স্মৃতিগদ্য
রাহুল পুরকায়স্থ
“আমার গ্রীষ্ম নেই, আমার বৃষ্টি নেই, নেই কোন একা ধানক্ষেত”
রাহুল পুরকায়স্থ : কবিতার জলস্রোতে একক সন্তরণে বিশ্বাসী কবি
“এখনো জানি না কত আলো জাগে তোমার জঠরে
এই শ্বাস এই বায়ু এইসব পতনপ্রয়াস
কতদূর নিয়ে যাবে, কোন জলজীবনের দিকে
তাঁবুর কাপড়- ছেঁড়া পতাকার ঢেউ
সারি সারি ধরে এই দ্বীপভূমি
শহরের কালো ধোঁয়া স্যাঁতস্যাঁতে ঘর ঘেঁষে আকাশে ছড়ায়…” (ভ্রূণ)
কলকাতা শহরের কোনো জায়গাই আমি আজও চিনে উঠতে পারিনি। প্রতিবার রাহুলদার বাড়ি যাওয়ার সময় বারবার টেলিফোন করে তবে পৌঁছাতে হতো। যে ক’বার রাতে থেকেছি, কোন কোন সময় সারাদিন একসাথে থেকেছি, অনেক কথা হয়েছে, অন্তরের কথা, যন্ত্রণার কথা, প্রতিবার মনে হয়েছে, একটা মানুষ শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্য এতো পাগল হয়! মায়া-কল্পনাই শুধু নয়, ভালোবাসা হয়ে ওঠে শরীরী কামনার, যত্নের ও দ্বিপাক্ষিক আশ্রয়ের। হয়ত এই জন্যই ও লিখতে পারে – “আশ্রয় চেয়েছি আমি প্রতিটি সন্ধ্যায়/ যেভাবে গাছের ছায়া গাছেই মিলায়/ ভালবেসেও/ এ-শহরে প্রেম আসে/ উল্কাপাত হয়/ প্রতিটি সন্ধ্যাই জানি/ বিগ্রহের রতিচ্যুত ক্ষয়”; অথবা “যেভাবে তোমাকে চাই, যেভাবে তোমার কথা ভাবি/ যেভাবে বন্ধুভাষা আমাকেও খায়/ যেভাবে পাখির ছায়া অতি সাবধানে/ শহর পেরিয়ে একা গ্রামে উড়ে যায়” (আমার সামাজিক ভূমিকা) অথবা “আবার উল্টানো ওষ্ঠ!/ উল্টো আবাহনে/ প্রস্তুত রয়েছি জেনে/ করেছো বিদ্রুপ!/ তোমার ও-ওষ্ঠে আমি/ অস্থি্রের থেকে স্থির/ স্থির থেকে হয়ে যাবো চুপ” (ও তরঙ্গ লাফাও)।
তখনো অর্পিতা সাংসদ হয়নি। ঋদ্ধির ক্যামেরায় কিছু ছবি তোলা হলো, বছর পাঁচেক পরে একটা খামে করে যত্নে রাখা সেই ছবির দুটো ছবি আমাকে দিয়ে বলেছিল, “স্মৃতি হারায় না গৌতম, রেখে দিতে হয়।”
রাহুলদার সঙ্গে শেষবার যখন একসাথে থাকা, তখন শরীরের অসুস্থতা ওঁকে জাপটে ধরেনি। একটি শিশু ও আমরা কয়েকজন। পরদিন সকালে চিত্রকর বিপ্লব এলো। আমার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন, কিন্তু সেই প্রথম মুখোমুখি। আমাদের তখন কবিতা নিয়ে, ছবি নিয়ে, থিয়েটার নিয়ে তুমুল আড্ডা। সেদিনের একটা কথা, পরে অনেকবার আমাদের কথাবার্তায় ফিরে ফিরে এসেছে। “মৃত্যুকে এড়িয়ে তুই কোথায় যাবি? মৃত্যুর ভয়ে জীবন থেকে পালানোটাও তো কাপুরুষের কাজ। এর মাঝেই আমাদের যাকিছু, লেখাপড়া, প্রেম, মদ ও নিজস্ব জীবন…”। আজ রাহুল পুরকায়স্থহীন দিনগুলোতে এমন অনেক টুকরো টুকরো কথা, স্মৃতি এসে সামনে দাঁড়াচ্ছে। এক সন্ধ্যায় তাঁর বাড়ি