তীরন্দাজ

চিত্রশিল্পী ও’কিফের স্টুডিও-হোমে | মঈনুস সুলতান | তীরন্দাজ ভ্রমণ


ধূসরে শুভ্রতা মেশানো পাথরের পাহাড় থেকে সাবধানে গাড়িটি নামিয়ে আনি এসপানিওলা শহরে। অনেকদিন পর যুক্তরাষ্ট্রে ড্রাইভ করছি, তাই একাধিক সড়কের ক্রসরোডে হিসাব-কিতাব করে ট্র্যাফিক লাইটের লোহিত আভা সবুজে বিবর্তিত হতেই মোড় ফিরে ঢুকে পড়ি লস আলামস হাইওয়েতে। আমার পাশের সিটে বসে মিস রুবারটা ত্যালমস মানচিত্র ঘেঁটে আমাকে নেভিগেশনে মদত দেন। এক জামানায় আমি সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া নগরীর ভিলা ক্রিসনথিমাম নামে একটি বাড়িতে বাস করতাম। প্রতিবেশী রুবারটা ছিলেন ভিলাটির মালকিন। বাড়িওয়ালি হিসাবে তাঁর মতো রহমদিল মহিলা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রিটোরিয়া বাসের প্রথম দিকে মাস ছয়েক আমার কোন বাহন ছিল না, বেকার হালতে গাড়ি খরিদ করার মতো আর্থিক তাকদও ছিলো না, তাই কম্বি বলে এক ধরনের মাইক্রোবাসে চলাফেরা করতাম, বিষয়টি রুবারটার নজরে পড়লে তিনি আমাকে একখানা লজ্জড় গোছের ভক্সহল গাড়ি ধার দেন।
সড়ক পাড়ি দিতে দিতে দিগন্তে সাংগ্রে-ডে-খৃস্ত পাহাড়ের লোহিতাভ শিলায় চোখ পড়ে। ওখানকার আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘদলে সূর্যরশ্মি তৈরি করেছে একাধিক ধুমকেতুর সোনালি আকৃতি। তার নিচের মাউন্টেন রেঞ্জকে দেখাচ্ছে নীল সিরামিকে তৈরি পাহাড়ের ভাস্কর্যের মতো। রুবারটা রোডম্যাপ নাড়িয়ে বলে ওঠেন, ‘আই নো দ্যা ভিউ ইজ জো ড্রপিং হিয়ার, বাট ইট ইজ ইম্পট্যান্ট দ্যাট উই আরাইভ ইন জর্জিয়া ওকিফ’স হোম সেইফলি।’

আমি হাইওয়েতে মনযোগ ফিরিয়ে এনে পাশে বসা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রুবারটার কথা ভাবি। তিনি সপ্তাহ তিনেক হলো যুক্তরাষ্ট্রে আর্ট ট্র্যাভেল করছেন। অর্থাৎ নিউইয়র্ক, বস্টোন ও লস অ্যাঞ্জেলেস প্রভৃতি শহরের জাদুঘরগুলোতে হাজিরা দিয়ে কেবল মাত্র চিত্রকলা ও ভাস্কর্য পর্যবেক্ষণ করেছেন। দিন দুয়েক হয়, সান্তা ফে শহরে এসে রুবারটা আমার ভদ্রাসনে মেহমান হিসাবে দিন গোজরান করছেন। এখানে দ্রষ্টব্য বস্তু কিংবা স্থানের কোন অনটন নেই। নগরীর আর্ট ডিসট্রিক্টটে তিনশ’টির মতো আর্ট গ্যালারি ছাড়াও আমার বসতবাড়ি থেকে সামান্য দূরে আছে একটি ওয়ার্ল্ড ক্লাস অপেরা হাউস।
নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের রাজধানী হিসাবে সান্তা ফে’র বয়স ৪০৭ বছরের মতো। আমি রুবারটাকে ১৬০৯ সালে নির্মিত নগরীর স্থাপত্যকলার দিক থেকে চমকপ্রদ প্লাজাতে ঘুরে বেড়ানোর অপশন দেই। তিনি আগ্রহ না দেখালে বলি – যাওয়া যাক প্যাগোসাস হটস্প্রিংয়ে। ওখানকার উষ্ণ প্রস্রবণের জলে গা চুবিয়ে তারপর বেড়াতে যাওয়া যায় আদিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের কোন পোয়েবলো বা গ্রামে। রুবারটা এক বাক্যে আমার প্রস্তাবাদি নাকচ করে দিয়ে জানান, আমেরিকার নামজাদা চিত্রকর জর্জিয়া ও’কিফের বাড়িতে তাঁর যাওয়া চাই-ই।
ও’কিফ এক জামানায় সান্তা ফে শহর থেকে ষাট মাইল দক্ষিণে আবিকিউ বলে ছোট্ট এক মফস্বলী জায়গায় গড়ে তুলেছিলেন তাঁর আঁকাজোকার স্টুডিও কাম বসতবাড়ি। রুবারটা আরো জানান যে, তিনি শিল্পসফরের পুরোটাই রেকর্ড করবেন। একজন আর্ট গাইডের সাথে ইমেইল চালাচালি করে তিনি ইতোমধ্যে আমাদের জন্য প্রাইভেট ট্যুরের বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন, সুতরাং আবিকিউয়ের দিকে ড্রাইভ করা ভিন্ন আমার কোন গত্যন্তর থাকে না।


হাইওয়ের পাশ দিয়ে চলতে চলতে পাথরের প্রতিবন্ধকে মোচড় খেয়ে চামা নদী এখানে সৃষ্টি করেছে বহতা জলে দৃষ্টিনন্দন এক অশ্বখুরাকৃতি। রুবারটার ইশারায় আমি গাড়ি থামিয়ে পার্ক করি। তিনি ক্যামেরা হাতে নিয়ে হামলে পড়লে – আমি স্রোতধারার মাঝবরাবর জোড়া দ্বীপাণুতে পাখপাখালির ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে রুবারটার বিষয়আশয় নিয়ে ভাবি।
দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের শাসনামলে রুবারটা ছিলেন সবচেয়ে কমবয়স্ক দুঁদে ডিপ্লোম্যাট। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে ওখানে কৃষ্ণাঙ্গদের দাঁব-রোয়াব কায়েম হলে চাকুরিচ্যুত হন তিনি। তারপর থেকে মহিলা তাঁর জীবন ও অতিক্রান্ত যৌবন উৎসর্গ করছেন চিত্রকলার সমজদারীতে। হামেশা তিনি ফ্রান্স, ইতালি বা ভারতের কোন না কোন গ্যালারিতে ঘুরপাক করেন। চিত্রকলার স্লাইড তোলেন, ভিডিও বানান, তারপর জানাশোনা পঞ্চজনকে তাঁর ছনে ছাওয়া সুপরিসর ভিলাতে জিয়াফত করে এসব দেখনদারির বন্দোবস্ত করেন। ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত এ নারীর পিতা কর্নেল ত্যালমুশ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ-ভারতে কায়েম-মোকাম ছিলেন বেশ কিছু দিন। লড়াই-বিড়াইয়ের তামাদি হলে পর ভারতবর্ষ হাসিল করে আজাদি। তারও বছর কয়েক পর, কর্নেল ত্যালমুস তার মা-মরা বালিকা মেয়ে রুবারটাকে নিয়ে ভারত ফিরে বসবাস করেন বদ্রিনাথ, হরিদ্দার ও ঋষিকেশ প্রভৃতি তীর্থে। তখন পরিচিত হন যোগ, ধ্যান, নিরামিষ খাবার, পরজন্ম প্রভৃতি কনসেপ্টের সাথে।
