তীরন্দাজ

নারীর স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ | ভোলা কি যায়? | মেহের কবীর | স্মৃতিগদ্য

কবীর (চৌধুরী) রোজ সকালে তার দপ্তর বাংলা একাডেমিতে যায়। সারাক্ষণ তার জন্য ভয়ে ভয়ে থাকি। ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে তারই নেতৃত্বে বাংলা একাডেমিতে মহাসমারোহে এক সপ্তাহব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানমালা উদযাপিত হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু তার উদ্বোধন করেছিলেন ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে। কবীরের ওপর পাক সামরিক কর্মকর্তাদের রাগ তো থাকবেই। বাংলা একাডেমি থেকে ওর পি.এ. আফতাবউদ্দিন সাহেব দুপুরের দিকে আমাকে ফোনে জানিয়ে দেন, স্যার আপিসে আছেন, সব ঠিকমতো চলছে। আবার দু’টার দিকে ফোন করেন, স্যার বাসায় রওনা হলেন। আমাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য এটা তার নিত্যকর্ম ছিল।

এর মধ্যে একদিন খবর পেলাম একাডেমি থেকে সংস্কৃতি বিভাগের কর্মকর্তা সরদার ফজলুল করিমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ নিয়ে গেছে। আরেক দিন নিয়ে গেল অনুবাদ বিভাগের কর্মকর্তা আবু জাফর শামসুদ্দিনকে।

গুলশানে আমরা প্রায় গৃহবন্দি। আমি তবু মাঝে মাঝে বাইরের বারান্দায় আসি, বাগানে ছোটখাটো কাজ করি; কিন্তু মেয়ে দুটি, বেণু ও টিস্কুকে, একদম ঘরে থাকতে হয়। মেয়েদের ওপর অকথ্য লাঞ্ছনা-নির্যাতনের নানা খবর আমরা ইতোমধ্যে পেয়ে গিয়েছিলাম। এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যাওয়া ছাড়া জানালা দিয়ে দেখা যেতে পারে এমন জায়গায় যাওয়াও বেণু টিঙ্কুর জন্য একদম বারণ। জোরে জোরে রেডিও শুনতে পারবে না, গলা খুলে গল্প ও হাসি তো নয়ই।

এর মধ্যেই শুনতে পেলাম বাড়ি বাড়ি তল্লাশি হচ্ছে, গুলশানেও হবে। তখন রমজান মাস চলছে, এক বিকেলে তিনজন পাকসেনা আমাদের বাসায় এসে হাজির হলো, আমাদের সঙ্গে তারা কথাবার্তা বলবে। আমার ছোট মেয়ে তখন আসরের নামাজের জন্য জায়নামাজে দাঁড়ানো। মেজো মেয়ে বেণু বাথরুমে। কাজের ছেলেটি রান্নাঘরে ইফতারি তৈরি করছে। ছেলেটি সুদর্শন, স্মার্ট, বয়স চব্বিশ-পঁচিশ বছর, দেখলে ছাত্র বলে মনে হয়। একজন সৈনিকের বোধ হয় কিছু সন্দেহ হয়। সে রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ওকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করে। বোধ হয় দেখতে চায় ও সত্যিই রান্নাবান্না জানে কি না। আরেকজন সৈনিক বাইরে বাড়ির চারপাশে ঘোরাফিরা করতে থাকে। অফিসারটি আমার সঙ্গে নানা কথাবার্তা বলে চলে, এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলো বাসায় কোনো অস্ত্র আছে কি না। আমি জানালাম যে আছে, আমার স্বামীর একটা লাইসেন্সকৃত পিস্তল আছে, শোবার ঘরের আলমারিতে। তাকে নিয়ে শোবার ঘরে যাই, জিজ্ঞেস করি পিস্তল বের করে তাকে দেখাবো কি না। অফিসারটি বললো, না, তার দরকার হবে না, এমনি জিজ্ঞেস করেছি। অল্পক্ষণ পরে অর্থহীন কিছু গল্প করে সে তার সৈনিকদের নিয়ে চলে যায়।

