Site icon তীরন্দাজ

বেড়াল ও ব্লাউজ | সুমন মজুমদার | তীরন্দাজ ছোটগল্প


পৃথিবীর কোথায় কোনখানে কি ঘটছে তাতে আমার কি? খুন, জখম, ধর্ষণ, হাসি, বেদনা, ভালোবাসা, প্রার্থনা, অপেক্ষা, আগ্রাসন, ধ্বংস কতকিছুই তো হচ্ছে নিয়ত। তাতে আমি এত উদ্বিগ্ন হবো কেন! কে কলঙ্কিত হলো আর কে পুরষ্কৃত, কে পতিত অথবা কার উত্থান; তাতে আমি কি করবো? কারা ক্ষণ গুণছে মৃত্যুর আর কারা উজ্জীবিত, কাদের কাদের কোন ভূতে পেয়েছে এতে আমার সমস্যা কোথায়? জানি সমস্যা নেই, ভুলে থাকলেই যাবতীয় ভুল ভুলে থাকা যায়। তারপরও আমার সবকিছু অপাংক্তেয় লাগে! তবু কেন নিজেকে আমার সবকিছুর জন্য দোষী মনে হয়। আমার নিজেকে বড় দোষী দোষী লাগেরে…

সমস্যাটা কোথাও না, সমস্যা আমার নিজের মধ্যে। ইদানিং প্রায়ই মেসে ফিরতে মধ্যরাত হয়ে যায়। বেশি টাকা কখনোই থাকে না, তাই সস্তায় যতটুকু মদ পাওয়া যায়, ততটুকুই প্রাণ ভরে খেয়ে আসি, আর যত্তসব আজগুবি অর্থহীন কথা ভাবি। না ভেবেই বা কী করবো, মদ পেটে পরলে যে সারাদিনে দেখা এটা-ওটা-সেটা আমার চোখের সামনে টিভির মতো ভেসে ওঠে। ভাগ্যিস কোলে বেড়ালটা থাকে; নয়ত ভর রাত্তিরে কাকে যে এই কথাগুলো শোনাতে শোনাতে আসতাম জানি না। এই তো আমার লক্ষ্মী বেড়াল, আদরের মার্জার, পশমী পুতুল। আজ আমরা কি শিখবো বলো তো? বেড়াল আজ তোমাকে আমি ব্লাউজ শেখাব।

আমার কথা শুনে উলের বলের মতো নরম প্রাণীটা মৃদু মিউ মিউ করে, কিছু বোঝে কি না জানি না। তবে মনোযোগ দিয়ে যে শোনে এটা নিশ্চিত। আমার পকেটে একটা আটত্রিশ সাইজের হাতাকাটা ব্লাউজ দলামোচা করে রাখা আছে। ব্লাউজটা লুকিয়ে নিয়ে সেই বিকেল থেকে আমি ঘুরছি। এখানে গেলাম, ওখানে দাঁড়ালাম, এর সাথে দেখা হলো, তার সঙ্গে কথা-বসা, তবু মাঝে মাঝে ঠিকই পকেটের ব্লাউজ ছুঁয়ে দেখি। তারপর শেষ যখন শুড়িখানায়, তখন খানিকটা গিলে চলে গেলাম বমির কড়া গন্ধভরা বাথরুমে। হালকা কলাপাতা সবুজ রঙের ব্লাউজটা বের করেছিলাম কিছু সময়ের জন্যে। হাত দুটো কাটা হলেও ব্লাউজের বুক ঠিকই উন্নত। সবুজ ঘাসের মালভূমি পেরিয়ে পাশাপাশি ঘন অরণ্যবেষ্টিত দুটো পর্বতের যেন উত্থান হয়েছে। ঘাড়ের কাছে পেছনের হুকগুলো হয়ত নীরবে অপেক্ষা করছে, কেউ তাদের আদরে আদরে বন্ধনমুক্ত করবে। মূলত তখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই, আজ বেড়ালটাকে ব্লাউজ শেখাতে হবে।