রুবারটা তাঁর ভিলাতে আর্ট ট্র্যাভেলের স্লাইড শো করলে দাওয়াতি মেহমানদের অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে শরিক হতে হয় মেডিটেশনে। শিল্পসম্পৃক্ত এ ধ্যানের প্রকরণও অত্যন্ত চমকপ্রদ। একবার তিনি প্যারিস ও বার্সিলোনা সফর করে প্রিটোরিয়াতে ফিরেন খোদ পাবলো পিকাসোর চিত্রদির একাধিক স্লাইড নিয়ে। অতপর তাঁর ভিলাতে মেডিটেশনের এন্তেজাম হয়, অমৃতা শেরগিলের একটি অরিজিন্যাল তৈলচিত্রের তলায় জয়পুরি ফরাশের ওপর পদ্মাসনে বসে। চারদিকে ধূপধূনা ও অগুরু-চন্দনের সম্মোহনী সৌরভের ভেতর পিলসুজের আলোয় আমরা অবলোকন করতে বাধ্য হই, পিকাসোর কিউবিস্ট ঘরানার নারীদেহ বিষয়ক চিত্রকলা। আমার হিস্যাতে পড়ে পিকাসোর ‘ওয়োম্যান আন্ডার পাইন ট্রি’ নামক চিত্র।
আমজাদ আলী খানের সরোদ বাদন সমাপ্ত হতেই রুবারটা একটি মোমদান হাতে নিয়ে তার শিখার দিকে মনঃসংযোগ করে চিত্রটির ইন্টাপ্রিটেশনের নির্দেশ দেন। আমি কিউবিস্ট ছাদে অঙ্কিত পাইন বৃক্ষের তলায় রমণীর তসবিরটি ফের অবলোকন করি। চিত্রটিতে নারীদেহ এমন ত্যাড়াবেড়া বেঙ্গামোড়া করে আঁকা হয়েছে যে, এ বাবদে কোন কথা বলতে হিম্মত হয় না। কোন মন্তব্য করা দূরে থাক, চিত্রটির দিকে তাকিয়ে আমার রীতিমতো তব্দা খেয়ে যাওয়ার হালত হয়। আমার মৌনতায় রোষতপ্ত বাণে রুবারটা আমাকে ভস্ম করে দেয়ার কোশেশ করেন।


রুবারটার বিশ্বাসের আরেকটি দিক এ যাত্রায় আমার জিন্দেগিকে আক্রান্ত করছে ব্যাপক মাত্রায়। তাঁর ভারত-বসবাসের দিনে কোন জ্যোতিষ নাকি গ্রহ-নক্ষত্র বিছরিয়ে তাঁকে জানিয়েছিলেন, রুবারটা অন্যজন্মে ছিলেন প্যাঁচা, তিনি তিরুপতির ভেঙ্কেটেশ্বর মন্দিরের চিলেকোঠায় একটি দেয়ালগিরিতে বাস করতেন। বিষয়টি রুবারটা সিরিয়াসলি নিয়েছেন, এবং তারপর থেকে তিনি পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে প্যাঁচকের মূর্তি সংগ্রহ করে তাঁর ভিলাটি সাজিয়েছেন। ভাটি বয়সে এসে তিনি আর্ট ট্র্যাভেল সম্পর্কে তাঁর প্রতিফলন নথিবদ্ধ করে মুসাবিদা করেছেন আত্মজীবনীর মতো একখানা পান্ডুলিপির। গ্রন্থখানা তিনি নিজ খরচে প্রকাশ করার এরাদা রাখেন, এবং তা হবে ‘নট ফর সেইল, ফর প্রাইভেট সার্কুলেশন ওনলি’, অর্থাৎ কারো বইটি পাঠ করার বাসনা হলে লিখিতভাবে দরখাস্ত করতে হবে। এবং সম্ভাব্য পাঠকের বিচারবুদ্ধি শিল্পসমজদার সুলভ হলে তিনি মেহেরবানী করে একখানা বই তাকে ডাকযোগে পাঠাবেন।
গ্রন্থরচনা করা এবং তা মর্জিমাফিক বিপণন করার অধিকার রুবারটার আছে। এ নিয়ে আমার কোন মতামত নেই, তবে বিষয়টি আমার জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে অন্যভাবে। তিনি চাচ্ছেন, আমি বইটি আদ্যপান্থ পাঠ করে একটি ভূমিকা লিখে দেই, এবং গ্রন্থটির নামকরণে অবদান রাখি। তো চাপে পড়ে আমি প্রস্তাব করি – ‘অটোবায়গ্রাফি অব অ্যা রিইনকারনেটেড আউল, বা ‘পূর্ণরজন্ম প্রাপ্ত প্যাঁচার আত্মজীবনী।’ মহিলা খুশমেজাজে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে আমাকে আরেক দফা বিপাকে ফেলেন। তিনি গ্র্যান্ড মারিনার নামে এক শিশি লিক্যুর, গোটা দশেক প্রিমিয়ার ব্র্যান্ডের সিগার এবং উমদা প্রকৃতির সুইচ চকোলেট নিয়ে এসেছেন। আমি ভূমিকা লিখে দেয়াতে গড়িমসি করলে, তিনি আমার গদ্যের শক্তিমত্তার খমোকা তারিফ করে শিশিটি দেখিয়ে বলেন, ‘আই উড লাইক টু রেইজ অ্যা গ্লাস টু সামওয়ান আই রিয়েলি কেয়ার।’ আমি তাঁর ছলাকলা দেখে এমন বিভ্রাটে পড়ি যে, আমার মুখ দিয়ে খাবারের নলা পর্যন্ত নামে না।

ও’কিফের পুষ্পচিত্র ‘ফ্লাওয়ার অব লাইফ’


চামা নদীর বহতা দৃশ্যপট অবলোকন তামাদি হতেই রুবারটা ফিরে আসেন। আমি আবিকিউ নিশানা করে গাড়ি হাঁকাই। আমাদের প্রাইভেট আর্ট ট্যুরের গাইড ব্রুস গোরলি ইমেইলে তার বায়ো পাঠিয়েছেন। আইফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রুবারটা ব্রুস সম্পর্কে টুকটাক তথ্য আমার সাথে শেয়ার করেন। স্থানীয় স্কুলে আর্ট টিচার হিসাবে কাজ করতেন ব্রুস। সম্প্রতি ট্রাম প্রসাশন শিল্পসংক্রান্ত তাবৎ অনুদান কর্তন করলে ব্রুস চাকুরিচ্যুত হন। হালফিল তিনি আর্ট ট্যুরের গাইড হিসেবে কাজ করা ছাড়াও মানসিকভাবে বেসামাল মানুষদের অশ্বারোহনের প্রশিক্ষণ দেন। এরা হাতের কাজ শিখতে চাইলে তাদের ঘোটকের লেঙ্গুড়ের লোম দিয়ে চড়ুই পাখির নীড় তৈরি করার হেকমতও শেখান তিনি। এতে খেচরদের বাসস্থানের কোন সুরাহা হয় না বটে, তবে প্রতিবন্ধীদের নাকি কর্মস্থানের মওকা তৈরি হয়।
