তীরন্দাজ নববর্ষ সংখ্যা
সকাল নটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েই নুজহাত মেসেঞ্জারে মেসেজ দেয় সোহানাকে। ফোন দিও সময় পেলে। সোহানা মেসেজ সীন করেই বন্ধুকে ফোন করে । বলে কী হয়েছে নুজু? অপরপক্ষ জবাব দেয়- হাবীবের এই মেন্টাল টর্চার আমি আর নিতে পারছি না। আমার সাথে তার কোনো শারিরীক সম্পর্ক নেই। মানসিক নির্ভরশীলতা নেই। শুধু সন্তানের জন্য একসাথে থাকা.. আর সেই সুযোগে সে আমাকে এক্সপ্লয়েট করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। সোহানা বলে- এই চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে এসে কী করবা? জীবন তো একটা ফাঁদ ছাড়া কিছু না।
তুমি নিজের মতো থাকো। তাছাড়া ছেলে ফারহানের কথা চিন্তা করেই তো সংসারে থেকে গেলে। এখন আর কী করবে! সোহানার সাথে কথা বলে নুজহাতের মন অনেকটা শান্ত হয়ে যায়। এরপর সে লেকচার দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রনীকক্ষে চলে যায়।
লেকচার শেষ করে রানারকে এলাচ দিয়ে চা আর লেক্সাস বিস্কুট দিতে বলে। এর ভেতরই কানে হেডফোন লাগিয়ে শোনে
কোন গোপনে মন পুড়েছে
বৃষ্টি থামার পরে,
আমার ভিতর ঘরে।
নয়ন কালো মেঘ জমালো
ঝিনুকের অন্তরে,
আমার ভিতর ঘরে।
গান শুনে প্রশান্ত মনে ভাবে কীভাবে সোহানার সাথে পরিচয় তার? সোহানা আর্কিটেক্ট। দারুণ আবৃত্তি করে।
ভীষণ সুন্দর কন্ঠ। এসব ভাবতে ভাবতেই সোহানার সাথে পরিচয়ের দিনটা মানসপটে ভেসে ওঠে —
বইমেলা ২০১৯। নুজহাত দাঁড়িয়ে আছে টি এস সি গেটে। তার প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ – ছায়া সহিস প্রকাশিত হয়েছে। সেদিন ফেসবুকের ব্যাচমেট গ্রুপ মানে ৯৪- ৯৬ ব্যাচের লেখকদের বই অন্য বন্ধুরা কিনবে এবং একসাথে সারাদিন আড্ডায় গল্পে মেতে থাকবে। এমনই ইচ্ছা অন্তর্জালের সকল বন্ধুদের। নুজহাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল অদূরে লাল জমিনে কালো বড় বড় ফুলপাতা একটা জর্জেট শাড়ি পরে, লাল লিপিষ্টিক আর চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নুজহাত কেবলই মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়েছিল। তারপর সারাদিন একসাথে বইমেলার ঘোরাঘুরি করে বই কেনা, ওদের এক প্রকাশক বন্ধুর স্টলে গিয়ে ছোলা-মুড়ি, জিলিপি খাওয়া, বিশজন ব্যাচমেট বন্ধু হোটেল নীরবে গিয়ে একসাথে লাঞ্চ করে।
বিকেলে আবার বইমেলা ঘুরে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে।
এর ভেতরই নুজহাতের সাথে কথা হয় সোহানার। নুজহাত বলে- তুমি দেখতে আমার বন্ধু সেঁজুতি সিমিনের মতো। ও আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড ছিল। সোহানা জিজ্ঞেস করে ছিল কেন, এখন নেই? নুজহাত হাসি দিয়ে বলে হয়তো আছে অথবা নেই..