অবশ্য সকালটা শুরু হয়েছিল অন্যভাবে। শুনেছি কোথায় নাকি বিক্ষোভ হচ্ছে, বাসা থেকে বের হওয়া বিপজ্জনক। তিন মাস বেতন না পেয়ে শ্রমিকরা দলে দলে নেমেছে দাবি আদায়ে। ছাত্ররা নেমেছে, তাদের চাওয়া পাওয়া নিয়ে। কিছু জনতা রাস্তায় বের হয়েছে অদ্ভূত সব বৈষম্যের প্রতিবাদে। পুলিশও সবাইকে ঠেঙাচ্ছে বৈষম্যহীনভাবে। ভাবলাম, তাতে আমার কি! দুনিয়ায় কে খেতে পেল, আর কে পাচ্ছে না, কার চাকরি আছে আর কার নেই, কোন সংসার চলছে, অথবা চলছে না; সেটার দেখভাল তো আমার দায়িত্ব নয়। নিজের মুখের গ্রাস ঠিকঠাক জুটলেই হলো। আর আমি বাসা থেকে বের হবো কি হবো না, সেটা অন্যে বলার কে?

তার চেয়ে মেস থেকে বেরিয়ে বেড়ালটার নরম পশমে হাত বুলাতে বুলাতে পাড়ার মসজিদের দেয়ালে লেপ্টে দেওয়া তিন নম্বরি পত্রিকায় চোখ রেখেছিলাম সিনেমা সংক্রান্ত চটুল কিছু পড়া যায় কি না সে আশায়। কোন নায়িকার পেটে কার বাচ্চা, কোন নায়ক প্রেম করছে লুকিয়ে, কোন হাস্যময়ীকে বিকিনি পরলে লাস্যময়ী লাগে, প্রত্যাশা ছিল এমন কিছু খবরের। অথবা আরো লঘু বা বিচিত্র কিছু। আজ রাশিফল কি, আবহাওয়ায় বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে কি না, কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়, কোন খাবার খেলে কি পুষ্টি পাবো, নতুন কোন গ্রহ-নক্ষত্র আবিষ্কার হয়েছে, কে বিশ্বরেকর্ড করলো, এমন আরকি। অথচ সব ব্যতিরেকে চোখ পরলো পরাবাস্তব এক ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর কোন ভূখণ্ডে তীব্র ঘৃণা আর অভিমান চোখে কান্নারত রক্তাক্ত শিশুটির ছবির দিকে। বাচ্চাটা যেন আমাকে চোখ সরাতে দিচ্ছিল না কোনভাবে। তবু জোর করে দৃষ্টি পত্রিকার অন্য পাতায় সরাতেই দেখি, নিখুঁত নিশানায় বন্দুক তাক করে আছে একদল পুলিশ। বোঝা যাচ্ছে, যে-মুহূর্তে ছবিটা তোলা হয়েছে, পরক্ষণেই ওদের বন্দুকের নলে ঝলসে উঠেছিল আগুনেমৃত্যু। পাশেই আরেকটা ছবিতে মুর্তিমান প্রতিহিংসা হয়ে লাঠি হাতে একদল যুবক পেটাচ্ছে কাউকে। আরেক দলের হাতে জ্বলন্ত মশাল, মোলোটভ বোমা। পাশেই দাউ দাউ পুড়ছে কিছু একটা। ঔদ্ধত্য নেতার হাসিমুখে গলাবাজির ছবিও সমান দৃশ্যমান।