আমাদের আর্ট ট্যুরের সময় হয়ে গেছে, তাই একটু জোরে গাড়ি হাঁকিয়ে জর্জিয়া ও’কিফের স্টুডিও-হোমটি যে পাহাড়ে তার টিলায় উঠতে যাই। কাউবয় হ্যাট পরে ঘোড়া হাঁকিয়ে এসে পথ রোধ করে দঁড়ান স্বয়ং ব্রুস। তিনি আমাদের কাছাকাছি একটি গির্জার সামনে পার্ক করতে বলেন। ইতিপূর্বে আমি কখনো ঘোড়ায় চড়া গাইডের মোকাবেলা করিনি, বিষয়টি অভিনব, তাই ক্যামেরা বের করি। ব্রুস অশ্ব থেকে লম্ফ দিয়ে নেমে ঘোড়াটির দিকে ইশারা করে বলেন, ‘ছবি তোলার আগে এর পার্মিশন নিতে হয়’, বলেই তিনি কব্জির ঘড়ি দেখিয়ে ফের বলেন, ‘ইউ গাইজ আর সেভেন মিনিট লেট।’ রুবারটা দেঁতো হেসে পাল্টি দেন, ‘উই আর অপারেটিং ইন আফ্রিকান টাইম।’ মুখখানা খাট্টা করে বেজায় কাটখোট্টাভাবে ব্রুস জবাব দেন, ‘দিস ইজ আমেরিকা, উই ফলো স্ট্রিকট্ টাইম স্কেজ্যুয়েল হিয়ার।’
পরিচয়ের প্রাথমিক পর্ব একটু দ্বন্দ্বাত্মক হওয়ায় আমরা ক্ষুণ্ণ মনে ঘোড়াওয়ালা গাইডের পেছন পেছন চলে আসি জর্জিয়া ও’কিফের স্মৃতিমর্মরিত বাড়িতে। হাল্কা লালচে রঙের কাদামাটি দিয়ে তৈরি অড্যোবি কেতার সুপরিসর বাড়ি। তার দোরগোড়ায় দাঁড়াতেই চোখে পড়ে পাহাড়ের নিচে বিশাল এক প্রান্তর। তা ছাড়িয়ে দিগন্তের দিকে নিশানা করে উঠে গেছে সাদাটে রঙের সুনসান শিলাশ্রেণি। কেন জানি মনে হয়, আজ থেকে দেড়শ বছর আগে এখানে আসলে এ মাঠটিতে আমরা বুনো বাইসন দেখতে পেতাম। রুবারটা ভিডিও ক্যামেরায় ছবি ওঠানোর উদ্যোগ নেন।
কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে ব্রুস বলেন, ‘প্রথমেই ক্যামেরা নিয়ে মশগুল হয়ে পড়লে তো চলবে না। ইউ গাইজ ফার্স্ট নিড টু আন্ডারস্ট্যান্ড হু জর্জিয়া ও’কিফ ওয়াজ, অ্যান্ড হোয়াট হার কনট্রিবিউশন টু আর্ট।’ তার দাবড়ানিতে রুবারটা রীতিমতো ঘাঁ খেয়ে যান। আমাদের স্কুলছাত্রদের মতো ট্রিট করাটা আমারও পছন্দ হয় না। কিন্তু ব্রুস ওসবের তোয়াক্কা না করে লেকচারি কায়দায় কথা বলেন। তো আমি নোটবুক বের করে তথ্যগুলো টুকতে শুরু করি।
জর্জিয়া ও’কিফকে বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী মনে করা হয়। তাঁর জগতজোড়া পরিচয়ের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছে সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে আঁকা কিছু ফুলের চিত্র। তবে সমঝদাররা রঙতুলি বিষয়ক ভাবনার শক্তিমন্ত উপস্থাপনার জন্য তাঁর অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করে থাকেন। পুষ্পের বর্ণাঢ্য চিত্রকলা ছাড়াও নাটকীয় ভঙ্গিতে আঁকা নগরদৃশ্য, বিজন মরুর আলোয় উদ্ভাসিত ল্যান্ডস্কেপ এবং পশুর হাড় ও করোটিকে এঁকেছেন তিনি একাধিকবার হাই ডেজার্টের দিকচক্রাবালে নেমে আসা বর্ণীল আকাশের প্রেক্ষাপটে।
এ মহিলা চিত্রকরের জন্ম আজ থেকে একশত ত্রিশ বছর আগে উইসকনসিনের এক খামার বাড়িতে। পড়াশুনা করেন প্রথমে শিকাগোর আর্ট ইন্সটিটিউট এবং পরে নিউইয়র্কের আর্ট স্টুডেন্টস্ লীগে। আর্ট টিচার হিসাবেও কাজ করেন কিছুদিন কেরোলাইনা ও টেক্সাসের স্কুলে। ১৯২০ সালের দিকে ও’কিফ নিউইয়র্ক শহরের স্কাইস্ক্যাপারগুলোর চিত্র আঁকেন। তখন থেকেই তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান চিত্রকর হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়ে থাকে।

অড্যোবি কেতার সুপরিসর বাড়ি


ব্রুশ আমাদের ও’কিফের বসতবাড়ির কোন কামরায় ঢুকতে দেন না। তবে তিনি ছেঁটে বনসাইয়ের মতো করা জুনিপারের বাগানের ভেতর দিয়ে নিয়ে আসেন একটি করিডরে। ওখানে চৌকাঠের উপর লাগানো বিশাল একটি হরিণের শিঙ, যাকে ও’কিফ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এঁকেছেন একাধিকবার। এখানে দাঁড়িয়ে ব্রুশ আরেক দফা লেকচার ঝাড়েন এবং তার বিবরণী থেকে পাওয়া যায় কিছু মজাদার তথ্য। ও’কিরফর তখনো শিল্পী হিসেবে পরিচিতি তৈরি হয়নি। তবে তাঁর চিত্রকলা নিউইয়র্ক শহরের নামজাদা ফটোগ্রাফার এবং আর্ট ডিলার আলফ্রেড স্টিগলিৎজের নজরে আসে। তিনি ১৯১৬ সালে আয়োজন করেন তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী। পরে এ ভদ্রসন্তান তাঁর চিত্রাদির গুণমুগ্ধ স্তাবক থেকে হয়ে দাঁড়ান স্বামী। তাঁরা পরষ্পরকে চিত্রপত্র লিখেন এন্তার। যার টোট্যাল পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৫,০০০। কোন কোন লাভনোট ছিলো ৪০ পৃষ্ঠার মতো নানা বিষয়ে আলাপচারিতার সুদীর্ঘ দলিল। স্টিগলিৎজ সাহেবের সাথে যখন ও’কিফের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তখনও তিনি অন্য এক নারীর সাথে অফিসিয়েলি বিবাহিত। তাঁর স্বামীতে বিবর্তিত হওয়ার কিসসাও চমকপ্রদ। ফটোগ্রাফার হিসেবে তিনি নানা পরিপ্রেক্ষিত থেকে তুলেন ও’কিফের অনেকগুলো পোর্ট্রেট পিকচার। একবার তাঁর বাসনা হয়, ও’কিফের পোশাক-আশাক ছাড়া কেবল মাত্র তাঁর শরীরের ছবি তোলার। এ ক্রিয়াটি সম্পাদনের জন্য তিনি ও’কিফকে নিয়ে যান একটি নির্জন কেবিনে। ওখানে ক্যামেরা ভাওছাও করে নগ্ন দেহের শট নেয়ার সময় কাচের জানালায় ছায়া পড়ে তাঁর বিবাহিত স্ত্রীর। এ ঘটনার অজুহাতে ভেঙে যায় তাঁদের বিবাহ। তো পরবর্তী সময়ে হরেক রকমের ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে সদ্য ডিভোর্স-প্রাপ্ত স্টিগলিৎজ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন ও’কিফের সাথে।