ঢাকার অবস্থা ক্রমশ চঞ্চল হতে থাকে। প্রায়ই শুনি আজ শহরের গুলিস্তানে কিংবা অন্য কোনো জায়গায় বোমা ফাটানো হয়েছে। আমাদের ছেলেরা, বিচ্ছুরা, কোথাও বৈদ্যুতিক খাম উড়িয়ে দিয়েছে, অতর্কিতে তিনজন পাক দখলদার সৈন্যকে হত্যা করেছে, এমনি নানা খবর। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আমাদের গেরিলা যোদ্ধাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে ভারতে পালিয়ে গিয়ে সেখানে সামরিক শিক্ষাগ্রহণ করছে, তারপর চোরাপথে দেশে ফিরে এসে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে।

১৯৭১-এর পঁচিশে মার্চ রাতে ও তারপর পাক সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে যে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সে সম্পর্কে প্রথম দিকেই “ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন দি ইউনিভার্সিটি ইমার্জেন্সি” নামক একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্থা ‘৭১-এর ২২ এপ্রিল তারিখে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়, “বিশ্ববিদ্যালয় যে অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল তা সুস্পষ্ট। হতভাগ্যদের একটি বিশেষ তালিকা প্রণয়ন করে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে বলে মনে হয়। স্পষ্টত উক্ত তালিকায় বিশিষ্ট শিক্ষক এবং ছাত্রদের নাম-ঠিকানা ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ এবং লেখকদের নাম ও ঠিকানা রয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যায় পরিকল্পনা অনুযায়ীই গণহত্যা পরিচালিত হয়েছে। সিনিয়র প্রফেসরদের খোলা জায়গায় টেনে এনে গুলি করা হয়। নারী ও শিশুসহ তাদের পরিবারের লোকদেরও হত্যা করা হয়। স্পষ্টতই মনে হয় এই আকস্মিক আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে, বিশেষ করে বাঙালি সংস্কৃতির অগ্রনায়ক ও অনুসারীদের এক বিরাট অংশকে, ধ্বংস করা।”

এই হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র চালানো হয়। বিশেষ আক্রোশের শিকার হয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ, ছাত্র ও নারী, আর বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই প্রথম আক্রমণের পর নিরাপদ স্থানে সরে গিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বহির্বিশ্বে পাকসেনাদের পাশবিক কার্যকলাপের কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা উচ্চারিত হয় তাদের বিরুদ্ধে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকসেনারা প্রকাশ্যে হত্যা অভিযান বন্ধ করে কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের বাঙালি নিধন ও নির্মূল প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে।

আগস্ট মাসে জেনারেল ইয়াহিয়া সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা প্রচার করে। এতে একদিকে বাইরের জগৎকে ধোঁকা দেয়া হয়, অন্যদিকে যেসব বাঙালি সরকারি কর্মচারী ভারতে পালিয়ে না গিয়ে দেশের মধ্যে গ্রামেগঞ্জে আত্মগোপন করেছিলেন তাদের ফিরে এসে কাজে যোগ দিতে প্ররোচিত করা হয়। অনেকে জীবন ও জীবিকার তাগিদে কাজে পুনরায় যোগদানও করেন; কিন্তু ইয়াহিয়ার ওই ঘোষণা ছিল সম্পূর্ণ ভাঁওতা। পাকিস্তানি শাসকদের তৈরি করা তালিকা অনুসারে শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী প্রভৃতি পেশার প্রগতিশীল ব্যক্তিদের রাতের আঁধারে এবং দিনের বেলায়ও বিভিন্ন কৌশলে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যার কাজ চলছিল। সবার জীবন দুর্বহ হয়ে পড়েছিল।

ইতোমধ্যে একদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেমন গেরিলা যুদ্ধ দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছিল, অন্যদিকে বাইরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঙালি সামরিক বাহিনীও চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য নিজেদের তৈরি করে নিচ্ছিল। ৩ ডিসেম্বর শুক্রবার পাকিস্তান হঠাৎ করেই ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, আম্বালা, আগ্রা প্রভৃতি জায়গায় বিমান আক্রমণ চালায়। সেই রাতেই ভারতও পাকিস্তানে পাল্টা বিমান হামলা করে। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। যার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড গঠিত হলো। ভারত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলো।

৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানালেন। সে এক চরম উত্তেজনাময় সময়। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো ৬ ডিসেম্বর, তার আগে ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়। ভুটানই প্রথম রাষ্ট্র যে স্বাধীন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছিল।

এদিকে গুলশানে বাস করা দিন দিনই বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। অনেকে বলছে মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলের পথে থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসবে, পাকসেনারা ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে তাদের বিরুদ্ধে গুলি ছুঁড়বে, কামান দাগবে, আর আমরা দু’পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যাবো। আমরা ৫ ডিসেম্বর গুলশানের বাসা ছেড়ে আমার বড় ভাই ওয়াপদার চেয়ারম্যান বি.এম. আব্বাসের বাসায় বেইলি রোডস্থিত ওয়াপদা হাউসে চলে এলাম। মুনীর ও অন্য ভাইবোনেরা ধানমন্ডি সেন্ট্রাল রোডে আমার শ্বশুরবাড়ি ‘দারুল আফিয়া’য় গিয়ে আশ্রয় নিলো।

গুলশান থেকে বেইলি রোডে যাওয়ার পথে আমরা মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ পেতে থাকলাম। এয়ারপোর্টের কাছে সাইরেন শুনে গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিতে হয়। অনেক রাস্তার পাশে তখন ট্রেঞ্চ খোঁড়া ছিল। সাইরেনে অল ক্লিয়ার ঘোষণার পর আবার আমরা চলতে শুরু করি ও আব্বাস ভাইয়ের বাসায় গিয়ে পৌঁছাই। আমাদের গুলশানের বাড়িতে থাকলো একটি দারোয়ান।

৭ ডিসেম্বর আমাদের পরিচিত একজন অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি ক্যাপ্টেন, মি. হোসেন, খবর দিলেন যে আমাদের গুলশানের বাড়িটা বোধ হয় সরকারের কোনো প্রয়োজনে লাগবে, কয়েকজন সামরিক লোক আমাদের বাড়িটা ঘুরে দেখে গেছে, ছাদেও গিয়েছিল। আমরা বুঝলাম তিনি ইঙ্গিতে জানিয়ে দিচ্ছেন যে আমরা ঠিক সময়ে বাড়ি ছেড়েছি।

১২ ডিসেম্বর পাকসেনারা দু’বার আমাদের গুলশানের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। তাদের সঙ্গে দু’তিনজন বাঙালি দালালও ছিল। ওরা দারোয়ানকে অত্যাচারও করে, আমরা কোথায় সরে গিয়েছি জানতে চায়। বেচারি দারোয়ান জানতো যে আমরা ওয়াপদা কলোনিতে গেছি। আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করার সময় ওয়াপদা কথাটা তার কানে গিয়েছিল। সে বুঝতে পারে নি যে আমরা ওয়াপদা কলোনি নয়, ওয়াপদা হাউসে গিয়েছিলাম। ওয়াপদা হাউস ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের কাছে, আর ওই এলাকাকে তখন ইন্টারন্যাশনাল সেফটি জোন বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আমাদের ওয়াপদা হাউসে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার সেটাও ছিল একটা কারণ। আমরা শুনলাম যে পাক হত্যাকারীরা ওয়াপদা কলোনিতে গিয়ে সেখানেও কবীরকে হন্যে হয়ে খুঁজেছিল।

এসব কথা শুনে আমরা অস্থির হয়ে পড়লাম। কোথায় কবীরকে রাখা যায়? কোথায় সে নিরাপদ থাকবে? অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সবাই বললো এখন যেখানে আছে তার চাইতে নিরাপদ অন্য কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না।

এদিকে বহু শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে ফোন আসছে। মুনীর সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে প্রায়ই ফোন করে, নানা খবরাখবর দেয়, উৎসাহ প্রকাশ করে, বলে যে স্বাধীনতা আসতে বোধহয় আর দেরি নেই।

আমরা ওয়াপদা হাউসের কম্পাউন্ডে ট্রেঞ্চ কেটে তার মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে দিই। বিরাট কম্পাউন্ড, গোটা চারেক ট্রেঞ্চ সুন্দর করে খোঁড়া হয়েছিল। শোনা যাচ্ছিল যে প্রবল বোমাবর্ষণ হতে পারে। পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য ভারতীয় যুদ্ধ-বিমান থেকে বোমা ফেলা হবে। আমরা ট্রেঞ্চে ঢুকে দু’বার রিহার্সালও দিয়ে নিলাম। বালিশ, চাদর, টর্চলাইট, বিস্কুট, পানির বোতল ইত্যাদি সব ঠিক রাখা হলো; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রেঞ্চে প্রবেশ করার দরকার হয় নি।