থেকে দুজনে বেড়িয়ে ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গার ঘাটে এসে বসেছি। কাছেই কোথাও খুব ভালো চাওমিন পাওয়া যায়, তিনজনের জন্য তা নিয়ে এলাম আমরা। আগেই সেখানে এসে অপেক্ষা করছিলেন শিল্পী সনাতন দিন্দা। ওর বেলঘরিয়ার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নার্সিং হোমে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা সন্ধ্যা সন্ধ্যায় গঙ্গার ঘাটের দিকে চলে এসেছি। অর্পিতা ঘোষের বাবা তখন নার্সিং হোমে চিকিৎসাধীন। কাজ পাগল রাহুলদার সঙ্গে আড্ডা ও মদের একটা নিবিড় সখ্য ছিল। কিন্তু এত কিছুর পরেও ওর মতো বন্ধুদের খুঁটিনাটি খবর রাখা, পাশে দাঁড়ানোর জন্য ব্যাকুল মানুষ সচরাচর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডুয়ার্সে এলে বা আসার সম্ভাবনা হলেও সে আমাকে জানাতো। ২০১১-তে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর আমাকে বনজঙ্গলের এক দুরবর্তী ব্রাঞ্চে বদলি করা হয়েছে। রাহুলদা সেই খবর পেয়ে এক রাতে আমাকে ফোন করলো, “তোকে দূরে কোথায় বদলি করেছে শুনলাম, আমি ওঁদের নিয়ে আলিপুরদুয়ারের রায়মাটাং বনবাংলোয় যাওয়ার কথা ভাবছি। যাওয়ার পথে তোর ওখানে ঘুরে যাবো।” আমাকে অবাক করে দুদিনের মাথায় ভুটান সীমান্তের সামচি ও চামুর্চি সন্নিহিত আমার ব্যাংকের শাখায় তারা হাজির।
এটা শুধুমাত্র রাহুল পুরকায়স্থই পারে। এমনই চমক দিতে ও ছিল সিদ্ধহস্ত। একবার ফোন, “আমরা জলদাপাড়ার হলং বাংলোয় এসেছি। কাল তোর ওখানে আসছি। তিস্তা পর্যটক আবাসে রাতে থাকবো।” সেই সন্ধ্যায় জলপাইগুড়ি শহরের উপকন্ঠে, চাবাগানের মধ্যে ‘গ্রিনভিঊ’ রেস্টুরেন্টে ডিনারে গেলাম আমরা। রাহুল দা, ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমি। সেখানে অর্পিতার ফোন, আমকে ধরিয়ে দিলো ও। তখনো অর্পিতা সাংসদ হয়নি। ঋদ্ধির ক্যামেরায় কিছু ছবি তোলা হলো, বছর পাঁচেক পরে একটা খামে করে যত্নে রাখা সেই ছবির দুটো ছবি আমাকে দিয়ে বলেছিল, “স্মৃতি হারায় না গৌতম, রেখে দিতে হয়।”
এমন অনেক অনেক স্মৃতি আজ ঘিরে ধরছে। কোনো এক সরকারি সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে সেবার আমরা ধর্মতলার স্টেট গেস্ট হাউসে উঠেছি। রাতে আমার ঘরে আড্ডা বসলো। মধ্যরাত পাড় হয়ে চললো সেই আড্ডা। প্রচুর কবিতা পড়া হলো, রাহুল দা একটা কবিতার সিরিজ পড়েছিলেন, পরে বইয়ে আসে কবিতাগুলো, “নেশা এক প্রিয় ফল।” ওর কথায় আমি সেদিন ‘গোসানীমঙ্গল’ নামে দীর্ঘ কবিতা-আখ্যান পড়েছিলাম। রাতে বেসামাল দুজনে একই খাটে থেকে গেলাম।
