Site icon তীরন্দাজ

মরমীকাব্য | লাল্লা দেদ : কাশ্মীরের আধ্যাত্মিক মাতৃহৃদয় | সৈয়দ তারিক | তীরন্দাজ অনুবাদ

চতুর্দশ শতাব্দীর কাশ্মীরে লাল্লা দেদ (১৩২০-১৩৯২) ছিলেন এক বিখ্যাত মরমিয়া সাধিকা, কবি ও যোগিনী। তিনি লাল্লেশ্বরী বা লাল্লা যোগেশ্বরী নামেও পরিচিত ছিলেন। নারীত্ব, ধর্ম ও আত্মসাধনার সংমিশ্রণে তিনি এক নতুন দর্শনের বীজ বপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক গুরু, যিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর দার্শনিক জ্ঞানকে সহজবোধ্য করে তুলেছিলেন। কেবল কাশ্মীরি সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে নয়, ভারতীয় সুফিবাদ ও ভক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষিতেও তিনি এক অনন্য আলোকশিখা।
লাল্লা দেদের সঠিক জন্ম ও মৃত্যু তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও, মনে করা হয় তিনি ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীনগরের কাছে পাম্পোরের সিম্পোর গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তাঁর নাম ছিল ললিতা। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় এক ধনী পরিবারে। শ্বশুরবাড়িতে তাঁর জীবন সুখের ছিল না। শাশুড়ি ও স্বামী তাঁকে অবর্ণনীয় কষ্ট দিতেন। দিনের পর দিন তিনি নিপীড়ন সহ্য করেছেন, এমনকি তাঁকে ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হতো না। এই সমস্ত কষ্ট তাঁকে জাগতিক বিষয় থেকে বিমুখ করে তুলেছিল এবং তিনি আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন।
দাম্পত্য জীবনের দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে লাল্লা সংসার ত্যাগ করেন এবং নিজেকে উৎসর্গ করেন আত্মজ্ঞান অর্জনে। তিনি কাশ্মীরি শৈব দর্শনের একজন প্রভাবশালী সাধক গুরু সিদ্ধ শ্রীকণ্ঠের (সিদ্ধ মৌল) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর কাছ থেকে ত্রিক দর্শন ও কৌল তন্ত্র শিক্ষা নেন।
এই সময় থেকেই তাঁর সাধনা শুরু হয়। তিনি সম্পূর্ণভাবে যোগ ও ধ্যানে মগ্ন হন।
তাঁর সাধনার মূল ভিত্তি ছিল যোগ ও আত্মানুসন্ধান; যেখানে শরীর ও মনের সীমানা পেরিয়ে চেতনাকে অনন্ত ব্রহ্মাত্মার সাথে যুক্ত করার প্রয়াস ছিল স্পষ্ট। তিনি জনসাধারণের মধ্যে নগ্ন বা অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতেন এবং উচ্চ আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রচার করতেন। এটা তৎকালীন সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির পরিপন্থী ছিল। এ কারণে তিনি বিভিন্ন সময়ে সমালোচিতও হয়েছেন। কিন্তু তাতে তাঁর সাধনায় কোনো প্রভাব পড়েনি।
লাল্লা দেদের সময়কাল ছিল কাশ্মীরের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। সে সময় একদিকে যেমন হিন্দু শাক্ত ও শৈব ধর্মের গভীর প্রভাব ছিল, তেমনি ধীরে ধীরে ইসলামের প্রসার ঘটছিল। লাল্লা দেদ এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন, তাঁর কবিতায় হিন্দু দর্শন ও সুফিবাদের এক অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়।
লাল্লা দেদের মূল ভাবনা ছিল অদ্বৈত বেদান্ত এবং কাশ্মীরি শৈবদর্শন দ্বারা প্রভাবিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর বাইরে কোথাও নন, বরং প্রতিটি মানুষের অন্তরেই বিরাজমান। আত্ম-উপলব্ধিই হলো পরম সত্য।

আত্মানুসন্ধান : তিনি মানুষকে ভেতরের দিকে তাকাতে উৎসাহিত করতেন। নিজের আত্মাকে জানা এবং এর সাথে পরমাত্মার মিলন ঘটানোই ছিল তাঁর সাধনার লক্ষ্য। তাঁর দেশনায়, আত্মাই ব্রহ্ম, নিজেকে জানলেই ঈশ্বরকে জানা যায়।