২
১৯৯৮ সালের শরত কালের এক দুপুর । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের টিভি রুম। নুজহাত জহির রায়হান পরিচালিত সিনেমা “কাঁচের দেয়াল” দেখছে। সাথে আরও দুই-তিন জন ছাত্রীও দেখছে সিনেমাটি। এরভেতর টিভি রুমে একটা সুন্দরী মেয়ে এসে টিভি রিমোট হাতে নিয়ে হিন্দি সিনেমা -ইশক দেখার জন্য চ্যানেল বদলে দেয়। অমনি নুজহাত বলে- এই আপু আমরা তো অই সিনেমাটা দেখছিলাম। আপনি পালটে দিলেন কেন?
অমনি বিড়াল চোখা সুন্দরী বলে- সবাই দেখছিল? নাকি আপনি একা দেখছিলেন? অই সত্তুরের দশকের সিনেমা কেউ দ্যাখে আজকাল? নুজহাত ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল- নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সব বাতিল করে আপনারা হিন্দি সিনেমায় ডুবে মরবেন
আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন! দ্যাখেন, দ্যাখেন ইশক দ্যাখেন। মেয়েটি মিষ্টি হেসে নুজহাতের দিকে তাকিয়েছিল। নুজহাতের কথা সিমিনের খুব ভালো লেগে যায়। যদিও নুজহাত তারপর হনহন করে বেরিয়ে নিজের রুম বর্ধিত -৬৮ তে চলে যায়। এরপর সেই বন্ধুত্ব ক্যাম্পাসে সবার মুখে মুখে ফিরেছে। কিন্তু সিমিন এর শেষ টেনেছিল তীব্র ছলনা আর প্রচণ্ড আঘাতে। নুজহাত হয়তো সেই বেদনারই প্রশ্রয় চায় সোহানার কাছে।
৩
অফিসে গিয়ে খুব মনদিয়ে লেকচারের কিছু অংশ বাকি সেটা প্রস্তুত করছে নুজহাত। নুজহাত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেসনালসের সহযোগী অধ্যাপক। এছাড়াও একজন সৃজনশীল লেখক। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লেখে সে। এই মনযোগের মাঝখানেই মেসেজ আসে সোহানার। সোহানা লিখেছে – শুভসকাল লেখক বান্ধবী। কী খবর? মন ভালো? আমার কিছু ভালো লাগছে না। শত ব্যস্ততা নিয়েও সাথে সাথে ফোন দেয় নুজহাত। সোহানা বলে আর বলো না। এই চাটগাইয়াদের সাথে আমি আর পারি না। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে সবসময় ডমিনেট করতে চায়। ব্যস্ততা সত্ত্বেও নুজহাত সোহানার সব কথা শোনে। সোহানার অধিকাংশ সময় অভিযোগ থাকে শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে। ওর শ্বাশুড়ি এবং আর্কিটেক্ট স্বামী দুজনেই দুই মেয়েকে শাসন করে। বাচ্চারা ঘরে একদম স্বাধীনতা পায় না। বাচ্চাদের জন্য কষ্ট হয় তার। সোহানা এবং স্বাধীন দুজনেই পড়াশোনা করেছে রুয়েটে আর্কিটেকচার বিষয়ে। এখন কয়েক বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম শহরে একটা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে নাম- ওয়ার্মিং হাউজ। সোহানার বাবা ছিলেন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বড় হয়েছে মুক্তমনা পরিবেশে। সংস্কৃতির সাথে ছিল প্রগাঢ় বন্ধন।