আমার মা চলে গেলেন ২০১৫-এর ২০ জুলাই। রাহুল দা ফোন করলেন, শোনালো মা’কে নিয়ে লেখা কবিতা। সন্ধ্যায় তাঁর মা’কে নিয়ে লেখা সেই কবিতাটি মেসেজ করলেন –
অন্ধকারে গাইছে যে গান
সে-গান তোমার, সে-গান তোমার
অন্ধকারে বলছে যে-শ্লোক
সে শ্লোক তোমার, সে শ্লোক
তোমার
অন্ধকারে হাঁটছে যে পথ
সে পথ তোমার, সে পথ তোমার
অন্ধকারে, অন্ধকারে”
জয়দেব বসু চলে যাওয়ার পরে অনেকদিন কলকাতা যেতে মন চায় নি। দমদমে জয়দেবের ফ্ল্যাটে যে রাতে আমি, সাদ কামালী, প্রবুব্ধ, চন্দ্রা, গৌতম চৌধুরীরা জমজমাট আড্ডা দিলাম, তার সপ্তাখানেক পরে জয়দেবের চলে যাওয়া, কিছুদিনের মধ্যে চন্দ্রার মৃত্যু। এই ২৭ জুলাই তারিখেই প্রবুব্ধের চলে যাওয়া, একদিন আগে জুলাইতেই রাহুলদা চলে গেলেন! শোক নয়, কান্না নয়, এই জুলাই শূন্যাতার পাত্র শূন্যতায় ভরছে শুধু। আমি একা একা পড়ি কবিতা …
ঘুম নেই, বাতাস ঘুরছে পিছে পিছে
একটি পাখির শিস কাহিনির নীচে
প্রস্তুত করেছে শয্যা, কল্পশতানক
এবার বলোতো বাবা তুমি ধর্মবক
এই যে খোয়াব, এর অর্থ কীবা হয়
এখন দখিনবায়, বিহিত সময়…
(রাহুল পুরকায়স্থ)
কবিতায় দশক ধরে বিচারের যৌক্তিকতা নিয়ে তাঁর ও আমার মতো অনেকেরই বিরুদ্ধমত আছে। কিন্তু সময়টাকে চিহ্নিত করতে উল্লেখ করছি – আশির দশকে বাংলা কবিতায় যে স্বতন্ত্র স্বর যুক্ত হয়েছিল, তার অন্যতম কুশিলব রাহুল পুরকায়স্থ। কবিতায় সেই সময়কে যারা নিয়ন্ত্রণ করছেন সেই কবিদের অধিকাংশের প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে আশির দশকের শেষ দিকে। অনেকের আবার নব্বইয়ের দশকের সূচনায়। রাহুল পুরকায়স্থের প্রথম কবিতা বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮তে। অজস্র কবিতার দ্রুত জন্মদানে আগ্রহী ছিল না সে, অপেক্ষা ও খোঁজে বিশ্বাসী রাহুলের ‘অন্ধকার, প্রিয় স্বরলিপি’র সেই কবিতার থেকে এর তিন দশক পরে প্রকাশিত বই ‘কলোনি কবিতা’ অথবা ‘ও তরঙ্গ লাফাও’, এই মধ্যবর্তী সময়ে কবিতায় রাহুল অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক।
১৯৯২তে রাহুল তাঁর ‘শ্বাসাঘাত তাঁতকল পুরনো হরফ-এর মধ্যদিয়ে বাংলা কবিতার পাঠককে এক নতুন কাব্যভাষার সঙ্গে পরিচিত করালেন। এর পূর্ববর্তী সময়ে অজস্র প্রতিবাদী লিটল ম্যাগাজিনকে আশ্রয় করে পুরুলিয়া থেকে জলপাইগুড়ি – আধা-নাগরিক জনপদে, কলকাতাকেন্দ্রিকতার বাইরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে কবি ও কবিতার সজীব সংযোগ সম্ভাবনা। বাংলা ভাষাভাষী সমস্ত অঞ্চলে জেগে উঠছিল নতুন সমিধ সংগ্রহের আয়োজন, ক্ষেত্রভেদে এই আয়োজনের চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু আধেয়তে এবং পরিবাহক বাচনিক আধারে অনুভূত হয় একই ধরনের বিচ্ছুরণ। এই সময়ের কবিরা প্রমাণ করলেন যেন, কবিতার প্রতিবেদনে কত বিচিত্র সূচনাবিন্দু থাকতে পারে। এঁদের মধ্যে যাঁদের নির্মিতি থেকে পড়ুয়ার পাঠকৃতি-সন্ধান তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে, সেই সরণীতে সর্বাগ্রে থাকবেন রাহুল পুরকায়স্থ, জয়দেব বসুরা। তাঁর কবিতায় নাগরিক আচরণের সীমাবদ্ধতা নয়, ছিল দ্বিবাচনিক কল্পনার স্বতোৎসারিত প্রকাশ। রাহুলের ঠিক পূর্ববর্তী কবি রণজিৎ দাশ লিখেছিলেন, প্রতিটি বাস্তবতাই রূপকের বাস্তবতা। রাহুল এই বাস্তবতার ‘স্মার্ট ও সংযত প্রকাশের চূড়ান্ত চেহারাটা আমাদের সামনে রেখেছিলো। এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল চান না কোনো কবিই, রাহুলের কবিতার প্রতিটি শব্দ, যতিচিহ্ন, দুলাইনের মধ্যবর্তী শূন্যতা আমাদের সেই নিশ্ছিদ্র নির্মাণের সামনে দাঁড় করায় যা এই সময়ের প্রকৃত কবিতার পরিচায়ক।
রাহুলের কবিতায় অনেকেই অন্ধকারের কথা বলেন, আমি বলি আলোর কথা। অনুজ কবি আলোচক সোমব্রত সরকারের বয়ানে, “রাহুল আসলে সৃষ্টির নক্ত অর্থশূন্যতার দিকে পাশ ফিরে কবিতা লেখেন। তাঁর কবিতায় পৃথিবীর মহাযুদ্ধমথিত যাবতীয় পর্ব ও পর্বাঙ্গ লেগে থাকে।” সহমত জানিয়ে বলি, প্রেম রাহুলের কবিতায় স্থুলতা ও অবসাদকে ধীরে ধীরে আত্মসাৎ করে নিয়ে নবপর্যায়ের অদ্ব্যর্থ যোগসাজশে মেতে ওঠে ভয়ংকরভাবে।
রাহুল প্রতিটি কবিতায় তাঁর এক স্বতন্ত্র সৌন্দর্যচেতনার প্রকাশ ঘটায়, সৌন্দর্যকে আপাত শান্ত করে তাকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।
“সন্তরণপটু মন/ রেখেছি দু’পায়ে/ পদমনে ডুব দেয় যৌন অপলাপ/ জলে ডোবে, জলে পোড়ে/ রঙ্গন রঙ্গন/ এ-জীবন প্রকৃতির নেশা-সম্মোহন/ আমার পীতাভ দেহ/ রেখাদ্যুতিময়/ তোমার শরীরে স্রোত/ জোয়ারের পানি/ রেখাজল, জলরেখা, মায়ারাক্ষসিনী।/ সে কি জানে আমি তার রহস্যসন্ধানী (ও তরঙ্গ লাফাও )।”
রাহুল প্রতিটি কবিতায় তাঁর এক স্বতন্ত্র সৌন্দর্যচেতনার প্রকাশ ঘটায়, সৌন্দর্যকে আপাত শান্ত করে তাকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। অসহায় পাঠক সম্পর্কের সেই অনিশ্চয়তার জায়গাটা আবিষ্কার করে। ‘একটি জটিল আয়ুরেখা’ থেকে ‘কলোনি কবিতা’ সেই বয়ানেরই অন্থহীন নির্মাণ। এই নির্মাণের আড়াল থেকে অন্ধকারের স্বতন্ত্র রশ্মির মতো কবিতা জন্ম নেয় দাগশূন্য বোধের তলে। রাহুল অন্ধকারের কথা লেখেন, কিন্তু এই অন্ধকারের আবহে তিনি খুঁজে নেন