আমার আর পত্রিকা দেখা হয় না, বরং বেড়ালটা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব মেসের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেই। আমি এসব সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলি। মনকে অটো সাজেশন দেই, এসব কোনভাবেই দেখা যাবে না। এসব দেখে মনের শান্তি নষ্ট করা অবান্তর। অন্য সবাই হয়তো ভাবে, এই লোক সারাদিন একা ঘরে দরজা আটকে কি করে! কিন্তু কেউ জানুক বা না জানুক, আমার বেড়ালটা ঠিকই জানে, আমি কারো কাছে এর জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। রাতে যে মদ খেয়ে মেসে ফিরি, সেটাও কারো বাপের টাকায় না। একেবারে ষোলআনা নিজের মৃত বাপের। কাজ-কর্ম না করলেও, গ্রামের বাড়ি থেকে কিছু টাকা আমার ঠিকই আসে। চলে যায় ভালো-মন্দে সেটা দিয়ে।

আজ রাতে ভাগ্যে যেটুকু মদ জুটেছে তাতে আমি খুশি। যদিও সারাদিনে দেখা, শোনা, বীভৎস ছবি, খবর, দৃশ্যগুলো জীবন্ত হয়ে বারবার আমাকে সন্ত্রস্ত করে তুলছে। তারপরও টলতে টলতে অন্ধকার রাতে আমার হাঁটতে ভালো লাগে এই মনে করে যে, বেড়ালটাকে ব্লাউজ শেখানো শুরু করলেই হয়ত কোন এক জাদুমন্ত্রে ভয় আর দোষ জাগানিয়া ছবি কিংবা চিত্রগুলো চলে যাবে। তখন হয়ত গোটা পৃথিবী হয়ে উঠবে সেই হালকা কলাপাতা রঙের ব্লাউজময়। মনে মনে ভেবে নেবো, সেই আটত্রিশ নম্বরি ব্লাউজের ভেতরে আছে এমন এক অলীক মানবির তুলতুলে স্তন, যাকে নিয়ে জীবনানন্দ আজকের দিন লিখে গেছেন :

তোমার ব্লাউজের দুই গাল ফুলে উঠেছে
ব্লাউজ নয়, দুই তাম্বুরা যেন
ধানের মদ খেয়ে শাড়ির ভিতর তোমার অজস্র ইঁদুর নাচছে;
অজস্র ধানের মতো তোমার চুলের ভিতর,
তোমার দেহের পক্ক সোনালি মাদকতার ভিতর
মাতাল বিড়ালের দল, মাতাল ইঁদুরের জাঙ্গাল শিকার করে বেড়াচ্ছে আজ!

হঠাৎ করে ঠিক বুঝতে পারি না, আমি সেই মাতাল বেড়ালের দলে, নাকি ইঁদুরের জাঙ্গালের অংশ। তারপরও কবিতা ভাবতে ভাবতেই মনে হয়, একটা গান চলতে পারে। কিন্তু বেড়ালটা বোধহয় আমার মনের কথা টের পায়। ও এমন নিষেধের সুরে মিউমিউ করে, যেন বলতে চায়, থাক না, অযথা বেসুরো গানে, নির্জনতার সুর ভেঙে দেবে কেন। তার চেয়ে বরং চলো, আজ আমরা এই নর্দমার পাশে বসেই ব্লাউজের পাঠশালা খুলি।

আমারও তখন তাই মনে হয়। এই রাতে না হয় মেসে না-ই বা ফিরলাম। বরং রাতের কাছে কিছু অবাধ্যতার দাবি থাক। আমি কি হাঁটতে হাঁটতে পড়ে গেছি, নাকি নিজেই বসেছি ঠিক মনে নেই। তবে চারপাশে যে বর্তমানের মতো বাস্তব নর্দমা এটা ঘ্রাণে গন্ধে টের পাওয়া যাচ্ছে। নর্দমায় কত বাতিল কিছুই তো পড়ে থাকে। আমরা দু’জনও না হয় আজ বাতিল জঞ্জালের মতো পড়ে থাকবো। তবু ব্লাউজটা তো বেড়ালকে শেখানো হবে।