কিন্তু এখন স্বাধীন এবং তার পরিবারের সাথে সাংস্কৃতিক সংঘাত হয় প্রায়শই। চট্টগ্রামের সংস্কৃতি খুব পুরুষদের প্রাধান্য দেয়। যৌতুক এবং মেয়ের বাড়িকে শোষণ করা এই সংস্কৃতি একেবারে বৈধ করে নিয়েছে। সোহানার এই বিষয়গুলো একদমই ভালো লাগে না।কিন্তু স্বাধীন এবং সোহানা একজন অন্যজনকে খুব পছন্দ করে। যদিও মাঝে মাঝেই সোহানা আফসোস করে স্বাধীন দিন দিন চিন্তা -চেতনায় উগ্র মৌলবাদী হয়ে উঠছে। সোহানা আফসোস করে বলে- স্বাধীন চায় না তাই আমি আবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছি। শুধু কী আমিই স্যাক্রিফাইস করে যাব? নুজহাত বুঝিয়ে বলে- পুরোপুরি স্যাক্রিফাইস করবে না। নিজেকেও বাঁচিয়ে রাখবে। তুমি তো প্রচ্ছদ করা শুরু করেছিলে। ওটা একটা -দুইটা করবে। আর তিনমাসে একটা আবৃত্তি করবে। স্বাধীন ভাইকে কবিতা নির্বাচন করতে দেবে। উনাকে তোমার কাজে অন্তর্ভুক্ত কর। দেখবে করতে পারবে।
এক সপ্তাহ পর বেলা এগারোটায় সোহানা মেয়ের স্কুলে যাচ্ছে। এরভেতর নুজহাতের মেসেজ। আমার বাঁচতে আর ভালো লাগে না। আমি সুইসাইডের কথা ভাবছি। সাথে সাথে সোহানা ফোন দেয়। জিজ্ঞেস করে – কী হইছে? এত বাজে কথা কেন? তুমি একজন সফল মানুষ, একজন মা, একজন লেখক। নুজহাত বলে- আমার এই জীবন খুব অর্থহীন লাগে। ক্ষুধা যেমন অনিবার্য। যৌনতাও অনিবার্য। ক্ষুধা যেমন এমনিই লাগে, ঘুম যেমন আসেই, তেমনি যৌনতাও আসেই। দেখ হাবীব বিষয়টা একদম বুঝতে চায় না। আমি কতদিন এভাবে বাঁচব! গতকাল ছেলে গিয়েছে আমার বোনের বাসায়।
আমি হাবীবকে জিজ্ঞেস করলাম- তুমি আমার কাছে ঘুমাবা? হাবীব সরাসরি বলল -না। যে মানুষ আমার থেকে ওয়াইফ হিসেবে সমস্ত সেবা নেয়, আমার অর্থ ভোগ করে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সাপোর্ট নেয়। সে আমার কাছে একটা রাত ঘুমাতে চায় না! আমার নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে। আমি কী এতটাই অপাঙ্কতেও!
সোহানা বুঝতে পারে – নুজহাতের ক্ষত অনেক গভীরে।
সোহানা বলে- যদি একদম না ই পারো তাহলে তুমি ডিভোর্স দিয়ে দাও। কিন্তু তুমি এই ধরনের বাজে চিন্তা করো না। কিছুটা শান্ত হয় নুজহাত
সেদিন রাত নটায় হঠাৎ ব্যাচমেট বন্ধু সাজমুল হাজির।
এসে বলে নুজহাত, হাবীব চল। লং ড্রাইভে যাব। রাত নটায় যায় গুলশান একটা কফিশপে যায় সবাই। তারপর যায় পূর্বাচল একটা লেকের পাড়ে। রাত বারোটায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায় নুজহাত। সাজমুলকে যে সোহানা পাঠিয়েছে সেটা নুজহাতের বুঝতে বাকি থাকে না । এরপর তিনদিন সোহানা দিনে অন্তত তিন-চার বার ফোন দিয়েছে নুজহাতকে। প্রতিনিয়ত সবকিছুর খোঁজ খবর নিয়েছে।