উজ্জীবনের মন্ত্র – “অস্থির অন্ধকারে কুমোর পড়ার মাটি ছলাৎ ছলাৎ/ মাটির কারিগর আজ খুঁজছে পাথর।” কবিতা তার আধিপত্য বিস্তার করে অথবা বলা যায় রাহুলের আধিপত্য কায়েম হতে থাকে পাঠকের চেতনায়, নতুন এক বয়ানের দিকে নিয়ে যায় পাঠককে। প্রচলিত ও প্রাতিষ্ঠানিক চর্চানির্মিত ভরকেন্দ্র তখন টলে যায় – “বাসভূমি, যাকে তুমি রুটি বল, যাকে/ বল শ্রমচুক্তি, আজ তার শীর্ষদেশে বিরোধী আভাস/ সৌরতন্তু মেলে দিল/ উপমা নির্ভর এই আধুনিক কেতা, ঢেলে দিল/ দশদিকে ভ্রমণকলস’ (রণতন্ত্র)। শেষের দিকে লেখা কবিতাতেও সেই তীব্র ভালোবাসার রেণুস্খলন দেখা যায় – ‘তোমার দু-চোখ যেন অন্ধ প্রজাপতি/ উড়ে আসে, বসে পড়ে আমার দু-চোখে/ পরাগ মিলিত হয়, এইরূপে, হয়ে থাকে (রঙিন কবিতা)।”
কবি রাহুলের নান্দনিক অবস্থানকে বুঝে নিতে হলে তাঁর বহু-আবরণে আচ্ছন্ন জীবনযাপন থেকে উপলব্ধির ভরকেন্দ্রকে আবিস্কার করতে হবে। কিন্তু আপাত-সময়ের মধ্যে যেহেতু কেন্দ্র নেই কোথাও, তাঁর কবিতার পরাভাষার পথ ও পাথেয়র দ্বিবাচনিকতা ফুটে উঠতে থাকে। ‘অন্ধকার প্রিয়, স্বরলিপি’ পর্যায় থেকে তিনি ‘নীলদাবদাহ’ ভরা এ-জীবনের আলেখ্য রচনা করেছেন। ‘আকণ্ঠ কাঙাল এক শ্মশান চণ্ডাল’ লক্ষ করছে সময় ও পরিসর জুড়ে শুধু ‘বলির বাজনা বাজছে’; ‘গোটা পৃথিবীর ক্ষুধা’ নানা অনুষঙ্গে উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়” (তপোধীর ভট্টাচার্য)। ব্যাক্তিগত প্রেমের গণ্ডিকাটা কাব্যজগতে সীমাবন্ধ থাকেনি রাহুলের কবিতা ।
রাহুল পুরকায়স্থের জন্ম ১৯৬৪ সালে কলকাতা নগরে। বাংলা সাহিত্যের অনেক প্রধান কবির ভিটা শ্রীহট্ট বা সিলেটে। রণজিৎ দাশ, শক্তিপদ রাজগুরু, তপোধীর ভট্টাচার্য, অমিতাভ দেব চৌধুরী, অশোকবিজয় রাহা, প্রবুব্ধসুন্দর কর, শংকর চক্রবর্তীদের মতো রাহুলেরও শেকড়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাছন রাজা, চৈতন্যের শ্রীহট্ট। অজস্র কবিতার জন্ম দেওয়ার তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না, লিখতেন তাই কম। বলতেন যে ভালো কবিতার পাঠক কম হয়, স্বল্প সংখায় থাকুক কিছু সৎ পাঠক। ১৯৮৮ থেকে পরবর্তী চার দশকে কবিতার বই সাকুল্যে ৮/৯টি মাত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গোরস্থান রোড’, ‘অবাকযান’, ‘নেশা এক প্রিয় ফল’ প্রভৃতি। আটের দশকের চার কবির এক আড্ডার উল্লেখ করা যায় – রাহুল, সুবোধ, মল্লিকা, জয়দেব। রাহুলের কথায়, “বেশী পাঠক হয়ে গেলে অসুবিধা হয় আমার। মল্লিকা সেদিন খুব চেপে ধরেছিল, আমি বলেছিলাম আমার দশজন পাঠকই ভাল। একশোজন পাঠক হলে আমি