উপন্যাস (পর্ব ১)
রাহুযৈবন | সুমন মজুমদার
পর্ব ১
সকাল থেকে রোদের সাইকেল চালিয়ে সূর্য যখন মধ্যনগর যেতে থাকে, ঈষৎ নিস্তেজ মাথাভাঙা নদী কেশো বুড়োর মতো হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে শ্বাস নেয়। তার শ্বাসের প্রাবল্যে দুপুর রোদে মানুষ তো বটেই, গ্রামের কুত্তাগুলোও ঘেমে নেয়ে ওঠে। ভ্যাপসা গরমে মানুষগুলো কেউ ঘরে, কেউ ছায়ার মধ্যে লুকালেও কুত্তাগুলোর ঘামটাম নিয়ে কিছু যায় আসে না। মোট আটটা কুত্তা জিভ বের করে আটভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে অধীর অপেক্ষায় থাকে মহাতাপের। এখন অগ্রহায়ণ, হিসাবে রোদের তাপ একটু হলেও কম থাকার কথা। কিন্তু কিসের কি! দুপুর ১টার দিকে রোদের তাপ আরও বেড়ে গেলে দেখা যায়, মাথাভাঙার ভাঙা পার ধরে মাঠের পথে উঠে এসে ভোগাইল বগাদীর দিকে এগিয়ে আসছে লোকটা। হাতে মস্ত এক বাজারের ব্যাগ। তাতে যে নানা জিনিস ঠাসা সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যত দূরেই থাক, কান খাড়া করে উপস্থিতি দেখেই মহাতাপের কাছে পৌঁছাতে অলিম্পিকের দৌড় দেয় কুত্তারা। কার আগে কে পৌঁছাবে, কালোটা নাকি লালটা! নাকি ধুসর আর সাদা ফুটকি! তবে যে-ই আগে পৌঁছাক, সবার জন্য মহাতাপের বাজারের ব্যাগে খাওয়ার মতো কিছু না কিছু যে আছে কুত্তারা তা জানে।
একটা অশ্বথ গাছের ছায়ায় মহাতাপ দাঁড়ায়। কুত্তাগুলো গরগর করতে করতে তাকে ঘিরে আনন্দে মাটি আঁচড়াতে থাকে। বাজারের ব্যাগ থেকে কুত্তাদের জন্য বনরুটি, আবার কোনটির জন্য বিস্কুট বের করে। শরীর অপরিষ্কার আছে থাকুক, কাঁধের গামছা (ত্যানা বলাই শ্রেয়) একটু আগে মাথাভাঙার জলে ভিজিয়ে কেচে নেওয়ার ফলে বেশ পরিষ্কারই আছে। অশ্বথের নিচে চকচকে মাটি বালুর মধ্যেও মানুষটা গামছা দিয়ে মাটি ঝাড় দেয়। এদিক-ওদিক খানিক কাঁচা ধুলো ওড়ে, কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যায় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে একটা পিঁপড়া বা পোকাও নাই। অবশেষে মহাতাপ খুব আদরে সম্ভ্রমে রুটি ছিঁড়ে, বিস্কুট ভেঙে মাটিতে রাখে, আর মুখ দিয়ে চু চু শব্দ করে কুত্তাগুলোকে বলে, নে নে খা খা…
কুত্তারা যখন খাওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মহাতাপ তখন তৃপ্তির হাসি হেসে বাজারের ব্যাগ থেকে বের করে আস্ত এক টাইগার। এটা সার্কাসের জাদুকরের ভেলকিবাজি না যে, চোখের সামনের লাল পর্দা সরালেই আস্ত বাঘ বেরিয়ে আসবে। এই টাইগার বাঘ নয় বরং সেই গত বিকেলে ভাংবাড়িয়া সদরের কালুর দোকান থেকে কেনা চনমনে অ্যানার্জি ড্রিংক। গরমের মধ্যে গলায় একটু টাইগার ঢালার আনন্দ মহাতাপকে সার্কাসে ভেলকিবাজি দেখার চেয়ে বরং বেশি আরাম দেয়। এবার নিশ্চয়ই একটা সিগারেটও ধরানো যায়। যদিও সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। কুত্তাগুলোর জন্য খাওয়া এনেছে ঠিক, কিন্তু নিজে কিছু খায়নি। আর খাওয়া, এত খায়ি কোরবি কি! দোমের খাওয়া আচে নাকি!