৪
নুজহাত সাধারণত সাড়ে তিনটায় অফিস থেকে ফেরে।
এসে ছেলেকে নিয়ে খেয়ে বিশ্রাম নেয়। তারপর ৪.৩০ বাজলেই লিখতে বা পড়তে বসে। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ। ওয়েলকাম সোহানা। এই দুইদিন আগেই গেছে সোহানার জন্মদিন। সোহানার জন্য নুজহাত লাল পাড়ের একটা ছাই রঙের তাঁতের শাড়ি কিনেছে। এর দুইদিন পরে সন্ধ্যায় মেডিসিন ডাক্তার আফসানার চেম্বারে দেখা হয় ওয়াসিফ, সাজমুল, সেজান, সোহানা সবার সাথে। নুজহাত গিয়ে মাই গার্লফ্রেন্ড বলে সোহানাকে জড়িয়ে ধরে। সাজমুল বলে- দ্যাশটা আম্রিকা অইয়া গেল! অমনি সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। ওয়াসিফ নুজহাতের কানে ফিসফিস করে বলে- তুমি কী ওকে কিছু কর? নুজহাত বলে -ছি! আমাদের প্রেম প্লেটোনিক। অইখানে বসে সবাই পরিকল্পনা করে পরেরদিন খুব সকালে বনানী স্টার রেঁস্তোরায় সকালে নাশতা খেয়ে ওরা ধানমন্ডি লেক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে পুরান ঢাকায় দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর যার যার বাসায় ফিরবে।
পরেরদিন সাজমুল নিয়ে যায় নুজহাতকে। নুজহাত পরেছে ছাই রঙের জামা, লাল সেলোয়ার আর লাল ওড়না। সোহানা পরেছে- নুজহাতের গিফট করা শাড়ি।
দুজনের পরিহিত কাপড়ে এমনিতেই মিল পরে যায়। এই নিয়েও সবাই হাসাহাসি করে, বলে বাহ! বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ডের ড্রেসেও দেখি দারুণ মিল।
সারাদিন সবাই ধানমণ্ডি লেক, ঢাবি ক্যাম্পাস ঘুরে দুপুরে নীরব হোটেলে খেয়ে তারপর যার যার বাসায় ফেরে। এর ফাঁকে নুজহাত সোহানার কানে ফিসফিস করে সোহানার প্রিয় মানুষ এলহামের কথা জিজ্ঞেস করে। তিনি একজন কবি এবং চিত্রশিল্পী। কথা বলতে বলতেই সোহানা জড়িয়ে গেছে এলহামের সাথে। সেবার এলহামের সাথে সোহানার দেখা হবার কথা। কেবল নুজহাত এবং আরেকজন বন্ধু জানে সোহানার এই ব্যাপারটা।
৫
সোহানা পরিবার নিয়ে এক মাসের জন্য ইউরোপে বেড়াতে যায়। তখন নুজহাতের সাথে অনেকদিন কথা হয় না। নুজহাত অনেক মিস করলেও নুজহাত ফোন দেয় না।
এর ভেতর নুজহাতের জীবনে ঘটে যায় এক অন্যরকম ঘটনা। শাহীন চৌধুরী একুশে পদক পাওয়া নাট্যকার এবং ঔপন্যাসিক। একটা লিটল ম্যাগ সম্পাদনা করতে গিয়ে নুজহাতের সাথে পরিচয়। পরিচয়ের শুরু থেকেই
শাহীন চৌধুরী বিভিন্ন ভাবে নুজহাতকে তাঁর পছন্দের কথা বলে আসছিল। কিন্তু নুজহাতের সবসময় মনে হয়েছে – মানুষ তার লেখক সত্তাকে তিরষ্কার করবে।
সে একা নিজের প্রচেষ্টায় উঠতে চায়। তাই বন্ধুত্ব থাকলেও নুজহাত প্রেমে জড়াতে চায়নি। আর লোকটাকে ভীষণ ভয় লাগত নুজহাতের।