ব্রুসের কথা শুনতে শুনতে রুবারটার নজরে পড়ে, বাড়ির লালচে রঙের দেয়ালের পাশে লাগানো বনসাই করা একটি জুনিপার বৃক্ষ। তরুটির ফটোজেনিক অবয়বে আকৃষ্ট রুবারটা ওদিকে ছুটে যান তার একটি স্ন্যাপশট নিতে। এতে স্পষ্টত অসন্তুষ্ট হন ব্রুস। তিনি রুবারটাকে ডেকে এনে বলেন, ‘লিসেন ম্যাম, হিয়ার উই আর টকিং অ্যাবাউট জর্জিয়া ও’কিফ, চিত্রকর হিসেবে তিনি যখন খ্যাতির তুঙ্গে, শী ওয়াজ কনসিডারড্ মোস্ট ফটোগ্রাফড্ ওয়োম্যান ইন টোয়াটিয়েথ সেঞ্চুরি। কিন্তু তাতে হয়েছে কী? হু অ্যাকচুয়েলি কেয়ারস্ অ্যাবাউট হার ফটোগ্রাফস। হোয়াট ইজ মোস্ট ইমপরটেন্ট ইজ হার পেইনটিংস। একটা কথা আমি আপনাকে পরিস্কার বলতে চাই ম্যাডাম, ও’কিফের চিত্রকলার সৌন্দর্য ও গভীরতার আন্দাজ পেতে হলে জানতে হবে তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড। তো কাইন্ডলি ক্যামেরা নিয়ে ছোটাছুটি না করে মনযোগ দিয়ে তাঁর চিত্রকলার খানিকটা প্রেক্ষাপট শুনুন। তথ্যগুলোর নোট নিলে আখেরে ফায়দা আপনারই হবে’, বলে ব্রুস আমাদের দুজনের দিকে এমনভাবে তাকান যে, আলোচনায় মনযোগ না দিলে আমরা ফাইনাল পরীক্ষায় গাট্টা মারবো। রুবারটা কিন্তু অযাচিত লেকচারে এবার বিরক্ত হন না, ধরা পড়ে যাওয়া অবাধ্য ছাত্রীর মতো দেঁতো হেসে গণ্ডদেশে অনেকগুলো রেখা ফুটিয়ে বলেন, ‘মি. ব্রুস, গো এহেড স্যার। আপনার দেয়া ইনফরমেশনগুলো যে কাজে লাগবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’
ব্রুস তোষামোদে খুশি হয়ে আমাদের নিয়ে আসেন ও’কিফের সবজি বাগানে। তাঁর বাগিচাটি দেখার মতো। এ বাড়িটিতে থিতু হওয়ার পর থেকে ও’কিফ সাত্ত্বিক জীবনযাপন শুরু করেন। সবজি ও ফলের চাষে তিনি সার ও কীটনাশক ব্যবহার সম্পূর্ণ পরিহার করেন। প্রতিদিন নিজে কিছুটা সময় বাগানে নিড়ানি বা প্রুনিংয়ের কাজ করতেন। তাঁর মালি হিসেবে কাজ করা কর্মচারীর এক সন্তান এখনো বাগানটি রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। উৎপাদিত সবজি ও ফল দান করে দেয়া হয়, গৃহহীন মানুষের জন্য চালু স্যুপ কিচেন বা লঙ্গরখানায়। ও’কিফ নিজ হাতে আপেল, নাশপাতি, শশা ইত্যাদি শীতঋতুতে ব্যবহারের জন্য টিনের ক্যানে ভিনিগার দিয়ে ভরে রাখতেন।
জর্জিয়া ও’কিফের বাগিচার চৌখুপ্পি নকশা আকর্ষণীয়য় হলেও আমরা বিস্তর ব্যয় করে প্রাইভেট ট্যুরে এসে চিত্রকরের শাকসবজিজনিত খাদ্যাভাস নিয়ে গালগল্প শুনতে চাইনা। রুবারটার মুখে অধৈর্যের রেখা ফোটে। তিনি কিছু না বললে, আমি উদ্যোগ নিয়ে জানতে চাই, ‘মি. ব্রুস, শিল্পী যে হঠাৎ করে নিউইয়র্ক ছেড়ে নিউ মেক্সিকোর মফস্বলী শহর অবিকিউতে এসে বাস করতে শুরু করলেন,,আমাদের তার প্রেক্ষাপটটি কাইন্ডলি একটু বর্ণনা করা যায়?’ তিনি চোখমুখ কুঁচকে যেন ক্লাসের ত্যাদোড় ছাত্রটিকে সামলাচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে জবাব দেন, ‘আলোচনা তো ওই দিকেই যাচ্ছে, ইউ রিয়েলি নিড টু হ্যাভ সাম পেসেন্স, জাস্ট লিসেন কেয়ারফুলি।’

দেয়ালে ঠেকানো একটি মই


আমাদের নিয়ে এবার তিনি বাড়িটির অন্য দিকে যান। ওখানে দেয়ালে ঠেকানো একটি মই দেখে আমার কৌতূহল হয়। কিন্তু কোন প্রশ্ন করার আগেই ব্রুস কথা বলতে শুরু করেন। ১৯২৭ সালে শিল্পী ও’কিফ প্রথমবার নিউ মেক্সিকোর সান্তা ফে শহরে আসেন। নিউইয়র্কের স্ক্যাইস্কাপার্সকে বিষয়বস্তু করে তাঁর ইতোমধ্যে আঁকাজোকা হয়ে গেছে প্রচুর। সম্ভবত চিত্রকর খুঁজছিলেন নতুন কিছু। এখানকার বর্ণাঢ্য রক ফর্মেশনে সৃষ্ট ল্যান্ডস্কেপে আলোছায়ার লীলাবৈচিত্র তাঁকে আকর্ষণ করে তীব্রভাবে। নেটিভ আমেরিকান বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও শিল্পকর্ম তাঁর সামনে মেলে ধরে আর্বান জনপদ থেকে বহুদূরে বিচ্ছিন্ন ভিন্ন রকমের এক ভুবন। এদিককার রোদে শুকানো ইট ও কাদামাটি দিয়ে তৈরি অ্যাডোবি কেতার গৃহনির্মাণ শৈলীও তাঁর পছন্দ হয়। আবিকিউ তখনো ঠিক শহর হয়ে ওঠেনি। বিজলিবাতির লাইন বসেনি, তাই ঘরে ঘরে সন্ধ্যাবেলা জ্বলত কেরোসিনের লণ্ঠন। ঘুরতে ঘুরতে এ জায়গায় এসে চোখের সামনে শিলা-পাহাড়ের পাদদেশে রোদে ঝলমলানো প্রান্তর দেখে এখানে একটি আঁকাজোকার স্টুডিও তৈরির বাসনা জাগে তাঁর। তিনি বাড়ি তৈরির জন্য জমি খোঁজেন। কিন্তু জায়গাটি স্থানীয় গির্জার মালিকানাধীন, এর পরিচালকরা তাঁর কাছে জমি বিক্রি করতে অস্বীকার করেন। কিছুটা অপ্রাপ্তি নিয়ে ও’কিফ ফিরে যান নিউইয়র্কে। তারপর বার বার ফিরে আসতে শুরু করেন অত্র এলাকায়। কখনো বাস করেন সান্তা ফে শহরে, কখনো তাঁর নিবাস হয় অবিকিউ থেকে খানিকটা দূরে গোস্ট রেঞ্চ বলে একটি গবাদিপশু পালনের খামারে।