বেতারে বারবার আহ্বান শুনছি, ভারতের জেনারেল মানেক শ পাকিস্তানের নিয়াজি ও টিক্কা খানকে অনর্থক রক্তক্ষয় না করে আত্মসমর্পণ করতে বলছেন। আমরা সকলেই চঞ্চল, উৎকণ্ঠিত, আশান্বিত। ১৩ ডিসেম্বর রাতে মুনীর আবার ফোনে কবীরের সঙ্গে কথা বলল।

কিন্তু এর মধ্যেই যে মার্চের মতো ডিসেম্বরের হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছিল তা আমরা জানতে পারি নি। ঢাকাসহ দেশের বহু জায়গায় সুপরিকল্পিতভাবে এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। শিক্ষাবিদ, জ্ঞানীগুণীজন, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, রাজনৈতিক নেতা, পদস্থ সরকারি কর্মচারী কেউ বাদ পড়ে নি তাদের ওই নিধনযজ্ঞ থেকে। সকল দিক থেকে বাংলাদেশের মস্তিষ্ককে চূর্ণ করাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য।

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী সেনারা বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে ঢাকায় প্রবেশ করে, আমরা আনন্দে আত্মহারা, আর তখনই বিকেলের দিকে খবর এলো যে ১৪ তারিখে একটা কাদামাখা বাসে করে ছাত্রনামধারী কিছু ব্যক্তি মুনীরকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে সেন্ট্রাল রোডের বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে। দুপুর দেড়টার দিকে মুনীর গোসল শেষ করেছে, আম্মা টেবিলে তার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এমন সময় দরজায় ধাক্কা শুনে আমার দেবর রুশো দরজা খুলে দেখলো কয়েকজন যুবক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা বললো যে ওরা ছাত্র, স্যারকে একটু নিয়ে যেতে চায়, অল্প পরেই ফেরত দিয়ে যাবে। এই সময় মুনীরও গেঞ্জি গায়ে দিয়ে কাছে আসে। ওরা মুনীরকেও সেই একই কথা বললো। মুনীর বললো, ঠিক আছে, আমি শার্ট গায়ে দিয়ে আসি। ওরা বললো, কোনো দরকার নেই, স্যার, এক্ষুণি তো চলে আসবেন। এই বলে ওরা তার হাত ধরে টেনে বাসে তুলে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে বাস ছেড়ে দিলো।

এরপর মুনীর আর ফিরে আসে নি। ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর আমরা এ ধরনের বহু খবর পেতে থাকলাম। নিখোঁজ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনরা প্রকৃত তথ্যের জন্য বহু জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। এক পর্যায়ে শোনা গেল, অনেক বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ রায়ের বাজারে এক ইটখোলার পাশে কাদা-পানি ভর্তি ডোবার মধ্যে পড়ে আছে। সবাই ওই বধ্যভূমিতে গিয়ে ভিড় করলো। অনেকের মৃতদেহ পাওয়া গেল। হাত পেছন দিকে বাঁধা, দেহের বিভিন্ন অংশে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্ন। তাদের দেহ

উদ্ধার করে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মুনীরের মৃতদেহ পাওয়া যায় নি। ‘কবর’ নাটকের রচয়িতার কবর হলো না। স্বজন বিয়োগের বেদনায় স্বাধীনতা লাভের আনন্দ স্নান হয়ে গেল।