কিন্তু তিন বছরের মাথায় শাহীন চৌধুরী ছয় মাসের জন্য জার্মানি যান। আর তখন নুজহাত ভেতর থেকে কাবু হয়ে যায়। তার সমস্ত প্রতিরোধের দেয়াল খসে পড়তে থাকে। অত:পর শাহীন চৌধুরী জার্মানি থেকে ফিরলে একদিন ধানমন্ডি লেকে দেখা করে নুজহাত বলে- ব্যাপারটা আর সহজ নেই। শাহীন চৌধুরী হেসে বলে- কোনোদিনই সহজ ছিল না। কেবল তুমিই বোঝোনি।
সোহানা ইউরোপ থেকে ফেরার সাথে সাথে নুজহাত সোহানাকে সবকিছু বলে দেয়। উনি বোধহয় পারফেক্ট তোমার জন্য। উনি তোমাকে গাইড করতে পারবেন।
সম্পর্ক চর্চার পরিক্রমায় নুজহাতের কখনো কখনো মনে হয় – শাহীন চৌধুরী খুব ব্যস্ত এবং আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। নুজহাতের ভালোবাসা তাকে ভীষণ প্রশান্তি দেয় কিন্তু সে নুজহাতের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভাবে না। নুজহাতকে সেভাবে সময় দিতে পারে না। নুজহাত সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে যাকে ভালোবাসে সে থাকে কেবলই উদাসীন। নুজহাত যখন সমস্ত মন-প্রাণ নিয়ে একটা গভীর আলিঙ্গনের জন্য অপেক্ষা করে তখন অই লেখক হয়তো নিজের কাজে প্রচন্ড ব্যস্ত বা ঘুমিয়ে থাকে। একসময় নুজহাতের মনে হতে থাকে শাহীন চৌধুরী আসলে অবসর আর অবসাদে কেবল নুজহাতের সঙ্গ চায়। এই সম্পর্কটাকে সে খুব সিরিয়াসলি নেয়নি।
নুজহাত এই নিয়ে সোহানার সাথে কথা বলে। সোহানা বলে লেখক এবং ক্রিয়েটিভ মানুষরা আত্মকেন্দ্রিকই হয়। আমি এলহামকেও দেখেছি এমনই। তুমি যদি সম্পর্কটা রাখতে চাও তাহলে এইসব মেনে নিয়েই রাখতে হবে। আর যদি বেরিয়ে আসতে তাহলে ভেবে দেখ। কিন্তু উনি মানুষ ভালো। নুজহাত বলে তিনি পলি মাটির মতো উষ্ণ মানুষ। তাছাড়া তাঁর ব্যস্ততাও পাহাড়সম।
প্রেম, দাম্পত্য, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সফলতা -ব্যর্থতা সবই দুজন দুজনকে শেয়ার করে। যেন দুই বন্ধু দুজনের পরম প্রশ্রয় হয়ে ওঠে। ওদের স্বমীরা ওদেরকে মশকরা করে বলে- আসল জুটি তো তোমরা। নুজহাত বলে চল জি এফ পরের জন্মে আমরা সত্যি কাপল হয়ে জন্মাই।
৬
বান্দরবন সাইরু রিসোর্ট। নুজহাত আর সোহানা এক সপ্তাহের জন্য ঘুরতে বেড়িয়েছে। সোহানা নুজহাতের জন্মদিনের ট্রিট দিচ্ছে। দুজন যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটাচ্ছে। সারাদিন ইচ্ছামত ঘোরাঘুরি করছে। দুজনেই একরকম ড্রেস পরছে, একরকম শাড়ি পরছে। রোদ চশমা পরে কোমর জড়িয়ে ছবি তুলছে। নুজহাত সারাক্ষণই সোহানাকে জানু বলে ডাকে, কোমর জড়িয়ে ছবি তোলে। লোকজন বলে – দ্যাশটা কী আম্রিকা অইয়া গেল! আগে দেখছি ব্যাটা-বেটির পরকীয়া পিরিত। আর এহন দেহি বেটির লগে বেটির পিরিত। সোহানা বলে- দেখ নুজহাত কী বাজে