ভেদাভেদহীনতা : লাল্লা দেদ জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাকে গুরুত্ব দিতেন। তাঁর কাছে সবাই সমান ছিল এবং তিনি বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে আত্মিক বিশুদ্ধতা ও নৈতিকতাকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। তিনি হিন্দু, শৈব, বৌদ্ধ কিংবা ইসলাম – কোনো কাঠামোর মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখেননি। তাঁর ভাবনায় ঈশ্বর নিরাকার ও নির্ধর্মীয়।
নারীত্ব ও আধ্যাত্মিকতা : একজন নারী হিসেবে লাল্লা নিজের শরীরকে অপবিত্র নয়, বরং সাধনার ক্ষেত্র বলে মনে করতেন। নারীর আধ্যাত্মিক অধিকার ও যোগ্যতার তিনি একটি উজ্জ্বল আইকন।
মোহমুক্তি : তিনি পার্থিব ভোগ-বিলাস ও জাগতিক আকাঙ্ক্ষা ত্যাগের কথা বলতেন। তাঁর মতে, মানুষের দুঃখের কারণ হলো মায়া ও মোহ। এই মোহ থেকে মুক্তি পেলেই পরম শান্তি লাভ করা যায়।


অহংকার ত্যাগ : লাল্লা দেদ অহংকারকে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে প্রধান বাধা মনে করতেন। বিনয় ও আত্মনিবেদনই মুক্তির পথ।
নিরাকারে ভক্তি : তিনি মূর্তিপূজা নয়, হৃদয়ের নৈঃশব্দ্য ও আত্মদর্শনের মাধ্যমে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে বলতেন। তার সাধনা ও শিক্ষা ছিল একান্তই ব্যক্তিগত এবং ভেতরের। তিনি কোনো মঠ বা মন্দিরের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না। নিজের শরীরকেই তিনি মন্দির মনে করতেন এবং আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপন করতেন ও করতে বলতেন।
গুরুত্বপূর্ণ সাধন পথ : তিনি বিশ্বাস করতেন যে যোগ এবং ধ্যান হলো আত্ম-উপলব্ধির প্রধান পথ। কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরণের মাধ্যমে মানুষ পরম জ্ঞান লাভ করতে পারে।

লাল্লা দেদের কবিতা ‘বাখ’ বা ‘ভাক্ষ’ নামে পরিচিত, যার অর্থ ‘বাণী’ বা ‘বচন’। এগুলি মূলত চার লাইনের ছোট ছোট শ্লোক, যা কাশ্মীরি ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শনগুলোর অন্যতম। তাঁর বাখগুলো ছিল গভীর দার্শনিক জ্ঞান, আত্মিক উপলব্ধি এবং ব্যবহারিক প্রজ্ঞায় ভরপুর। তিনি তাঁর কবিতায় সাধারণ এবং লোকালয় থেকে উঠে আসা উপমা ব্যবহার করতেন, যাতে সাধারণ মানুষ তাঁর বাণী সহজে বুঝতে পারে।

“শিব বিরাজ করে প্রতিটি হৃদয়ে,
কেন ভাবো হিন্দু বা মুসলমান?
ওসব পরিত্যাগ কর, চিনে নাও নিজেকে;
যে জানে নিজেকে, সে জানে প্রভুকে।”

এই বাখটি তাঁর সর্বধর্মসমন্বয়ের মর্মবাণী। ঈশ্বরের অবস্থান হিন্দু বা মুসলমানের সাম্প্রদায়িক ভাবনা-বিশ্বাসের মাঝে নয়, ঈশ্বর অবস্থান করেন মানবের অন্তরজগতে।
“অমৃত রস ভেতরেই আছে, আমাকে জানতে হবে আমার ভেতরের সারবস্তু।” এটি তার আর একটি বাখের বাণী।
লাল্লার কবিতা কাশ্মীরি ভাষায় রচিত। এর ভাষাশৈলী সহজ-সরল, কিন্তু এর ভাবার্থ গভীর।
আজও এইসব বাখ জনগণের মুখে মুখে ফেরে : মাজারে, সুফি আসরে কিংবা লোকজ অনুষ্ঠানে।