ছোট্ট প্রাণীটা মিউ মিউ শব্দে আমার কোলে হয় ওম, নয় আদর খোঁজে। কিন্তু ওকে আমি প্রশ্রয় দেই না। কোল থেকে নামিয়ে বলি – চুপ করে বাধ্য ছাত্রের মতো সামনে বসে থাকো। বেড়াল, তুমি কি জানো ব্লাউজ কত প্রকার ও কি কি? দেশে কোথায় কোন দোকানে কে সেই দর্জি, যিনি সবচেয়ে ভালো ব্লাউজ বানায়? ব্লাউজ পরা একটা বাইজির বুকে হাত রেখে দেখেছ কখনো, কতটা নরম হয়? বেড়াল, তোমাকে বুঝতে হবে ব্লাউজ একটা দারুণ অভিজ্ঞতা, ক্ষুধার চেয়ে বীভৎস চমৎকার আফ্রোদিজিয়াক। দেখার দৃষ্টি থাকলে চরম কামোদ্দীপকও। বোটনেক, ডিপনেক, ক্রপ, স্লিভলেস, চাইনিজ় কলার, কোল্ড শোল্ডার আহ, আরো কত কত ব্লাউজময় নাম। পৃথিবীটাকে একটা ব্লাউজের বুকে ঢুকিয়ে স্তনের নরম বিছানায় যদি কিছুদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখা যেত…

বাধ্য ছাত্র মিউমিউ করে হয়ত শিক্ষককে বলে, ধন্যবাদ স্যার, চরম ব্লাউজ শিখছি। বেড়ালদেরও যদি একটা ব্লাউজ হতো, খারাপ লাগতো না। দাঁড়াও আমি নিজেই ব্লাউজটা পরে নেই। তাহলেই বুঝতে পারবে ব্লাউজের সৌন্দর্য। মেয়েদের মতো আমার উঁচু বুক নেই, কিন্তু ভেবে নিতে তো কেউ বাধা দেয়নি। আমি ঘামে ভেজা চিটচিটে শার্টটা খুলে ব্লাউজ পরতেই বেড়ালটা অবাক হয়ে তাকায়। মিউমিউয়ের সাথে ওর কালো নাক ফুলে ওঠে, পশম দাঁড়িয়ে যায়। তবু ও আমার সামনে ঠিকই বসে থাকে বাধ্য সোনামনির মতো। আমরা আবার শিক্ষাক্রম শুরু করি।

শোন, যা বলছিলাম ব্লাউজের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্লিনে রেড আর্মি দ্বারা ধর্ষণের শিকার একটা মেয়ের ছবি দেখেছিলাম। কিন্তু ওর বিষাদময় মুখের চেয়ে আকর্ষণীয় ছিল অর্ধছেড়া ব্লাউজটা। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্লাউজের কথাটা বলি। কালো খয়েরি ব্লাউজ পরা একদল নানা বয়সী নারী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে তীব্র আতঙ্কে। সশস্ত্র সৈন্যরা ঘিরে আছে ওদের। একটু পরেই হয়ত এই যুথবদ্ধ নারীরা এক-একটি পৃথক সত্তায় বিভক্ত হয়ে বাধ্য হবে সৈন্যদের শয্যাসঙ্গী হতে। আরেকটা ছবিতে দেখি, একজন মর্দ সৈন্য কোন তরুণীর চুলের মুঠি ধরে তাকে বসিয়েছে হাঁটু গেড়ে। সৈন্যটার অন্য হাত তরুণীর বুকের ব্লাউজটা প্রায় ছিঁড়ে ফেলেছে। বিশ্বাস করবে না বেড়াল, ব্লাউজের ছেঁড়া অংশ দিয়ে মেয়েটার সাদা বুকের মধ্যে লাল ক্ষত রক্তজবা ফুলের মতো দেখাচ্ছিল। কেউ একজন ছবিটার ক্যাপশনে লিখেছিল – পলেটিক্স রেপ আস এভরিহয়্যার।