কথা বলে! নুজহাত বলে- ওসব তুমি শুনো না। এদেশের মানুষ খুব বঞ্চিত। তাই সুন্দর কিছু ওদের চোখে সয় না। তিনদিন বান্দরবানে বাকলাই ঝরণা, বগা লেক, বুদ্ধ ধাতু জাদি, চিম্বুক পাহাড় রেঞ্জ, চিনরি ঝিরি ঝরণা, ফাইপি ঝর্ণা, জাদিপাই ঝর্ণা, কেওকারাডং, মেঘলা পর্যটন কমপেস্নক্স, মিরিংজা পর্যটন, নীলাচল, নীলগিরি, থানচি, পতংঝিরি ঝরণা, প্রান্তিক লেক, রাজবিহার, উজানিপারা বিহার, রিজুক ঝরণা, সব ঘুরে ঘুরে দেখে দুই বন্ধু। ক্লান্ত হয়ে ফিরে রাতে ম্যুভি ছাড়ে আর হোটেল বয়দের কাছে কফি চায় তখন ওরা বলে দুই বেডী কী করে? ডিলডো লাঠি কিইন্না লইয়াইছে নাকি? বাকিসব তো আত দিয়া করন যায়। কিন্তু ওরা দুই বন্ধু “আবাহমান” “অন্তহীন” ম্যুভি দেখে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
দুই বন্ধু ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখে- জীবনের অন্যতম কিছু শ্রেষ্ঠ সময়! ছবিতে দুজনেরই দেখা যায় প্রানখোলা হাসি। ওদের স্বামীরা ছবিতে মন্তব্য করে- আমরা যে বাসায় আছি সেটা ভুলে যেও না! বান্দরবান ভ্রমণ শেষ করে সোহানা বলে- চল এবার কক্সবাজার যাই।
শরতের বিকেল। সমুদ্র আর আকাশ যেন একই রঙের সবুজাভ ময়ূরকন্ঠী নীল রঙের শাড়িতে সেজেছে। নুজহাত আর সোহানা দুজনেই পরেছে ফিরোজা ব্লু লং শার্ট আর ব্লাক জিন্স। সোহানা বলে – চল নুজু সমুদ্রে নামি। নুজহাত বলে – তুমি তো সাঁতার জানো না জানু! সোহানা বলে- তুমি আছ না বি এফ। তাছাড়া বেশি দূর যাব না। হঠাৎ একটা পর্বত সমান ঢেউয়ে ঢাকা পড়ে যায় সোহানা। নুজহাত একবার হেল্প বলে চিৎকার করে আরেকবার সোহানা বলে চিৎকার করে। এরপর দেখা যায় অনেকদূর সোহানা হাবুডুবু খাচ্ছে। ছুটে যায় নুজহাত।
তারপর উদ্ধার কর্মীরা আর কাউকেই খুঁজে পেল না।
৭
দেবদূতের সাথে স্বর্গে এসেই সোহানা কটমট করে তাকিয়ে বলে- এই এঞ্জেল তুমি আমাকে নিয়ে এলে কেন? নুজহাত ও বলে- আমার ছেলে কেঁদে কেঁদে একেবারে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এটা তোমার কেমন কাজ আযরাইল? তুমি মানুষ না। কখনো পিতা কিংবা মাতা হওনি তাই এসব অকাজ করতে পারো। এসব দেখে পরম স্রষ্টা হাসছেন মিটিমিটি। তিনি আরেকজন দেবদূতকে পাঠিয়ে দুজনকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠান।
স্রষ্টাকে সোহানা বলে- আমার মেয়েরা এখনো ছোট। ওদের দাদী আর বাবা ওদের আদরের চাইতে শাসন করে বেশি। ওদের কী হবে ঈশ্বর! আমি ওদের বিয়ে দেব, ওদের বাচ্চাদের সাথে খেলব! আর তুমি কি না
আমাকে নিয়ে এলে! নুজহাত বলে – আমার ছেলে আমি ভাত মাখিয়ে না দিলে খেতে পারে না। আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না। তুমি এ কী করলে স্রষ্টা !