লাল্লা দেদ কাশ্মীরি সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক জীবনে এক গভীর প্রভাব রেখে গেছেন। তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই শ্রদ্ধেয়। মুসলিমরা তাঁকে “লাল্লা আরিফা” বা “লাল্লী মাজি” নামে ডাকে, যা তাঁর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে।
লাল্লার বাখ ও সাধনার ধরন শেখ নুরউদ্দিন নুরানি তথা নুনদ ঋষি (Nund Rishi)-এর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। নুনদ ঋষি (আনু. ১৩৭৭–আনু. ১৪৩৮ খ্রি.) ছিলেন কাশ্মীরের একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক, মরমি কবি এবং ইসলাম প্রচারক। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাঁকে ‘নুনদ লাল’ বা ‘সহজানন্দ’ নামেও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
লাল্লা দেদকে নুনদ ঋষি আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবে মানতেন। তিনি লাল্লার শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে এক ধরনের “কাশ্মীরি সুফিবাদ” বা “ঋষি আন্দোলন” গড়ে তোলেন। এই যুগল ধারায় লাল্লার ভাবনা হয়ে ওঠে ধর্মীয় সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ব ও অন্তর্জ্ঞানের প্রতীক।
লাল্লার জীবন, সাধনা ও ভাক্ষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মৌখিক ঐতিহ্য হিসেবে প্রবাহিত হয়েছে। কাশ্মীরি লোকসংগীত, সুফি চর্চা, এবং ভক্তি আন্দোলনে তাঁর ভাবনার ছায়া রয়েছে। তিনি আজও কাশ্মীরি সংস্কৃতির ‘মা’, ‘যোগিনী’, এবং ‘আত্মজ্ঞান দেবী’ রূপে পূজিত। তাঁর নামে ছাপানো হয়েছে বহু গ্রন্থ, ইংরেজি অনুবাদও রয়েছে (যেমন Ranjit Hoskote-এর I, Lalla: The Poems of Lal Ded)।
লাল্লা দেদ কেবল একজন যোগিনী বা কবি নন, তিনি এক জীবন্ত দর্শন। তাঁর জীবন এক নারীসত্তার আত্মউন্মোচনের, বেদনা থেকে বোধির, এবং দৈনন্দিন ধর্মীয় বিভাজন ভেঙে সার্বজনীন প্রেম ও জ্ঞানের দিকে যাত্রার নামান্তর। তিনি আমাদের শেখান—“নিজেকে জানো, ঈশ্বরকে জানো”—এ এক অনন্ত মন্ত্র, যা যুগে যুগে আমাদের আত্মার দুয়ার খুলে দেয়।
তাঁর বাখগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাশ্মীরি মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। এগুলি শুধু ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, বরং লোককথার অংশ, যা কাশ্মীরি সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করেছে। তাঁর দর্শন আধুনিক যুগেও প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি ব্যক্তিগত মুক্তি, সামাজিক সম্প্রীতি এবং আধ্যাত্মিক চেতনার উপর জোর দেয়।
লাল্লা দেদ ছিলেন এক অসাধারণ নারী, যিনি তাঁর জীবন, সাধনা এবং কবিতার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন। তিনি দেখিয়ে গেছেন যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য কোনো বাহ্যিক আড়ম্বর বা সামাজিক প্রথার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন কেবল ভেতরের সততা, আত্মত্যাগ এবং ভালোবাসার। তাঁর বাণী আজও কাশ্মীর এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মানুষকে আলোকিত করে চলেছে।

১.

আমি ছিলাম কিছুই না।
যখন আমার চেতনা বিশুদ্ধ হলো,
আয়নার মতো ময়লা-ও ধুলো-মুক্ত,
তখন আমি আমার ভিতরে ‘স্ব’-কে চিনলাম।
তখন দেখলাম, তিনিই আমার মাঝে বিরাজ করছেন—

তখনই বুঝলাম, তিনি-ই সবকিছু,
আর আমি কিছুই না।

২.

উপাসনা কী?
এই মানুষ আর নারী যারা ফুল নিয়ে আসে—
তারা কে?

কী রকম ফুল আনা উচিত?
কোন নদীর জল ঢালা উচিত মূর্তির উপর?

আসল উপাসনা হয় মনে—
সেই মন হোক পুরুষ,
আর বাসনা হোক নারী।
তারা নিজেরাই নির্ধারণ করুক কী উৎসর্গ করবে।

মুখের আড়ালের নিচে এক তরল আছে—
একটি অমৃতধারা,
যা নিচে নেমে এলে
আনে শৃঙ্খলা ও শক্তি।

তাই হোক তোমার পবিত্র সিঞ্চন।

৩.

এক টুকরো ঢিলা সুতো দিয়ে
আমি টানছি আমার নৌকা বিশাল সমুদ্রে।
ঈশ্বর যদি আমার প্রার্থনা শুনতেন,
আর নিরাপদে পৌঁছে দিতেন ওপারে!
কাঁচা মাটির পাত্রে রাখা পানির মতো
আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।
ঈশ্বর যদি আমার ঘরে ফেরার পথ দেখাতেন।

৪.

