাবে ওকে কামড়াতে লাগল। আরেকজনের বাচ্চাকে বাঁচানো! ও উঠতে লাগল, ওপরে… ওপরে… কিন্তু আবারো বৃষ্টি এল আরো জোরে, মেঘের রাগী গর্জন, একই সাথে বৃষ্টির প্রবল এবং ভয়ঙ্কর ক্রোধকে ছাপিয়ে দিয়ে। নিওক্যাবির হৃৎপিণ্ডটা প্রায় থেমে যাচ্ছিল। ও আর একটা পা-ও ফেলতে পারছে না। কারণ বুকের ভেতরে কান্নাটা বেজেই যাচ্ছে। ও ঘুরে দাঁড়ালো, তারপর নীচে ঢালের দিকে ছোট্ট ঝোঁপটার কাছে যেতে লাগল। যদিও ভীষণ ক্লান্ত আর বুঝতেও পারছিল না আবার ঢাল বেয়ে উঠে আসতে পারবে কি না। বাচ্চাটি দুই কী তিন বছরের, একটা ছোট্ট ছাউনি, যেটা কিছু আগে ওকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছে, সেটার নীচে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে ছিল।

নিওক্যাবি কিচ্ছু জিজ্ঞেস না করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। নীচে নেমে আসার সময় শরীর দিয়ে বাচ্চাটাকে রক্ষা করতে চাইছিল, যদিও আর একপা-ও ও তুলতে পারছিল না। উহ্, সেই উষ্ণতা! সেই মিষ্টি প্রাণদায়ী উষ্ণতা যা কিনা একটি জীবনধারা থেকে আরেকটির ভেতরে বয়ে যায়! নিওক্যাবির রক্ত গলে গলে যাচ্ছিল, শিরায় শিরায় নেচে উঠছিল। পিচ্ছিল ভয়ানক মাটির ওপর দিয়ে যতই উঠছিল ততই নতুন করে আশা আর বিশ্বাস জাগছিল ওর মনে। ও চিৎকার করে কাঁদছিল, ‘আমাকে ওকে বাঁচাতে দাও, আমাকে সময় দাও, ওহ্ মুরুঙ্গু, আমাকে ওকে বাঁচাতে দাও। এরপর যেন আমি মারা যাই।’ বৃষ্টি ওর প্রার্থনা শুনতে পেল বলে মনে হলো না, বা ওকে বাড়তি বোঝা বইবার জন্যেও দয়া করল না। একাই ওকে লড়াইটা করতে হলো। বিন্তু বাঁচার জন্যে নতুন বিশ্বাস ওকে শক্তি দিল, আর যখন ও একেবারে উঁচুতে চলে এসেছে তখনি পা পিছলে মাটিতে পড়ে গেল। দুর্দমনীয়ভাবে ও উঠে দাঁড়ালো, লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। যদি বাচ্চাটা ওর না হয় তাতে কী আসে যায়? বাচ্চাটা কী ওকে উষ্ণতা দেয় নি, যে-উষ্ণতা ওর শীতল মনে আলো জ্বেলে দিয়েছে। তাই ও যুদ্ধ করতে লাগল। বুকের কাছে বাঁচার জন্যে জাপটে ধরে থাকা বাচ্চাটাকে নিয়েই ও লড়ে গেল। আক্ষরিক অর্থেই পা টেনে টেনে ও ওপরে উঠল। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে।

পুরো ভেজা, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত নিওক্যাবি শান্তভাবে পা টেনে টেনে ঢালুটা পেরিয়ে ওর কুঁড়েঘরে পৌঁছালো। ওর রক্তে জয়ের উল্লাস। চোখে নতুন একটা আলো জ্বলছে যেন ঘনিয়ে আসা অন্ধকারকে চ্যালেঞ্জ করছে। এই জয় ওর খুব বাস্তব শারীরিক অবসন্নতাকে পরাভূত করেছে। ও ঘরে পৌঁছল, বিছানায় লুটিয়ে পড়ল।

ওর মানুষটা ভয়ে দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। নিওক্যাবি যেন ওকে দেখতেই পেল না। ও কেবল বাচ্চাটাকে দেখল, আর বাচ্চাটাকে শুকনো কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিল। ও স্ত্রীর জন্যেও কিছু শুকনো কাপড় নিয়ে এলো, উজ্জ্বল আগুনে আরও কাঠ ছুঁড়ে দিল, সারাক্ষণ ভাবছিল নিওক্যাবি কোথায় পেল বাচ্চাটাকে।

নিওক্যাবি একরকম ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, বিড়বিড় করে বলছিল, ‘বৃষ্টি… বৃষ্টি… নেমে এলো…’ তারপর কিছু অস্ফুট শব্দের ভেতরে নিজেকে হারিয়ে ফেলল।

খানিক পরে ওর স্বামী ভালো করে বাচ্চাটিকে দেখল। ইতোমধ্যে নিওক্যাবি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ও দেখতে পেল না ওর স্বামীর মুখে বিস্ময়ের আভাস। যখন ও বাচ্চাটিকে চিনতে পারল, যে-বাচ্চা আর কারো নয়, এনজেরির সবচেয়ে ছোট্ট বাচ্চা। প্রথমে ও বুঝতে পারছিল না, অবাক হচ্ছিল এই ভেবে যে, ওর ‘ঈর্ষাকাতর’ স্ত্রী কীভাবে এই বাচ্চাটাকে পেল।

তারপর ওর মনে পড়ল। এনজেরিকে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে দেখেছিল সারা ঢাল বেয়ে; বাচ্চা খোঁজার জন্য ছোটাছুটি করছিল। ও বলেছিল অন্য বাচ্চাদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে গিয়েছিল ওর বাচ্চা। নিওক্যাবির স্বামীর মনটা গর্বে অনেক ফুলে উঠল। ঘুমন্ত বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বাইরে এসে ও চিৎকার করে খবরটা দিল। ভাবা যায় ওর স্ত্রীই এই কাজটা করেছে!

Exit mobile version