স্রষ্টা বলেন- ওরা আমার ক্রিয়েচার। যেমন তোমরাও
আমার ক্রিয়েচার। আমার সকল সৃষ্টির ভালো-মন্দ, জন্ম-মৃত্যু, ভূত-ভবিষ্যত, বিয়ে – সাদী আমিই দেখি। ওসব নিয়ে তোমাদের এত কিসের ভাবনা! তবে মায়ের মন একটু তো কাঁদবে! কিন্তু তোমরা তো দুজন বেশ ভালো ছিলে। সংসার, সন্তান এসব প্রায় ভুলেই ছিলে।
তাছাড়া দুজন কী সুন্দর বিএফ, জি এফ বলছিলে। তোমাদের আনন্দ দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি তোমাদের দুজনকে সত্যি দম্পতি করে পাঠিয়ে দেব। নারী-পুরুষের প্রেম আমি খুব ভালোবাসি, নারী-নারী, কিংবা পুরুষ -পুরুষ প্রেম খুব অপছন্দ করি, ঘৃণা করি। সাথে সাথে দুজন বলে ওঠে – আমরা তো
নোংরামো করিনি কোনো। আমরা ভালো বন্ধু। স্রষ্টা বলেন-
এখন কে পুরুষ হবে বল? সাথে সাথে দুজন বলে- আমি আমার সন্তানের মা হয়েই থাকতে চাই। ঈশ্বর হেসে বলেন- সে তো অতীত। তোমাদের তিনদিন সময় দেয়া হল। দুজন মিলে ঠিক কর কে পুরুষ হবে?
৮
দুইটা বিশাল আয়নায় দুজন নিজেকে দেখছে দিগম্বর হয়ে। সোহানা নিজের স্তন দেখে আর ভাবে স্বধীনের কত পছন্দ এগুলো। পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলে-
আহা! আমার মাতৃত্বের চিহ্ন! নাহ অমন বিশ্রী পুরুষের শরীর আমি চাই না। কী শক্ত ওদের শরীর!
তাছাড়া আমার কন্ঠ কত সুন্দর রিনরিনে। নুজহাত হোক। আমি নারী হয়ে গিয়ে আবার মেয়েদের খুঁজে নেব। ঈশ্বরকে একথা বলব না।
নুজহাত ভাবে- আমি অতটা রমণীয় না হই, তাতে কী!
এই নারী জন্মই আমি ভালোবাসি। আমার মাতৃত্ব আমার সাত জনমের পাওয়া। আমার ছেলেটা কত্ত সুন্দর, কত কুউল মাশাল্লাহ! কেবল এরকম একটা ছেলের মা হয়েই সাতটা জীবন পার করে দেয়া যায়।আমার চোখ পুরুষের হৃদয় হরণ করে। আমার সমুন্নত বক্ষযুগলে পুরুষের চোখ আটকে যায়। আমার পাঠক জীবন, লেখক জীবন সে নারী হিসেবেই ধন্য। নারী হয়ে জীবন বৃক্ষকে আমি একেবারে শিকড় থেকে দেখতে পেরেছি। মগডাল থেকে নয়। নারী জন্ম আমি শত শতবার চাই।
এরপর দুজন এককক্ষে আসলে সোহানা বলে- নুজু আমি বলি কী – তুমি তো পুরুষ স্বভাবেরই তুমি পুরুষ হয়ে যাও। ভালো হবে। নুজহাত বলে – পুরুষ স্বভাবের হয়ে আমি পুরুষ জন্মের অনেককিছুই বুঝেছি, উপভোগ করেছি। তুমি বরং পুরুষ হয়ে যাও। একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবন পাবে তুমি। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসব। অমনি সোহানা ক্ষেপে গিয়ে বলে- তোমার সাথে বন্ধুত্ব করাটাই ভুল হইছে আমার। নুজহাত ঠান্ডা গলায় শীতল চাহনি দিয়ে বলে- সমুদ্রে তো তুমিই যেতে চেয়েছিলে। সাঁতার জানো না। আবার সমুদ্রে নামো!