চিরকাল আসি, চিরকাল যাই,
দিনরাত অবিরত চলি আমরা।
যেখান থেকে এসেছি, সেদিকেই যাই—
জন্ম আর মৃত্যুর চক্রে চিরন্তন পথ চলা।
শূন্যতা থেকে শূন্যতায়।

তবু এই ঘূর্ণনে রয়ে গেছে এক রহস্য—
এক ‘কিছু’ আছে, জানার মতো।
সবকিছু নিশ্চয়ই অর্থহীন হতে পারে না।

৫.

ভাবো তোমার ভিতরে,
যতক্ষণ না দিনের আলো হয়ে যায় গভীর রাতের মতো;
যতক্ষণ না আত্মদীপ্ত পথ
তোমাকে দেখায় অন্ধকারই আসলে আলো।

তখন কঠিন পৃথিবীর সীমা
মিশে যাবে আকাশের তরলতায়।
তখন তুমি পুনর্জন্ম থেকে হবে মুক্ত,
নিজেকে শিবের সঙ্গে এক করে দেবে।

যখন মলিন চাঁদের অমৃত
উঠে আসে প্রতীক্ষারত সূর্যকে খাওয়াতে,
তা আর কিছুই নয়— এক ফাঁকা দান,
রাহু যাকে গিলে ফেলে।

তবু আত্ম-আলোকিত চিন্তা
তোমাকে এক নতুন দৃশ্য দেখাবে—
অজ্ঞতা— এক অন্ধ দৈত্যের মতো ধরা পড়ে যাবে,
রাহু নিজেই হবে চাঁদের আহার।

জানার কিছু আছে, জানাবারও কিছু আছে—
তাদের জানবার জ্ঞানও আছে।
তোমার ভিতরের আলোই তাদের প্রকাশ করবে—
ভাবতে থাকো, যদি তুমি চাও।

রাহু যা একদিন চাঁদকে গিলেছিল,
এখন সেই চাঁদই হবে তোমার আহার।
ভাবতে থাকো, সবকিছু মিলিয়ে এক ফাঁকা হয়ে যাবে—
অবশিষ্ট থাকবে শুধু ঐশ্বরিক চিন্তা।

৬.

আমি দেখলাম, একটি ধারা বইছে।
তাতে না ছিল তীর, না ছিল সেতু।
আমি দেখলাম, একটি গুল্মে ফুল ফুটেছে।
তাতে ছিল না কাঁটা, না ছিল গোলাপ।

৭.

কেন তুমি ভালোবাসো, হে আত্মা,
তাকে— যে তোমার প্রকৃত প্রেমিক নয়?
কেন তুমি ভুলকে সত্য মনে করছো?
কেন তুমি বুঝতে পারো না, জানতে পারো না?
এটা অজ্ঞতা, যা তোমাকে বেঁধে রেখেছে ভুলের সাথে—
এই চক্রাকার জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে—
এই আসা আর যাওয়া।

৮.

আমি হয়তো দক্ষিণের মেঘ ছড়িয়ে দিতে পারি,
আমি হয়তো সমুদ্র শুষে ফেলতে পারি,
আমি হয়তো আরোগ্যহীন রোগীকে সুস্থ করে তুলতে পারি—
কিন্তু আমি পারি না এক মূর্খকে বোঝাতে।

১.

আমার গুরুর উপদেশ ছিল একটাই—
চোখ ফিরিয়ে আনো বাইরের জগৎ থেকে,
স্থাপন করো দৃষ্টিকে আত্মার ভিতরে।
পুড়িয়ে ফেলো এই শরীরের দালান,
তবেই মিলবে সত্য-সাধনার পথ।

২.

শিব বিরাজ করেন সকলের মাঝে—
তবে হিন্দু-মুসলমান আবার কী?
নিজেকে চেনো, জানো — সেটাই সত্য,
ওতেই মিলবে সকল ঈশ্বরের ঠিকানা।

৩.

আমি খুঁজেছি বহির্জগতে তোমায়,
কিন্তু তোমার মতো কাউকেই পাইনি।
যখন ফিরিয়ে আনলাম চোখ নিজের ভিতরে—
তুমি তো ছিলে সেখানেই,
আমার নিঃশ্বাসের থেকেও কাছে।

৪.

ক্ষয় করেছি শরীর, সাধনার আগুনে পুড়িয়ে,
জ্ঞান-প্রভাতে স্নান করেছি প্রত্যুষে।
মৃত হয়েছি সংসার থেকে, বেঁচেছি সত্যে,
পেয়েছি গুরুকে, আর তাঁর হাত ধরেই ঈশ্বরকে।

৫.