এ সময় জর্জিয়া ও’কিফ আউটডোরে চিত্র আঁকতে শুরু করেন। পাহাড়ি সব বিচ্ছিন্ন প্রান্তরে যাতায়াতের জন্য তিনি একটি ফোর্ড মোটরকার ব্যবহার করতেন। খোলা মাঠে রোদের তীব্র দাহদাহে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি গাড়ির ভেতরে আঁকাজোকার চিন্তা করেন। তখন আরেকটি সমস্যা দেখা দেয়। মরুভূতির ক্যাকটাস ও অন্যান্য বনফুলে উড়ে বেড়ানো মৌমাছিরা তাঁকে আক্রমণ করতে শুরু করে। এতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ও’কিফ গাড়ির পেছনের সিট ফেলে দিয়ে ওখানে ইজেল বসিয়ে আঁকতে শুরু করেন। ব্রুস আমাদের গাড়িতে আঁকাজোকার পরিসরের একটি ফটোগ্রাফ দেখান। এদিকে ঘরের দেয়ালে ঠেকানো আছে একটি মই। আমি চাপলিশে তার ছবি তুলতে গেলে ব্রুস নকল করা ছাত্রের দিকে কড়া ধাচের শিক্ষক যে ভঙ্গিতে তাকান, সেভাবে কটমটে নজর ছুড়ে দিয়ে মন্তব্য করেন, ‘মই এখানে কেন রাখা হয়েছে, কী ঘটনা, ও’কিফ তা কীভাবে ব্যবহার করতেন তা জানতে পারলে তুমি যে এই মাত্র ছবি তুললে, তা অনেক মিনিংফুল হতো।’ আমি ফের তাকে তোয়াজ করে বলি, ‘মই বেয়ে ছাদে যাওয়ার বিষয়টা জানার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি, কাইন্ডলি একটু খুলে বলুন স্যার।’ তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বাচ্চাদের যেন ভূতের গল্প শোনাচ্ছেন, এ রকম চোখ বড় বড় করে ফিসফিসিয়ে ছাদের বিষয়টা বিস্তারিত ইলাবরেট করেন।
এ বাড়িতে বসবাসের শুরুর দিকে ও’কিফের নেটিভ আমেরিকান সম্প্রদায়ের এক আদিবাসী যুবকের সাথে গড়ে ওঠে অন্তরঙ্গতা। তার সাথে তিনি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন সামনের প্রান্তরে। স্পর্শ করতেন প্রতিটি মরুপ্রিয় উদ্ভিদ ও পাথর। মাঝে মাঝে তাঁরা ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে যেতেন ‘প্লাজা ব্লাংকা বা হোয়াইট প্লেস’ নামক একটি গিরিপথে। ওখানে একটি বালুকাময় অরোয়ো বা ড্রাই রিভার বেডের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ শ্বেতবর্ণের নানা আকৃতির রক ফর্মেশন। ও’কিফ ভালোবাসতেন গিরিখাতের তীব্র নির্জনতায় দাঁড়িয়ে মেঘমুক্ত নীল আসমানের প্রেক্ষাপটে শুভ্র পাথরের ছড়ানো স্তম্ভগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে ইজেলে তাঁর অনুভূতিকে আঁকতে। মাঝে মাঝে অসমবয়সী নারী-পুরুষ দুলকি চালে চামা নদী অতিক্রম করে চলে আসতেন খানিকটা দূরের গোস্ট রেঞ্চ নামের একটি খামারে। কখনো ওখানকার কোন গাছে বেঁধে ঘোড়া দুটিতে চরতে দিয়ে তাঁরা হাইক করে উঠে যেতেন গোস্ট রেঞ্চের শিথান বরাবর পাহাড়টিতে। ওখানে তাদের গন্তব্য হতো চিমনি রক বলে বিচিত্র শেইপের একটি শিলাস্তম্ভ।


ব্রুসের বিবরণীর এক পর্যায়ে রুবারটা বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, ‘মই কিংবা ছাদের বিষয়টা তো টাচই করা হলো না।’ ব্রুস মন্তব্যটি শুনতে পান, কিন্তু সরাসরি রিয়েক্ট না করে তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলেন, ‘ঈশ্বর যদি ধৈর্য ধরে কিছু শোনার ক্ষমতা দিতেন, তাহলে তুমি জীবনে উন্নতি করতে পারতে।’ রুবারটাকে কোন পাল্টি দেয়ার সুযোগ না দিয়ে ব্রুস ফের তার বকবকানির কল চালু করেন। আমি কিসসা কতোটা অথেনটিক, তা বোঝার জন্য ডিটেলগুলোর দিকে মনযোগ দেই।
প্লাজা ব্লাংকা বা গোস্ট রেঞ্চে ঘোড়া হাঁকিয়ে সন্ধ্যার দিকে ও’কিফ ও তাঁর আদিবাসী সাথী ক্লান্ত হয়ে ফিরতেন বাড়িতে। আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসতেন ও’কিফ, আবিকিউ তখনো দারুণভাবে মফস্বল, বিজলি বাতির লাইন বসেনি, তো রাতের অন্ধকার আকাশে তারকার রোশনাই ছড়াতো মন হরণ করা সম্মোহন। মইয়ের আইডিয়া আসে আদতে আদিবাসী যুবকের মাথা থেকে। ও’কিফ ফ্রুটজুসের সাথে খানিকটা রাম মিশিয়ে মই বেয়ে উঠে যেতেন ছাদে। ওখানে শুয়ে থাকতেন তিনি। পাশে বসে আদিবাসী যুবক তাঁকে বলে যেত, নানাবিধ নক্ষত্রমণ্ডল নিয়ে যুগ যুগ ধরে নেটিভ আমেরিকানদের সমাজে প্রচলিত কিংবদন্তি।
ব্রুসের দেয়া এ তথ্য আমাদের একটু ভাবায়। আমরা অবগত যে, ও’কিফ যখন নিউ মেক্সিকোতে বেড়াতে আসতেন তখন থেকে স্বামী স্টিগলিৎজের সাথে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছিল। ১৯২৭ সালের দিকে ও’কিফ সান্তা ফে এলাকায় পার্মানেন্টলি চলে আসলে তাঁদের সম্পর্কে ব্যাপক চিড় ধরে; এবং স্টিগলিৎজ সাহেব সঙ্গোপনে অন্য নারীর দিকে ঝুঁকে পড়েন। ভাবি, এবার ব্রুসের কাছ থেকে এইমাত্র যা শুনলাম, তা কতটা সঠিক তা খতিয়ে দেখতে হয়।