তোমার জন্য আমার মরতে হল! আমার ছেলেটা ভীষণ একা হয়ে গেল! সোহানা বলে জিএফ, জিএফ করে জিহবা শুকিয়ে ফেলেছিলে কেন? ফাজিল মেয়ে কোথাগার! একটা অসম্পূর্ণ জীবন যাপন করে আসলাম! এভাবে দুজন ঝগড়া করে দুইদিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পড়ে সেদিন। এরপর স্বর্গে ফুল পাখি দেখে কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলে না।
৮
স্বর্গোদ্যানে সব দেবদূতরা দেখতে পায় নতুন দুটি ফুলগাছ। বিভিন্ন রঙের ফুলে সেজেছে গাছদুটো। কান্ডে কান্ডে নীল, বেগুনি, লাল, গোলাপি ফুল আর সাদা ফুল। একটা গাছের বেগুনি ফুল বেশি গাঢ়, আরেকটা গাছের লাল ফুলগুলো একেবারে সিঁদুর লাল রঙের। দেবদূতরা ঈশ্বরের সৃষ্টির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অদ্ভুত মাদকীয় সুঘ্রাণ বেগুনি রঙের ফুলে। আর লাল রঙের ফুলের ঘ্রাণ খুব কড়া।
ঈশ্বর ভাবছেন একা একা। একদম ঠিক হয়েছে। এমন
একটা প্রাণী বানিয়েছি- যারা আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা আর সঙ্কীর্ণতা ছাড়া কিছু বোঝে না। ওদের বাচ্চার সমস্ত দায়িত্ব যেন ওদের! থাকুক ফুল গাছ হয়ে।
যদিও ভালো মানুষ আছে। কিন্তু স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক মানুষে দুনিয়াটা ভরে গেছে!
০৯.
বহুদিন পর একদিন স্বর্গোদ্যানে পরম স্রষ্টা বৃষ্টি নামান।
গাছ দুটো হঠাৎ ফিরে পায় পূর্ব জন্মের স্মৃতি। গাঢ় বেগুনি ফুল গাছটার মনে হতে থাকে- স্বাধীন সঙ্গমের সময় কত আদর করত! শ্বাশুড়ি একটু ঝামেলা করলেও তার দুটো সুন্দর মেয়ে ছিল। বড় মেয়েটা ভীষণ মেধাবী, কী সুন্দর নাচত! ছোটোটা একটু অলস হলেও অনেক কিউট ছিল। ঘুরে ঘুরে মায়ের কাছে আসত! চুমু খেত আর কত বায়না ধরত!
সিঁদুর লাল ফুলের গাছটার মনে হতে থাকে- হাবীব সঙ্গম না করলেও, মাঝে মাঝেই আদর করে মুটু, মুটকি বলে ডাকত! পছন্দের খাবার কিনে দিত। ছেলে ফারহান মাকে ভীষণ ভালোবাসত। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। চুমু দিত। একবার বললেই ছেলে তার সব কথা শুনত! প্রেমিক শাহীন চৌধুরী ঠোঁটে, কপালে প্রগাঢ় চুমু খেত। গভীর আলিঙ্গন দিত। তাঁর শরীর, মন প্রশান্তিতে ভরে উঠত..
দুটি গাছে প্রধান কান্ডের মাঝখান থেকে ঝরতে থাকে কষ। কেবল ঈশ্বর জানেন- ওদের চোখ থেকে ঝরছে জল। সব দেবদূতরা দেখে হরেক রঙের ফুল। কেবল ঈশ্বর আর গাছদুটো দেখতে পায়- ওদের চোখ থেকে অনবরত ঝরতে থাকা জল।