আমি পেরিয়ে এসেছি সংসারের দুয়ার,
খসে পড়েছে মায়ার চাদর।
মুখোমুখি হয়েছি নিজের আত্মার,
আর সেখানেই পেয়েছি ঈশ্বরকে।

৬.

আত্মা প্রস্ফুটিত পদ্মের মতন নিঃশব্দে,
মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি থেকে দূরে।
যে খোঁজে নীরবতায়,

সে-ই খুঁজে পায় ঈশ্বরকে নিজের ভিতরে।

৭.

গর্বে ফুলে উঠেছিল মন, ঘুরেছি দিনরাত,
ধর্মগ্রন্থ আর আচার-অনুষ্ঠানে খুঁজেছি আত্মাকে।
কিন্তু যখন ফেলে দিয়েছি “আমি” আর “আমার”-এর বোঝা,
তখন নিজের ভিতরে পেয়েছি তাঁকে—
হাজার সূর্যের চেয়ে দীপ্তিময়।

৮.

তারা বলেছে, আমি অপবিত্র, নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ানো নারী,
কিন্তু এই দেহের মধ্যেই আমি দেখেছি ঈশ্বরকে।
তিনি আমাকে একাত্মতার অমৃত পান করিয়েছেন,
আর আমার লজ্জাকে ভস্ম করেছেন প্রেমে।

৯.

তপস্যায় ক্ষয় করেছি এই শরীর,

দেখেছি জগৎ—সবই মিথ্যা।
গ্রন্থে-গ্রন্থে খুঁজেছি সত্যকে—কিন্তু কোথাও পাইনি।
অবশেষে বুঝেছি, মন্দির রয়েছে এই দেহের ভিতরেই।

১০.

আত্মা ছিল বিভ্রান্ত, কামনার পেছনে ছুটেছে,
ধরে রাখতে চেয়েছে যা আসে আবার চলে যায়।
এখন সে ফিরে তাকিয়েছে ভিতরের দিকে—
দেখেছে আপন হৃদয়ের কূপে জ্যোৎস্নার দীপ্তি।

১১.

ঘোর অন্ধকারে আমি ছিলাম অন্ধ,
ভাবতাম, আমি পথ জানি।
কিন্তু যখন ভিতর থেকে উঠল আলোর ঢেউ,
তখনই প্রথম দেখলাম সেই পথ, যা এতদিন পাইনি খুঁজে।

১২.

এই দেহ একটি কলস,
আত্মা তার ভিতরে রাখা অমৃত।
ভেঙে ফেল মোহের এই পাত্র,
পান কর অনন্ত জীবনের সরাব।

১৩.

যখন দেখলাম সত্যরূপে,
দেখলাম নাই কোনো ‘তুমি’ কিংবা ‘আমি’—
সবই এক,
অনন্ত ও অসীম
আকাশের মতো বিরাট।

১৪.

গুরুর শরণ না পেলে,
কী করে চিনতাম আমি নিজেকে?
তিনি অন্ধকারে জ্বালিয়েছেন আলোর প্রদীপ,
আর আমি দেখেছি—ঈশ্বর বাস করেন এই ভিতরেই।

১৫

গর্বভরে আমি ঘুরেছি জগৎময়,
উঁচু গলায় ফলিয়েছি জ্ঞান,
নীরবে নিঃশব্দে সত্য আমাকে বলল,
“আমি আছি তোমার ভিতরেই।”

১৬.

প্রতিটি পর্দার আড়ালে তিনি লুকিয়ে আছেন,
তবুও তিনি দ্যুতিমান সব কিছুতেই।
তিনি পর্বতমালার নীরবতা,
আর প্রেমিকের হৃদয়ের স্পন্দন।

শেষ কথা

লাল্লা দেদের এই বাখগুলো কেবল কবিতা নয়, এগুলো সাধনায় প্রস্ফুটিত একেকটি পুষ্প, দর্শনের দীপ্ত প্রকাশ। প্রতিটি স্তবকে রয়েছে এক তীব্র আত্মজিজ্ঞাসা, এক অনন্ত আকুলতা ঈশ্বর ও সত্যের খোঁজে। তাঁর কাব্য নারীত্বকে শক্তি, শরীরকে তীর্থ, আর আত্মাকে স্বয়ং ঈশ্বরের আবাস হিসেবে তুলে ধরে। বাংলা মরমিয়া ঐতিহ্যের সঙ্গে তুলনা করলে তাঁর কবিতাগুলোর আত্মস্বরূপ মিলে যায় বাউলগান, লালনসঙ্গীত, রাধা-কৃষ্ণের পদাবলি, ভক্তি কবিতা এবং সুফি পদাবলির সঙ্গেও।

Exit mobile version