ব্রুস প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আমাদের নিয়ে আসেন বাড়ির অন্যদিকে। তিনি একটি অ্যালবাম মেলে ধরে বলেন, ‘নাউ আই নিড টু গিভ ইউ গাইজ অ্যা সলিড লেসন অ্যাবাউট ও’কিফস ওয়ার্ক, আমি মিন হার পেইনটিং প্রিসাইসলি।’ অ্যালবামে প্রতিটি পৃষ্ঠায় কোন না কোন পেইনটিংয়ের অনুলিপির কালার প্লেট। ব্রুস প্রথমে ‘হোয়াইট প্লেস ইন শ্যাডো’ শিরোনামের চিত্রটি দেখান। এটি ও’কিফের আদিবাসী যুবকের সান্নিধ্যে প্লাজা ব্লাংকাতে ঘুরে বেড়ানোর স্মারক। চিত্রটির শুভ্র প্রেক্ষাপটে আলোছায়ার মেদুর কনট্রাস্ট আমাদের মুগ্ধ করে চকিতে। চিত্রকর একটি সাদারঙের পাথুরে স্তম্ভ এমন আকাশছোঁয়া করে এঁকেছেন যে, মনে হয়, পাষাণের এ শুভ্র মিনারটি নীরবে দাঁড়িয়ে আছে সৃষ্টির আদিকাল থেকে। শিলাস্তম্ভটির পায়ের কাছে ছড়ানো বালুকা ও নুড়িপাথরে স্তব্ধ হয়ে আছে বহুযুগের প্রগাঢ় নির্জনতা।
ব্রুস পৃষ্ঠা উল্টিয়ে এবার ভিন্ন আরেকটি বিশাল তেলের কাজ দেখান। এ চিত্রটির শিরোনাম ‘স্কাই অ্যাবাভ দ্যা ক্লাউডস্।’ মেঘমালা অতিক্রম করে আকাশের বর্ণাঢ্য এ শূন্যতার দিকে তাকাতেই আমার মন ভরে ওঠে হলুদে হাল্কা সবুজ মেশানো হাহাকারে। রুবারটা দারুণ বিস্ময়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠেন, ‘লুক, হাউ ও’কিফ ক্যাপচারড্ দ্যা এন্ডলেস এক্সপানস্ অব ক্লাউড।’
ব্রুস যেন প্রভিতাবান কোন ছাত্রের ক্লাস প্রজেক্ট তার গার্জিয়ানকে দেখাচ্ছেন, এ রকমের অহংকারে তৈলচিত্রটির প্লেট আামাদের চোখের কাছে নিয়ে এসে বলেন, ‘লিসেন গাইজ, পঞ্চাশের দশকে এরোপ্লেনে চড়ার সময় ও’কিফ মেঘমণ্ডলের উপরের স্তরে ছড়ানো দৃশ্যপটকে খুঁটিয়ে অবলোকন করতেন। তারপর ১৯৬৩ সালে, যখন তাঁর বয়স অতিক্রম করতে যাচ্ছে সাতাত্তর, তখন তিনি বিশাল প্রেক্ষাপটে স্মৃতি থেকে এ চিত্রটি আঁকতে শুরু করেন।’ রুবারটা জানতে চান, ‘বিশাল পরিসর মানে কী? হাউ বিগ ওয়াজ হার ওয়ার্ক?’ তিনি ঘাড় নাড়িয়ে বলেন, ‘গাইজ দিস পেইনটিং ইজ রিয়েলি হিউজ। এ চিত্রটিকে আর্ট-ক্রিটিকরা ফরাসি চিত্রকর ক্লদ মোনের শাপলা ফুলের ম্যুরালের সাথে তুলনা করে থাকেন। ‘স্কাই অ্যাভাব’ সম্পর্কে খোদ ও’কিফ যে মন্তব্য করেছিলেন, প্লিজ রিড দিস কার্ড গাইজ।’
তিনি আমাদের দিকে একটি কার্ডে টাইপ করা শিল্পীর কমেন্ট এগিয়ে দিলে আমি পড়তে পড়তে তার নোট নেই। তিনি লিখেছেন, ‘চিত্রটি প্রস্থে চব্বিশ ফুট, উচ্চতায় কাটায় কাটায় আট ফুট। আঁকার সময় আমি কাজ শুরু করতাম ভোর ছয়টার দিকে। তারপর এক নাগাড়ে কাজ চালিয়ে যেতাম রাত আটটা-নয়টা অব্দি। গ্রীষ্মে কাজের সূত্রপাত হয়েছিল, আমি চাচ্ছিলাম শীত পড়ার আগেই তৈলচিত্রটি শেষ করতে। কারণ আমি কাজ করছিলাম বাড়ির গ্যারেজ-ঘরে। ওখানে তুষারহীম ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য কোন হিটারের ব্যবস্থা ছিল না। আর চিত্রটির আকার ছিলো হাস্যকর রকমের বিরাট। আমি একই বিষয়ের ওপর বছর দুয়েক কাজ করেছিলাম। এঁকেছিলাম একই ধরনের থিমনির্ভর অনেকগুলো চিত্র।…আর দ্যাখো, আঁকতে আঁকতে কী দাঁড়িয়েছে। আমার সবচেয়ে ভালো কাজ এটি নয় হয়তো, কিন্তু এর মান একেবারে খপও না।’
ব্রুস তার অ্যালবামটি গুটিয়ে ফেললে রুবারটা অসন্তুষ্টি জানিয়ে বলেন, ‘ও’কিফকে দুনিয়াজুড়ে মানুষ চেনে পুষ্পের জাদুময় স্থিরচিত্র আঁকার জন্য। মিস্টার ব্রুস, আপনি তো এ নিয়ে কিছু বললেন না।’ পা বাড়িয়ে করিডরের দিকে যেতে যেতে তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে বলেন, ‘হার ফ্লাওয়ার পেইনটিংস্ আর নট হোয়াট ইউ থিংক অ্যাবাউট। ফুলের বর্ণীল চিত্রগুলোকে অনেক সমালোচক এবং আর্ট কমেন্টটেটার মনে করতেন, এগুলো হচ্ছে নারী দেহের জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক। অনেক বছর ধরে এ ধারণা দানা বাঁধতে শুরু করে। তো অবশেষে কোন এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী পরিষ্কারভাবে এই ইন্টারপ্রিটেশনের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি দর্শকদের উপদেশ দেন, ফুলের চিত্রগুলোকে তিনি যেভাবে নিরিখ করেছেন, অর্থাৎ এগুলো যেন ক্লোজআপ থেকে দেখা হয়।’
রুবারটার কৌতূহল মেটে না। তিনি আলটপকা বলে বসেন, ‘ইজ দ্যাট অল জর্জিয়া ও’কিফ সেড আবাউট হার ফ্লাওয়ার পেইনটিংস্?’ অহিষ্ণুভাবে ব্রুস জবাব দেন, ‘শিল্পী তাঁর দীর্ঘজীবনে এঁকেছিলেন দুই হাজারটি চিত্র, এর মধ্যে কেবল মাত্র দুশটির বিষয়বস্তুতে ঘুরে-ফিরে এসেছে ফুলের প্রতিকৃতি। লেটস্ ট্রাই টু লার্ন হোয়াট এলস হ্যাপেন্ড টু হার লাইফ, ও-কে।’ এ মন্তব্যে স্পষ্টত রুবারটা অসন্তুষ্ট হন।
তবে ব্রুস তালা খুলে আমাদের ঘরের ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করলে আমরা দুজনে খুশি হয়ে উঠি। তিনি আসবাবপত্র বা ডেকোরেশনের কোন কিছু স্পর্শ না করার নির্দেশ দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলেন, ‘সচরাচর ট্যুরে যে সব দর্শক আসে, আমরা তাদের ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেই না। কাচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তারা ঘরের ভেতরটা দেখে নেয়। তবে তোমরা প্রাইভেট ট্যুরে অনেক বেশি খরচ করে এসেছ, সো আই অ্যাম ডুয়িং ইউ গাইজ আ ফেভার।’