কতা বুলবি, তবে মানুষির সাতে না, কতা হবে কুকুরির সাতে, পুকার সাতে, গাছের সাতে, গাঙের সাতে। কতা চালাবি মাটির পিঁপড়ির সাতেও। তারা তোকে যা বোলবে, তা ওই মানুষ বুলতি পারবে না।
কানের পাশে গোঁজা ছিল সুপারস্টার গোল্ড আর ময়লা লুঙ্গির কোঁচরে ম্যাচ। টাইগারের স্বাদ মুখে থাকতে থাকতে এবার ধোঁয়ার স্বাদও পাওয়া যায়। তার নাম আসলে মাহতাব হলেও ভোগাইল বগাদীর লোকমুখে অপভ্রংশ হতে হতে সে এখন সর্বজনে পরিণত হয়েছে মহাতাপে। আবার তুচ্ছার্থেও মাহতাব মহাতাপ হয়ে যেতে পারে। সে যাই হোক, তাতে মাহতাব বা মহাতাপের কিছু যায় আসে না। সে তার কুত্তা, বনরুটি, বিস্কুট, টাইগার-স্পিড, সুপারস্টার গোল্ড, মাথাভাঙা আর ওস্তাদ ফকিরকে নিয়েই সন্তুষ্ট। ঘর-বাড়ি নেই, বউ-ছেলে-মেয়ে নেই এত কিছু দিয়ে হবে কি! তার চেয়ে বরং এই জীবনটাই ভালো লাগে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে মাথাভাঙার কিনারে চলে যাও, সেখানে খানিক সময় কাটিয়ে চলে যাও ভোগাইল বাজারে। রতনের স্টলে সবাই তখন চা মারতে ব্যস্ত, কিন্তু মহাতাপের রুটিন হলো রুটি-বিস্কুট-টাইগার আর সিগারেট।
রতন তো একদিন বলেই বসলো – এই যে তুমি সকাল নি, দুপুর নি, রাইত নি, ভাত রুটি কলা-টলা কিছু খাইচ্চু না, এরকম কইরি থাকলি তো মইরি যাবা। এই খালি প্যাটে কেউ টাইগার স্পিড বিড়িটিড়ি খায়? ছিলে ডাকাইত, এখন ভান ধরিছো ফকিরির। নামাজ-কালাম আছে যে তুমি ফকির হবা? কাজ করো না, কর্ম করো না, খালি ইলিয়াস ফকিরির ট্যাকেততি ট্যাকা আইনি উড়াও। যতসব ভণ্ডামি! শোনো, এভাবে চলবে নানে। একনু টাইম আছে, ভালো হয়ি যাও। ভাইরা আছে, তাগের কাছে গেলি তারা তো ফিরি দেবে না।
কত মানুষই তো কত প্রশ্ন করে, কত পরামর্শ দেয় কিন্তু সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে না মহাতাপ। তার ওস্তাদ ইলিয়াস ফকিরই কারো কথার জবাব দেয় না, তাহলে সে কেন দেবে! হ্যাঁ, এটা সত্যি যে মহাতাপ আগে ডাকাত ছিল। ডাকাত মানে সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিয়েছিল আরকি। তারপর লোকজনের সাথে রাজশাহী, কুষ্টিয়া, মহাদেবপুর, ঝিনেদার দিকে এক আধটু লুটপাটে অংশ নিয়েছে। দুই একজনকে কোপ-টোপ দিয়ে আহতও করেছে। কিন্তু বর্তমানে তো সব ছেড়ে ছুড়েছে; তাহলে এখন সে কেন ফকির হতে পারবে না! ওস্তাদ ইলিয়াস ফকির তাকে শুনিয়েছে, হিন্দুগের মধ্যি মেলাদিন আগে রত্নাকর নামে নাকি ডাকাইত ছিলু। সে পরে বিরাট ফকির হয়ি ওটে। পরে সেই ফকির বাল্মীকি নাম নিয়ি নাকি নাম-সীতার কাহিনী লিকিচে।