বেড়াল মিউ মিউ করে, আর কেন যেন হঠাৎ হেঁচকি ওঠে। গলা খানিকটা ধরে আসতে চায়। একাত্তরের ছবিও দেখেছি জানো। বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা অর্ধখোলা ব্লাউজ আর হাঁটু পর্যন্ত উঠে আসা পেটিকোট নিয়ে একটা মেয়ে মরে পড়ে আছে। তারপরে তো আরো কত কত দেখেছি। রক্তের সঙ্গে ব্লাউজের এই লাজুক লিবিডো সত্যি এক শিহরিত দৃশ্য তৈরি করে। একদিন পত্রিকায় কি দেখলাম জানো? দেখি মজুরি বাড়ানোর দাবিতে একদল পোশাক-দাস রাস্তায় মিছিল করার সময় হাঙ্গামা বেধেছিল। ওমনি পুলিশ গুলি করে দিল। আর একটা ফুল টোক্কা বুলেট সোজা গিয়ে চুমু খেলো কোন সেলাই মেয়ের সামলে রাখা বুকে। কাটা কলাগাছের মতো রাস্তায় পড়ে থাকা মেয়েটার শাড়ি ততক্ষণে কার্পেট হয়ে ঢেকে দিয়েছে পিচ। বুকে তখন ওর রক্তেভেজা ব্লাউজ ছাড়া কিচ্ছু ছিল না। বেড়াল, তুমি কি বুঝতে পারছো ব্লাউজের বক্তব্যটা? দৃশ্যটা মোটা দাগে বীভৎস, কিন্তু সুক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখলে চমৎকার বিমূর্ত।

উফ, আমি চাই না এসব ছবি মনে করতে, তবু বারবার আমার সামনে ওরা ভেসে আসে। আর সব কিছুর জন্য আমার নিজেকে খুব দোষী দোষী লাগে।

এখন মিউমিউ করলে চলবে না। বেড়াল তোমার ব্লাউজপঠন এখনো শেষ হয়নি। রাত যতদূর বাকি আছে, আজ ততদূর চলবে শিক্ষা কার্যক্রম। বেড়ালটাকে আসলে খোলাসা করা দরকার, কীভাবে পেয়েছি এই ব্লাউজ। ওর মিউমিউ সুর দেখেই বোঝা যায়, আজ রাতের এই পঠননাট্যে আমার আর ব্লাউজের ভূমিকাটা ঠিক কী তা ভেবেই সে ভ্যাবাচ্যাকা খাচ্ছে। প্রাণীটা নিজেও জানে, ব্লাউজটাতে আমার মালিকানা নেই। সকালে মেসে ঢোকার পথে মধ্যরাস্তা যখন গুলি আর পাল্টা সহিংসতায় খালি, তখন রোড ডিভাইডারের নিচে শাড়ি পরা একটা মেয়ের লাশ দেখেছিলাম। ওর বুক থেকেই আসলে ব্লাউজটা খুলে নেই। মেয়েটা হতে পারে শ্রমিক, ছাত্রী কিংবা নেহায়েৎ কোন গৃহবধূ। কে জানে হয়ত শাড়ি পরে কোথাও যেতে চেয়েছিল। অথবা অন্যকিছুও হতে পারে। মৃত মেয়েটার প্রাণহীন চোখ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল নিষ্পলক। কিন্তু মৃতদেহ আর রক্তের চেয়ে শাড়ির ফাঁক দিয়ে আমার বেশি নজর কেড়েছিল কলাপাতা সবুজ ওর ব্লাউজটা। দ্রুত আমি মেয়েটার প্রাণহীন শরীর থেকে ব্লাউজটা খুলে নিয়ে পালাই। কত মানুষই তো কত কিছু চুরি করে, সোনাদানা অর্থ সম্পদ, সম্মান, ঋণ। আমি না হয় একটা লাশের গা থেকে ব্লাউজ চুরি করেছি বেড়ালকে শেখাব বলে। এটা নিশ্চয়ই খুনের মতো বড় কোন অপরাধ নয়।