আমরা একটি সুপরিসর কামরার ভেতর দিয়ে তাঁর আঁকাজোকার স্টুডিওর দিকে অগ্রসর হই। বাড়ির এদিককার মেঝে কাদামাটির তকতকে করে লেপাপুছা। রুবারটা স্পের্টস্ শু পায়ে ধুপধাপ করে হাঁটলে, তাঁর দিকে কটমট করে তাকিয়ে ব্রুস বলেন, ‘লিসেন, দিস হাউস ইজ লাইক অ্যা ন্যাশনেল মনুমেন্ট। কাইন্ডলি চেষ্টা করুন একটু আস্তে-ধীরে পা ফেলার।’
সুপরিসর স্টুডিওতে অবশেষে আমরা ঢুকি জুতামোজা খুলে। কামরাটিতে শিল্পীর আঁকাজোকার সরঞ্জাম, বসার আরাম কেদারা ছাড়া বাড়তি আসবাবপত্র কিছু নেই। শেষ বয়সে ও’কিফের হাতেগড়া একটি ভাস্কর্যের পাশে দাঁড় করানো তাঁর ইজেলে অঙ্কনরত অবস্থার আলোকচিত্র। বিশাল এ কক্ষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে দেয়ালজোড়া কাচের মস্তবড় জানালা। আমি তার পাশে গিয়ে একটু চুপচাপ দাঁড়াই। জানালার বাইরে টেবিলের মতো দেখতে একটি কাঠের কাঠামো। তাতে রাখা হরেক রকম আকৃতির অনেকগুলো পাথর।
মাইনফিল্ডে যে রকম সৈনিকরা হুশিয়ারির সাথে হাঁটে, ঠিক তেমনি অতি সাবধানে ব্রুস হেঁটে আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘ও’কিফ ভালোবাসতেন পাথর, যখনই আউটডোরে আঁকতে যেতেন, নানা বর্ণের মসৃণ সব পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসতেন বাড়িতে। অবসর সময়ে এ পাথরগুলো সাজিয়ে নানা রকমের আকৃতি তৈরি করতে ভালোবাসতেন শিল্পী।’
ব্রুস সরে যেতেই জানালার কাচ অতিক্রম করে দূরের দিগন্তছোঁয়া প্রান্তরের দিকে নিবিড়ভাবে তাকানোর সুযোগ পাই। তখনই অনুভব করি, প্রতিবেশের পাহাড়-প্রান্তরের সাথে এ স্টুডিওর পরিসরটি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। প্রান্তর থেকে উঠে আসে ছড়ানো পাথর ও ক্যাকটাসের মিশ্রিত সবুজাভ-ধূসর আভা। এ দৃশ্যপট থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল হয়। মনে হয়, গাছপালাহীন বিরাণ এ ময়দানে যুগ যুগ ধরে জমে থাকা স্তব্ধতা তার বিমূর্ত অবয়ব নিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে স্বচ্ছ কাচে।
এ কামরার প্রগাঢ় মৌনতায় যেন চিড় না ধরে, এ রকমের হুশিয়ারির সাথে ব্রুস ফের ফিসফিসিয়ে কথা বলেন। বয়স আশির কাছাকাছি পৌঁছলে ও’কিফ আর আউটডোরে যেতে পারতেন না তেমন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি কমে আসছিল, তাই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্মৃতি থেকে করে যেতেন জলরঙের কাজ। ১৯৭৩ সালের দিকে তাঁর পরিচয় হয় সাতাশ বছর বয়সী তরুণ মৃৎশিল্পী জন হ্যামিলটনের সাথে। তাঁকে তিনি অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত করেন। ততদিনে তাঁর চোখের আলো আরও ক্ষীণ হয়ে এসেছে বটে, কিন্তু শেখার আগ্রহ কমেনি একবিন্দু। ও’কিফ জন হ্যামিলটনের কাছ থেকে শেখেন কাদামাটি দিয়ে তৈজসপত্র তৈরির হেকমত। কিছুদিন পর সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেলে এ অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে অনুমানে তিনি ভাস্কর্য তৈরি করতে শুরু করেন। ও’কিফের ক্ষয়িষ্ণু শরীরের প্রতি জন হ্যামিলটন ছিলেন খুবই সংবেদনশীল। শেষ বয়সে নিঃসঙ্গ এ নারীর তত্ত্বতালাবি করতেন নির্দ্বিধায়। রাতে তাঁর কোন প্রয়োজন হতে পারে ভেবে তিনি স্টুডিওতেই ঘুমাতেন।
ব্রুস এবার আমাদের নিয়ে আসেন ও’কিফের পার্লারে। আমরা খানিক তফাত থেকে দেখি, তাঁর সাউন্ড সিস্টেম, মিউজিক প্লেয়ার এবং ইউরোপীয় ধ্রুপদী ঘরানার সিম্ফনির অনেকগুলো রেকর্ড। সারা জীবনভর সকাল-সন্ধ্যা চিত্র এঁকে গেছেন ও’কিফ। যখন আঁকতেন না তখন হয় কাজ করতেন তাঁর বাগানে, অথবা আউটডোরে ঘুরে বেড়িয়ে সংগ্রহ করতেন নতুন আইডিয়া। তবে ১৯৩০ সালে নার্ভাস ব্রেকডাউন হলে অল্পদিনের জন্য তাঁর কাজে বিরতি আসে। শোনা যায়, তীব্র মনঃসংযোগে তিনি কাটিয়ে ওঠেন স্নায়বিক বৈকল্য এবং গা ঝাঁড়া দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতে সম্পূর্ণ নতুনভাবে আঁকার। এ সময়ে তাঁর করা একটি বিখ্যাত উক্তি ব্রুস আমাদের তার নোটবুক থেকে পড়ে শোনান : ‘আমি যা এতকাল শিখেছি, তা ভুলে গিয়ে প্রথাগতভাবে আঁকাজোকার খোলনলচে শুদ্ধ সবকিছু পাল্টে সিদ্ধান্ত নেই সম্পূর্ণ নতুনভাবে চিত্রকলা সৃষ্টির।’ এ ঘোষণার পর থেকে তিনি যা আঁকেন, তা তাঁর সৃজনশীলতায় যোগ করে নতুন এক মাত্রা, এবং জাঁদরেল সব চিত্র সমালোচকরা তাঁকে ‘পায়োনিয়ার অব আমেরিকান মডার্নইজম’ অভিধায় অভিহিত করতে শুরু করেন।