মহাতাপ তো এত কিছু চায় না। রাম-সীতার কাহিনী বা বড় জোর গাজী-কালুর গীতও সে লিখতে চায় না। মহাতাপ চায়, নিজের মতো করে একটু ভাবে-বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে-আনন্দে আপন জগতে থাকতে। তবু মানুষের এটা সহ্য হয় না। খালি প্রশ্ন আর প্রশ্ন, পরামর্শ, উপদেশ। মানুষ তো না, যেন কথাবার্তার দোকান।
একদিন আশ্বীনা চন্দ্রালোকে গাঁজার গাজনে ইলিয়াস ফকির মহাতাপকে বলেছিলেন, শোন, কতা যত কোম বুলবি, তত পাপ কাটা যাবে। আর পাপ কাটা যাওয়া মানে তাপ কাটা। শরীলির তাপ যখন থাকপে না, তখন দেহর ভারটা বইতি সুবিদে হবে। কতা বুলবি, তবে মানুষির সাতে না, কতা হবে কুকুরির সাতে, পুকার সাতে, গাছের সাতে, গাঙের সাতে। কতা চালাবি মাটির পিঁপড়ির সাতেও। তারা তোকে যা বোলবে, তা ওই মানুষ বুলতি পারবে না। মানুষ খালি বোলবে নিজির কতা আর উরা তোকে বোলবে জগতের কতা, সৃষ্টির কতা, বাঁইচি থাকার কতা।
সেই থেকে মহাতাপ সচেতনভাবেই মানুষের সাথে কথা বলা কমিয়েছে। সে কুত্তাগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে তখন কিছু একটা গুনগুন করছিল, মাঝে মাঝে টাইগারে একটু চুমুক। এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত ফজলু। সাথে তার অচেনা একটা ছেলে। হাবভাব দেখেই বোঝা যায় ছেলেটা শহর থেকে এসেছে। আর ফজলু ত্যাদড়কে তো মহাতাপ ভালোমতই চেনে। ফজলু আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের কাজই হলো মহাতাপকে দেখলে তাকে বিরক্ত করা। এ মহাতাপ ভাই, কদিন সেনান করোনি কওদিনি? গাততি তো শাউয়ো মার্কা বাসনা ছাড়িচে!
মহাতাপ, খালি একলা একলা টাইগার স্পিড খালি চলবে, আমাগেরু ইট্টু খাওয়াও। আমরাও ইট্টু মুইতি মাথাভাঙার পানি বাড়ি দিই।
ভাই মহাতাপ, এক গাবলা ভাত আইনি দেবুনি, খাবি? না হোলি ভাত পচি মদ বানাতি পারবে।
মহাতাপ ভাই, লুঙি উটাও দিনি, খালি গুর গোন্দ কচ্চে। হাইগে মনে হয় পানি নেওনি…
ও জাইরু মহাতাপ, দুটু গাইল শুনাও না। তুমার মাকে নাকি কারা চোদবে…
এরকম কত কত অযথা কথায় যে ফজলুরা মহাতাপকে উত্যক্ত করে তার ঠিক নেই। তবে ইদ্রিস ওস্তাদের কথায় মহাতাপ তার ডাকাতি মেজাজ ত্যাগ করেছে, তাই শত বিরক্তেও খুন আগের মতো মাথায় চড়ে বসে না। সে জন্যই তো ফজলুরা আরও সাহস পেয়ে যায়। অবশ্য আজ ফজলুর সাথে অন্য খানকির ছেলেগুলাকে দেখা যাচ্ছে না। যে ছেলেটা এসেছে তাকে দেখে বেশ ভদ্র আর শান্তই মনে হচ্ছে। ফজলু মহাতাপের কাছে এসে কপাল থেকে ঘাম ঝাড়ে। কুত্তাদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়েই সে বলে, শুনুছু নাকি মহাতাপ ভাই, ইলিয়াস ফকিরির ট্যাকে তো আবার চুরি হয়িচে। এবার কত ট্যাকা নিয়িচে কিডা জানে! বিছেনের তলায় ট্যাকা-পয়সা ফেলি রাকলি তো চুরি হবেই।