নিজেকে সন্দেহ করবো। আমি সেটা আজও বিশ্বাস করি।” অনেক সময় শক্তির সঙ্গে রাহুলকে জুড়ে দেওয়া হয়, সুত্রে থাকে নেশাপ্রিয়তা। কিন্তু রাহুলের নেশার উৎস আকণ্ঠ প্রেম, শক্তির ছিল শোম্যানশিপ ও আলাদা করে নিজেকে তুলে ধরা, দুজনকে এক জায়গায় আনা যায় না, অন্যায়। নেশা করতো নিজের পরিসরে, কখনও তা অন্যের বিরক্তির কারণ হয়নি। নেশা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব দর্শন ছিল, “নেশা আমাদের অবচেতনকে শাসন করে। নেশা আমার অবচেতনকে দিয়ে অনেক কিছু করায়, অনেক কিছু বলার যেগুলো আমি বলতে চাই।” নেশা তার প্রকাশের সহায়ক করে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আত্মসমর্পনের হেতু করে তোলেন নি। কবিতার বাইরেও পড়াশোনাসহ প্রচুর কাজ অনবরত করে গেছেন তিনি, নেশাগ্রস্থ হয়ে এত কাজ করা যায় না। নকশালবাড়ি নিয়ে আলাদা দুর্বলতা ছিল, সংকলন-গ্রন্থ করেছেন ‘বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা’।
গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়মিত সামলেছেন। রাহুল পুরকায়স্থর দায়িত্ববোধ নিয়ে কোনো দিন প্রশ্ন ওঠেনি। অন্যায়ের সঙ্গে, আদর্শের সঙ্গে, অন্যায় সমঝোতা করেন নি কোনোদিন। একসময় ‘২৪ঘন্টা’য় বড় পদে ছিলেন, মতের অমিল হয়েছে, এককথায় ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর প্রায় দুবছর কর্মহীন হয়ে কাটিয়েছেন। একদিন খুব দুঃখ করে বলছিলেন, “জমা পুঁজি দিয়ে অনেকটা টানলাম, আর ক’দিন পারবো জানি না।” কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন, এই সময় ইচ্ছে করলে শাসক অনুগ্রহ নিয়ে আয়ের ব্যবস্থা করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। একসময় বাংলাদেশে কাজের খোঁজে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। মাঝে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কিন্তু সেখানেও থাকতে পারেননি। অবশেষে আবার বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এলেন। সেখান থেকেই চলে গেলেন চিরশান্তির দিকে, চিরনিদ্রায়। রাহুল পুরকায়স্থ, কবিতায় যে মৃত্যুভরা জীবন খননে আনাগ্রহী নন, উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা যাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে আসতো –
“গুল্মময় এজীবন আমাদের নয়,/ আমাদের দেহে থাক পিতৃ-পরিচয়/ জীবনে জীবন চাই উৎসে পরিণামে/ শুশ্রূষার ছায়া চাই এই শ্মশানে।” সেই কবি সমর্পিত হলো চিরপ্রণম্য অগ্নির কাছে। বিদায় বন্ধু… কবিতার সেতুবন্ধনে তুমি থাকবে চিরকাল…