এ পর্যন্ত শুনে রুবারটা ভুরু কুঁচকে জানতে চান, ‘তবে কী ও’কিফের দিনযাপনে অবসর বা রিলাকসেশন বলে কিছু ছিলো না?’ খানিক চিন্তাভাবনা করে ব্রুস যে জবাব দেন, তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে : বয়স পঁচাত্তর অতিক্রম করার পর তিনি আর রাতের দিকে কাজ করতেন না। সন্ধ্যাবেলা এ পার্লারে চুপচাপ বসে নিবিড়ভাবে শুনতেন সংগীত। ও’কিফ যদিও একাকী থাকতে পছন্দ করতেন, তখন তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় টড ওয়েভ নামে অত্যন্ত যশস্বী এক ফটোগ্রাফারের সঙ্গে। মাঝে মাঝে টড ওয়েভ তাঁর সাথে দেখা করতে এ বাড়িতে আসতেন। তিনি তাঁর বেশ কতগুলো আলোকচিত্রও তোলেন। শেষ বয়সেও ও’কিফ ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। তিনি ইউরোপ সফর করেন। কলোরাডো নদী ও গ্র্যান্ড কেনিয়ানের খরস্রোতে রাবারের ডিঙি ভাসিয়ে রাফটিংও করেন।
ব্রুস এবার আলোচনার মোড় ফিরিয়ে ও’কিফের শিল্পী হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতির বিষয়ে কিছু তথ্য দেন। শেষ বয়সে তিনি ‘প্রেসিডেন্টস্ মেডেল অব ফ্রিডম’ এবং ‘ন্যাশনেল মেডেল অব আর্টস’ প্রভৃতি পদকে ভূষিত হন। তাঁর ‘রেড পপি’ নামে একটি চিত্রকে ব্যবহার করে আমেরিকার পোস্টাল সার্ভিস ইস্যু করে একটি ডাকটিকিট। ক্রমশ আধুনিক চিত্রশৈলীর উন্নয়নে তাঁর অবদানের জন্য তিনি শিল্পসমঝদারের অঙ্গনে বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন। তাঁর চিত্রকর্ম বিকাতে শুরু করে বিপুল মূল্যে। যেমন তাঁর আঁকা ‘জিমসন উইড’ নামক একটি শুভ্র ফুলের চিত্র বিক্রি হয় প্রায় সাড়ে চৌচল্লিশ মিলিওন ডলারে। এ মূল্যে ইতিপূর্বে কোন নারীশিল্পীর কোন চিত্র কখনো বিক্রি হয়নি। ১৯৪৬ সালের ছয় মার্চ ৯৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ও’কিফ। তখন চিত্রকর্ম বিক্রি বাবদ তাঁর অর্জিত সম্পত্তির মূল্য ছিলো ৭৬ মিলিওন ডলার।
রুবারটা জানতে চান, ’নিঃসন্তান ও’কিফের সয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় কে?’ ব্রুস আমাদের নিয়ে স্টুডিওর বাইরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জানান, ‘তরুণ জন হ্যামিলটন, যিনি ও’কিফকে শেষ বয়সে দেখভাল করতো, শিল্পীর উইল অনুযায়ী সামান্য খানিকটা বিত্তের মালিক হয় সে, বাকিটা চলে যায় একটি ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে জর্জিয়া ও’কিফ ফাউন্ডেশনে।’
বাইরের অঙিনায় এসে দাঁড়াতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কালচে-সবুজ রঙের একটি পাহাড়। তার পাথুরে আস্তরণে লেগে থাকা ঝোপঝাড়ে সূর্যালোক অসামান্য আভায় ঝিলিক পেড়ে যাচ্ছে। ব্রুস পাহাড়টির দিকে ইশারা করে বলেন, ‘এ পর্বতটি সেরো পিডারনাল নামে খ্যাত। শিল্পী এটিকে নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আঁকেন মোট ২৮ বার। মাঝে মাঝে তিনি বলতেন, এ হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত পাহাড়। সম্পূর্ণ নিজস্ব। ঈশ্বর আমাকে বলেছেন, আমি যদি অনেকবার গাঢ় মনযোগ দিয়ে এ পাহাড়কে আঁকি, তাহলে তিনি আমাকে পর্বতটি দান করে দেবেন। শিল্পীর মরদেহ দাহ করার পর তাঁর ভস্ম এ পাহাড়ের সর্বত্র ছিটিয়ে দেয়া হয়।
ও’কিফের স্টুডিও কাম হোমে আমাদের ট্যুর শেষ হয়ে আসে। ব্রুস আমাদের হাতে শিল্পীর বহুমূল্যে বিক্রিত চিত্র জিমসন উইডের অনুলিপি আঁকা একটি পিকচার কার্ড স্যুভিনিওর হিসেবে ধরিয়ে দেন। কার্ডে শুভ্র পুষ্পের অসামান্য চিত্রটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে এক তরুণী । কার্ডটি পেয়ে খুশি হয়ে রুবারটা ব্রুসের কব্জি ঝাঁকিয়ে দিয়ে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান। কার্ডের উল্টো পৃষ্ঠায় মুদ্রিত কয়েকটি ওয়েব সাইট দেখিয়ে ব্রুস আমাদের হোমটাস্ক দেয়ার কায়দায় বলেন, ‘শিল্পী সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাইলে ওয়েব সাইটগুলো ঘেঁটে দেখতে পারো।’
এতে প্রীত হয়ে রুবারটা আরেক দফা ধন্যবাদ জানালে, ব্রুস দুটি তাগড়া গোছের তেজি ঘোড়ার ছবি দেখিয়ে বলেন,‘ও’কিফ যে সব জায়গা – যেমন প্লাজা ব্লাংকা বা গোস্ট রেঞ্চে মাঝে মাঝে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতেন, তোমরা যদি তাঁর মতো ঘোড়ায় চড়ে ওই সব জায়গায় বেড়াতে যেতে চাও, জাস্ট গিভ মি অ্যা কল, হিয়ার ইজ মাই সেল নাম্বার, আমি হর্স রাইডের বন্দোবস্ত করতে পারবো।’
প্রস্তাবটি সম্ভবত রুবারটার মনে ধরে। তিনি আমার মতামত বোঝার জন্য আমার দিকে তাকান। আমি একটু ভাবি, ঘোড়াফোড়ায় চড়ার আমার বিশেষ একটা আগ্রহ নেই। তারপর যদি ঘোড়া হাঁকাতে রাজিও হই, তাহলে ব্রুস বাবাজি না আমার হর্স রাইডিংয়ের খুঁত ধরে সমালোচনা করেন। আমি তৎক্ষণাৎ সম্মত না হয়ে বলি, ‘রুবারটা, আমি পরে এক সময় বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখবো।’ আমার উত্তর স্পষ্টত রুবারটাকে বিরক্ত করে। তিনি কিছু না বলে মুখখানা ভুতুম প্যাঁচার মতো গোলাকার করে নীরবে গাড়িতে উঠে বসেন।

Exit mobile version