হাত ঝেড়ে মাটিতে ভালোভাবে দেখে নিল সামনে কোন পোকা বা পিঁপড়ে নেই তো। কদম ফেলে তাদের ছোট্ট প্রাণটা মাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। পৃথিবীর কোন প্রাণকে মারতে নেই।
ইলিয়াস ফকিরের ট্যাক থেকে টাকা চুরি যাওয়া মহাতাপের কাছে নতুন কোন খবর নয়। আগেও এ ধরনের বহু খবরের সাক্ষী সে। সুতরাং ফজলুর ব্রেকিং নিউজে তার মধ্যে কোন ভাবান্তর হয় না। বরং একটা কুত্তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তাকে রুটিটা শেষ করতে প্ররোচনা দেয়। বেচারারা আবার কখন কী খেতে পাবে ঠিক নেই, তার চেয়ে এবেলা একটু পেট ভরা থাকলে ঘেউ ঘেউ কম করবে। মহাতাপের এমন ভাবলেসহীনতা দেখে অবশ্য ফজলুর সহ্য হয় না। সে খেকিয়ে বলে, এ ভাই, ইলিয়াস ফকিররে তুমি না উস্তাদ বোলো। তার ঘরে চুরি হলু আর সেডা শুনার পরও তুমি কুকুরির গলা হাতাচ্চু!
মহাতাপ কিছু বলে না, কেবল ফজলুর দিকে নিজের বিড়ি খাওয়া কালো ময়লা দাঁত বের করে হাসে। এক সময় কুত্তাগুলোর চেটেপুটে খাওয়া শেষ হয়। মহাতাপও টাইগারের বোতলের শেষ ফোঁটাটা গলায় ঢেলেছে। খালি পেটে টাইগার আর সিগারেট খাওয়ায় মহাতাপের মাথাটা একটু ধরেছে। পেটটাও কেমন যেন করছে। তবে এসবকে পাত্তা দেয় না। মহাতাপ ঠিক করলো, একবার ওস্তাদের বাড়িটা ঘুরেই আসবে। দেখে আসা যাক কত টাকা কেমনে কী চুরি হলো। হাত ঝেড়ে মাটিতে ভালোভাবে দেখে নিল সামনে কোন পোকা বা পিঁপড়ে নেই তো। কদম ফেলে তাদের ছোট্ট প্রাণটা মাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। পৃথিবীর কোন প্রাণকে মারতে নেই। সব প্রাণীরই তার নিজ নিজ জায়গায় তার মতো করে বাঁচার অধিকার আছে। মানুষের গায়ে শক্তি আছে বলেই অন্য প্রাণ মেরে বাহাদুরি ফলাবে, তেমনটা করা পাপ। ওস্তাদ ইলিয়াস ফকির তাকে এত বছর ধরে সেটাই শিখিয়ে যাচ্ছে।
মহাতাপ দেখে-শুনে কদম বাড়ায় ওস্তাদের আখড়ার পথে। মাঠ পেরিয়ে পানের বরজ, তারপর খানিকটা ধানি জমি আর ডোবা। এর পরেই কিছু দূর হাঁটলে পড়বে ওস্তাদের আখড়া। মহাতাপ যখন যাচ্ছে, পেছনে ফজলু তখন বিড়ি ধরিয়ে নতুন ছেলেটার সঙ্গে কী যেন বলছিল। মহাতাপ আবার তাদের কাছে ফিরে আসে আর জিজ্ঞেস করে, এ কে?
মৌন মহাতাপ হঠাৎ এসে প্রশ্ন করবে, ফজলু তা ভেবে উঠতে পারেনি। নতুন ছেলেটাও ততক্ষণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। তারপর ফজলু অস্ফুট স্বরে বলে, এ সঞ্জয়। ইন্ডিয়ার নদীয়াততি আসিচে প্রাণকৃষ্ণগের বাড়ি বেড়াতি।
মহাতাপ আর কিছু বলে না। শুধু দুই বার আপন মনে উচ্চারণ করে – সঞ্জয় সঞ্জয়…
(চলবে)