বাদ দাও সেসব কথা। কোথায় কত কে এভাবে মরে যাচ্ছে, তাতে আমার কি যায় আসে। ব্লাউজটাতে যে কী সুন্দর গন্ধ, আহ্। মনে হয় মৃত মেয়েটার ঘাম এখনো লেগে আছে। এখন আমার ঘামের সঙ্গে ওর ঘামের বিক্রিয়া ঘটে তৈরি হচ্ছে আরেক ধরনের গন্ধ। বেড়াল তুমি কি নতুন গন্ধটা পাচ্ছ? এটা আসলে ঠিক কেমন! প্রাণভরে শ্বাসের সঙ্গে নেওয়া যায় না, আবার উপেক্ষাও অসম্ভব।

বেড়াল তুমি বলো তো, ব্লাউজের অন্য নামগুলো কেমন? না জানাই স্বাভাবিক। আমিও তেমন ভালো জানি না। তবে শুনেছি ব্লাউজ হতে পারে – বক্ষবরণী, স্তনমসুক, কুরুপসিকা, কাঞ্চুকি। কী সব সুন্দর নাম তাই না? মানুষ কত ভালোবেসে ব্লাউজের এসব নাম দিয়েছে। আমিও তোমাকে ভালোবাসি বেড়াল। এই ব্লাউজটার মতো, সস্তা মদের মতো, ঘোরের মতো, ঘ্রাণের মতো। তারপরও কেন আমার এমন লাগে বলো তো? কেন আমার নিজেকে বড় দোষী দোষী লাগে!

রাত পোহাতে তো আর বেশি দেরি নেই। বেড়াল, আমি কি তোমাকে ব্লাউজ শেখাতে পারলাম? এই অনন্ত রক্তাক্ত বিধ্বস্ত সময়েও সব ভুলে থেকে তোমাকে যদি ব্লাউজ শেখাতে না পারি, সেই দোষেরও ভাগিদার হবো আমি। তোমার শিক্ষা শেষ হয়, অথচ আমার এই দোষের আফসোস যে শেষ হয় না।

তবু একসময় সকাল হয়, বেলা গড়ায়। উত্তপ্ত শহর উত্তেজনায় গণগণে হয়ে ওঠে আগের দিনের চেয়ে। রাস্তায় বের হয়ে কত সস্তায় মরে যায় মানুষ। আবর্জনার মতো, ছেঁড়া টুকরো কাগজের মতো, অপ্রয়োজনীয় এঁটো-কাঁটার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে লাশ। যে দিকে তাকাও প্রত্যেকের মুখ হিংসা, ক্রুরতা, প্রতিশোধে ভরা। প্রত্যেকে ছদ্মবেশে মারণাস্ত্র হাতে কার্যসিদ্ধিতে উদ্যত। এর মধ্যেই কলাপাতা সবুজ ব্লাউজ পরে একটা কুচকুচে বেড়াল কোলে এক লোককে নির্বিকারভাবে হেঁটে যেতে দেখা যায়। দৃশ্যটা হাস্যকর, তবে তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষ ভাবে, পাগল হবে হয়ত। কেউ কেউ ব্লাউজ পরা অদ্ভূত লোকটাকে ডেকে বলে, ওদিকে যাস না। ওদিকে বড় গণ্ডগোল।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। কেউ তো জানে না, আসলে বেড়ালকে ব্লাউজ শিখিয়ে আসা লোকটা কেন স্বেচ্ছায় ওদিকে যাচ্ছে। অনেকে লোকটাকে বাধা দিতে চায়। কিন্তু অবাধ্য লোকটা মানবে কেন? সত্যি, এই শহরে কারো কথা কেউ শোনে না…

Exit mobile version