মুনীরের সঙ্গে পরিচয় আমার কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার প্রায় পরপরই, ১৯৪৩ সালে। আমি যখন ঢাকায় গবেষণা করতে এলাম, ও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ছে। সব দিক দিয়ে তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণচঞ্চল তরুণটিকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাহিত্য ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ছিল ওর জোরালো উপস্থিতি। কোনোটিতে প্রথম ও কোনোটিতে দ্বিতীয় পুরস্কার মুনীর জয় করে নেবেই। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য ও এক হল থেকে আরেক হলে তার সাইকেল নিয়ে ছুটছে। এরকম একটা পটভূমিকায় ওর সঙ্গে আমার আলাপ। আমি তখন মেয়েদের হলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট, আমার জি. এস. তথা জেনারেল সেক্রেটারি হলো করুণাকণা গুপ্ত, ডাকনাম বাবুল। চমৎকার গান গাইতো। মুনীরের সহপাঠী। পরিচয় ঘনিষ্ঠ হতে দেরি হলো না। মুনীরের সহপাঠীরা অনেকেই, বিশেষ করে বাসনা বলে একটি মেয়ে, আমারও বিশেষ স্নেহভাজন ছিল। চমৎকার একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। কবীরের সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যাপারে মুনীর ছিল বিশেষ আগ্রহী। এ সম্পর্কে ও আমাকে একটা চমৎকার চিঠি লিখেছিল।

মুনীরকে হারানোর ব্যথা সহজেই অনুমেয়। কবীরের সঙ্গে আমার বিয়ের পর আমরা যতো বই কিনেছি তার সবগুলোতে নাম লেখা থাকতো আমাদের তিনজনের : “মেরী মুনীর কবীর”, কিংবা “মুনীর কবীর মেরী।” প্রথম দিকে কবীর যেখানে চাকরি করেছে, যেখানে বদলি হয়ে গেছে, ও সব জায়গাতেই গিয়েছে। ফরিদপুরে, রাজবাড়িতে, টাঙ্গাইলে, কুমিল্লায়। থাকতো ঢাকায় সলিমুল্লাহ হলে, আসার সময় ময়লা কাপড়ের বস্তা সঙ্গে নিয়ে আসতো, আমি সব ধুইয়ে দিতাম। প্রতিবারই নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি বানিয়ে দিয়েছি। ওর স্মৃতি কি ভোলা যায়?

মেহের কবীর শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত বিদ্যোৎসাহী কর্মোদ্যোগী সংবেদনশীল নারী। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে শিক্ষানুরাগী উদারবাদী মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়ার সুবাদে উচ্চশিক্ষার সোপান অতিক্রমের সুযোগের তিনি সদ্ব্যবহার করেছিলেন অতীব কৃতিত্বের সঙ্গে। বাঙালি মুসলিম মহিলাদের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণে ও শিক্ষা প্রসারে যাঁরা অগ্রগণ্য তিনি তাঁদের একজন।

দীর্ঘ কর্মজীবনে বহু দায়িত্ব নির্বাহ করেছেন সুচারুভাবে, জড়িত ছিলেন বিবিধ সামাজিক এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে। এর পাশাপাশি জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জীবনসঙ্গী হিসেবে এবং আপনজনদের বিশাল পারিবারিক গণ্ডিতেও তিনি বাইরের সঙ্গে ঘরের মিল রচনা করেছেন সার্থকভাবে।

নিজ জীবনাভিজ্ঞতার কথা নম্রকণ্ঠে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তিনি এখানে বর্ণনা করেছেন। ফলে এই গ্রন্থ যেমন তাঁর নারীসত্তা ও ব্যক্তিত্বের উন্মোচনের ছবি মেলে। ধরে, তেমনি বিপুল সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে

নিষ্ঠাবতী ও ঋজুচেতনার এক নারীর দীর্ঘ পথ অতিক্রমের সুবাদে পরিবর্তমান সামাজিক পটভূমিকার পরিচয়ও প্রদান করে। সাদামাটা ঘরোয়া ভঙ্গিতে বলা এই আত্মকথন তাই বহন করছে বহুমাত্রিক তাৎপর্য। এখানে আমরা দেখতে পাই কৃতী এক নারীর অন্তচ্ছবি এবং সেই সুবাদে বাংলাদেশের নারীসমাজের জাগরণ ও সামাজিক ইতিহাসের প্রতিফলন। মেহের কবীরের জীবনকথা তাই অজান্তেই ব্যক্তি-পর্যায় অতিক্রম করে হয়ে পড়েছে সমাজসত্যের আখ্যান।

সূত্র : স্মৃতির পাতায় জীবনের রেখাচিত্র, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ২০০২

Exit mobile version